বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা : কিছু দালিলিক চিত্র ও প্রাসঙ্গিক গল্প

বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা : কিছু দালিলিক চিত্র ও প্রাসঙ্গিক গল্প

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ উঠলে এসব ঘাতক-দালালকেও দেখা যায় বঙ্গবন্ধূকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে। খুনী আল-বদর নেতারা তখন বাকশালের জনকের নাম তাজিমের সঙ্গে উচ্চারণ করে বলে- তিনি তো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন, এতদিন পরে এসব নিয়ে আলোচনা অর্থহীন। রাজনৈতিক মিত্রতা সূত্রে তাদের পক্ষের সুশীল ও বুদ্ধিজীবিদের মুখেও একই কথার অনুরণন। লেখনীতেও। সঙ্গে জুড়ে যায় আজগুবী সব গালগল্প। দালাল শিরোমনি শাহ আজিজুর রহমানের সঙ্গে কুমিল্লা সার্কিট হাউজে খিচুড়ি খাওয়া, খান এ সবুরকে ছুটাতে গাড়ি নিয়ে নিজে জেল গেটে যাওয়া। একজন মহামানবকে বিতর্কিত করতে যত কসুর থাকে তারই সবই প্রয়োগ করে গেছে তারা প্রজন্মান্তরে। আর তা মুখে মুখে রটে, আমাদেরও শোনানো হয়।

ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণেই এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে ঘাটাঘাটি আমার দীর্ঘদিনের। সময়টায় সম্বল বলতে নিউইয়র্ক টাইমসের একটি পেপার কাটিং, যাতে অল্প কয়েক লাইনে বলা হয়েছে ৩০ হাজারের মতো দালালকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে কারাগারে থাকা গভর্ণর মালিক ও তার কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ। এত বড় একটা ঘটনা, এত বড় একটা সিদ্ধান্ত, এত বড় একটা ঘোষণা এর কোনো দলিল থাকবে না! খোঁজের পর খোঁজ, পরিচিত মুক্তিযুদ্ধ দলিল সংগ্রাহক কিংবা যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কাজ করাদের কাছে পাই না। এটা রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশ, সরকারী গ্যাজেটে থাকা উচিত। আইনজীবিদের কাছে বার্ষিক আইন কানুনের যে অমনিবাস থাকে, তাতে থাকা উচিত। পাই না। ’৭৩-৭৪ সালের অনেক কিছুই তাদের সংগ্রহে থাকে না। ফাইলপত্র গায়েব। দলিলপত্র গায়েব। সুপ্রীমকোর্টের একজন আইনজীবি সরাসরি অভিযুক্ত করলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। তিনি আত্মসমর্পনের স্মারক ঢাকতে যেমন শিশুপার্ক বানিয়েছেন, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের প্রসঙ্গে যাবতীয় কাগজপত্রকে ছাই বানানোর আদেশটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কার্যকর করেছেন। বার কাউন্সিল লাইব্রেরিতেও নেই।

আমার সম্বল বলতে অল্প ক’টি লাইন। বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন ঠিকই, কিন্তু খুনী, ধর্ষক, লুটেরাদের মাফ দেননি। কিন্তু প্রমাণ কি! এমন কথা যারা বলে তারাও দেয় না, যুদ্ধাপরাধী বলে যারা অভিযুক্ত এই সাধারণ ক্ষমার চাদর গায়ে চড়ায়- তারাও না। তাহলে কি! ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধূ এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রেসনোটটি ছাপা হওয়ার কথা তখনকার পত্রিকাগুলোয়। এবার সে খোঁজে লাগা। আর এখানেই ত্রাতা হয়ে আসে জিসান। প্রকাশনার প্রক্রিয়ায় থাকা দৈনিক অধিনায়কে যোগ দেওয়ার পর আমাকে কিছু মেধাবী ছেলেমেয়ে নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। আগামী একযুগে বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতিতে একটা বড় ভূমিকা রাখার যোগ্যতা এরা রাখে। জিসান তাদের একজন। এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পেপার ক্লিপ যোগাড় করতে আমি দুজনকে দায়িত্ব দিই। কবি অভিজিত দাস জাতীয় আর্কাইভে যাওয়ার পর তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অনুমতিপত্রের মুলো ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমিতে একই বাধার মুখে পড়ে জিসানও। তার আগে পিআইবিতে গিয়ে ব্যর্থ হতে হয় তাকে।
পরের গল্পটা স্পাই থ্রিলারকে হার মানায়। মেয়াদোত্তীর্ণ লাইব্রেরী কার্ড সম্বল করে জিসান ঢুকে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারের ভুতল আর্কাইভে। পরিচিত মামাদের ভরসায় বড় বড় মশার কামড় খেয়ে খুঁজে বার করে আরাধ্য সেই পত্রিকাগুলো। এর মধ্যে কয়েকজন ছাত্রনেতা তার এই অস্বাভাবিক তৎপরতায় আগ্রহী হয়, তার ইন্টারভিউ (পড়ুন জেরা) নেয়। নেতাদের নাম মুখস্ত করে তাদের কর্মজীবন সম্পর্কে আধারে থাকা এইসব মুরুব্বীরা অবশ্য জিসানের স্মার্টনেসের কাছে পাত্তা পায় না। সে বরং উল্টো তাদের ক্যামেরা ধরিয়ে দিতে চায় ছবি তোলায় সাহায্য করতে। কাঁপা হাতে জিসান ছবি তোলে, ভিডিও করে তার স্যামসাং মোবাইলে। ব্যাটারির আয়ু ফুরানোর আগে শেষ করে পুরোটা। এসে আমাকে ব্লু টুথে সেসব পাচার করার পর প্রতিশ্রুতি দেয়, পিয়াল ভাই আমাকে চারটা দিন দেন আরো, আমি প্রত্যেকটা লাইন লিখে নিয়ে আসবো।
ওকে আনন্দে জড়িয়ে ধরার প্রবল ইচ্ছাটা আমি সম্বরণ করি। চাপা উত্তেজনা নিয়ে আমি বাসায় ফিরি। এই ছবি আর ক্লিপ সম্বল করেই দেখি কতটা কি বের করা যায়। দুদিনের অপেক্ষা আমার সহ্য হয় না। ছবিগুলো ছোটো বড় করে বোঝার চেষ্টা করি অক্ষরগুলো, নিজেই লিখে ফেলি সবটুকু। ক্লিপগুলো ইউটিউবে আপলোড করার সিদ্ধান্তটা আগেই নেয়া। সেগুলো বাছাই, এরপর কনভার্টার ব্যবহার করে এভিআই ফাইল বানানো, ম্যুভি মেকারে আরেকটু স্লো করে, ব্রাইটনেস অ্যাডজাস্ট করে একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া। এসব কিছুই হতো না যদি না জিসান নামে ছেলেটা থাকতো। মুক্ত তথ্য প্রবাহের এই যুগে বাংলা ব্লগে ঐতিহাসিক একটি উপাত্ত উন্মোচনে ওর এই ভূমিকা আমি আজীবন কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করবো। এবার দেখা যাক কি আছে সাধারন ক্ষমা ঘোষণায়, কি লেখা হয়েছিলো এর ফলোআপ রিপোর্টগুলোতে, কারা কারা মুক্তি পেয়েছিলো।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রতিবেদন : দৈনিক বাংলা ১ ডিসেম্বর ১৯৭৩
শিরোনাম : দালাল আইনে আটক সাজাপ্রাপ্তদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা
উপ-শিরোনাম : দেশের কাজে আত্মনিয়োগের জন্য ক্ষমাপ্রাপ্তদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বান : ধর্ষণ ও হত্যাকারীদের ক্ষমা নেই
সরকার বাংলাদেশ দালাল আইনে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইবুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২ বলে যারা আটক হয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা অথবা হুলিয়া রয়েছে এবং যারা এই আইনে সাজা ভোগ করছেন তাদের সকলের প্রতিই এই সাধারণ ক্ষমা প্রযুক্ত হবে এবং তারা অবিলম্বে মুক্তিলাভ করবেন। তবে নরহত্যা, নারী ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ অথবা বিস্ফোরকের সাহায্যে ঘরবাড়ি ধ্বংস অথবা জলযান ধ্বংসের অভিযোগে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা প্রযুক্ত হবে না। গতকাল শুক্রবার রাতে প্রকাশিত এক সরকারী প্রেসনোটে এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কথা প্রকাশিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতরাতে বলেন, দলমত নির্বিশেষে সকলেই যাতে আমাদের মহান জাতীয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরে ঐক্যবদ্ধভাবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দেশ গড়ার শপথ নিতে পারে সরকার সেজন্য দালাল আইনে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ দালাল অধ্যাদেশে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যাতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর অনতিবিলম্বে জেল থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেন এবং আসন্ন ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় উৎসবে যোগ দিতে পারেন বঙ্গবন্ধু সেজন্য তাদের মুক্তি তরান্বিত করতে স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। সাধারণ ক্ষমায় যারা মুক্তি পাবেন তাদের বিজয় দিবসের উৎসবে একাত্ম হতে এবং দেশ গঠনের পবিত্র দায়িত্ব ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার শপথ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু তার সরকারের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের কথা ঘোষণা করতে গিয়ে বলেন, মুক্ত হয়ে দেশগঠনের পবিত্র দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ণ সুযোগ তারা গ্রহণ করবেন এবং তাদের অতীতের সকল তৎপরতা ও কার্যকলাপ ভুলে গিয়ে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন তিনি এটাই কামনা করেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, বহু রক্ত, ত্যাগ তিতিক্ষা আর চোখের পানির বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। যে কোনো মূল্যে এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এবারের বিজয় দিবস বাঙালীর ঘরে ঘরে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণের এক নতুন দিগন্ত উম্মোচিত করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিছু লোক দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলেন। পরে বাংলাদেশ দালাল আদেশ বলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে অনেকেই পরিচিত ব্যক্তি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দখলদার বাহিনীর সঙ্গে তাদের সহযোগিতার ফলে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশা নেমে এসেছিল।
বঙ্গবন্ধু বলেন, এসব লোক দীর্ঘদিন ধরে আটক রয়েছেন। তিনি মনে করেন এতদিনে তারা নিশ্চয়ই গভীরভাবে অনুতপ্ত। তারা নিশ্চয়ই তাদের অতীত কার্যকলাপের জন্য অনুশোচনায় রয়েছেন। তিনি আশা করেন তারা মুক্তিলাভের পর তাদের সকল অতীত কার্যকলাপ ভুলে গিয়ে দেশ গঠনের নতুন শপথ নিয়ে প্রকৃত দেশপ্রেমিকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।
গত ১৭ই জুলাই ২০১০ইং স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে নিম্নোক্ত প্রেসনোটটি ইস্যু করা হয়।
প্রেসনোটঃ
যারা ১৯৭২ সালের দালাল (বিশেষ ট্রাইবুনাল) আদেশ (পি.ও নং-৮, ১৯৭২ সালের) বলে আটক রয়েছেন অথবা সাজাভোগ করছেন তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের প্রশ্নটি সরকার আগেও বিবেচনা করে দেখেছেন। সরকার এ সম্পর্কে এখন নিম্নোক্ত ঘোষণা করছেন :
১. দুনম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত ব্যক্তিদের ও অপরাধ সমূহের ক্ষেত্র ছাড়া :
(ক) ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী দন্ডবিধি ৪০১ নং ধারা অনুযায়ী উল্লিখিত আদেশবলে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের রেহাই দেওয়া হচ্ছে এবং উল্লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোনো আইনবলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকলে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার অনতিবিলম্বে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হবে।
(খ) কোনো বিশেষ ট্রাইবুনালের সম্মুখে অথবা কোনো বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে উক্ত আদেশবলে বিচারাধীন সকল মামলা সংশ্লিষ্ঠ ট্রাইবুনাল ও ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে প্রত্যাহার করা হবে এবং উল্লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোনো আইনে তাদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন কোনো মামলা বা অভিযোগ না থাকলে তাদের হাজত থেকে মুক্তি দেওয়া হবে।
(গ) কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে উল্লিখিত আদেশবলে আনীত সকল মামলা ও তদন্ত তুলে নেওয়া হবে এবং উল্লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোনো আইনে বিচার বা দন্ডযোগ্য আইনে সে অভিযুক্ত না হলে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। উল্লিখিত আদেশবলে ইস্যু করা সকল গ্রেফতারী পরোয়ানা, হাজির হওয়ার নির্দেশ অথবা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে হুলিয়া কিংবা সম্পত্তি ক্রোকের নোটিশ দেয়া থাকলে তা প্রত্যাহার বলে বিবেচিত হবে এবং গ্রেফতারী পরোয়ানা অথবা হুলিয়ার বলে কোনো ব্যক্তি ইতিপূর্বে গ্রেফতার হয়ে হাজতে আটক থাকলে তাকে অনতিবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হবে। অবশ্য সে ব্যক্তি উল্লিখিত দালাল আদেশ ছাড়া কোনো বিচার বা দন্ডযোগ্য অপর কোনো আইনে তার বিরুদ্ধে যদি কোনো মামলা না থাকে তবেই।
যাদের অনুপস্থিতিতেই সাজা দেওয়া হয়েছে অথবা যাদের নামে হুলিয়া বা গ্রেফতারী পরোয়ানা ঝুলছে তারা যখন উপযুক্ত আদালতে হাজির হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা ও বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করবে কেবল তখনই তাদের বেলা ক্ষমা প্রযোজ্য হবে।
২. দন্ডবিধির ৩০২ নং ধারা (হত্যা), ৩০৪ নং ধারা, ৩৭৬ ধারা (ধর্ষণ), ৪৩৫ ধারা (গুলি অথবা বিস্ফোরক ব্যবহার করে ক্ষতিসাধন), ৪৩৬ ধারা (ঘর জ্বালানো) ও ৪৪৮ ধারায় (নৌযানে আগুন বা বিস্ফোরণ) অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্তগণ এক নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ক্ষমার আওতায় পড়বে না।
বাংলার বাণী কিংবা ইত্তেফাকের কথাবার্তাও মোটামুটি একইরকম যার নমুনা মিলবে ভিডিও ফুটেজে। দৈনিক বাংলার সেদিনের পাতাতেই আরেকটি চমকপ্রদ সংবাদ রয়েছে। জিয়া সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী হওয়া শাহ আজিজুর রহমান এবং এরশাদের কাছে স্বাধীনতা পদকে সম্মানিত শর্ষীনার পীর সাহেবের জেলমুক্তি নিয়ে খবরটি। লেখা হয়েছে : বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ আদেশে গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে অধুনালুপ্ত পিডিপির নেতা শাহ আজিজুর রহমান এবং শর্ষীনার পীর সাহেবকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। দখলদার বাহিনীর সাথে সহযোগিতার অপরাধে তাদের আটক করা হয়েছিলো। এনার খবরে একথা জানা গেছে। স্মর্তব্য শাহ আজিজুর রহমান পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর সমর্থনে জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। একটু খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে গভর্ণর মালেক ও শাহ আজিজের মতো হাইপ্রোফাইল দালালদের কাউকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে স্থানান্তর করা হয়নি। গ্রেফতারের পর থেকে তারা সেখানেই ছিলেন মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত। তাই জেল থেকে ডেকে এনে শাহ আজিজকে নিয়ে কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধুর খিচুড়ি খাওয়ার গল্পের মতো আজগুবী দাস্তান বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
৩ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে সাধারণ ক্ষমার ফলোআপ এসেছিলো যে সিদ্ধান্তটাকে সকল মহল স্বাগত জানিয়েছে। সেখানেই রয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল সেখানে দালাল আইনে আটকদের এবং মুক্তি পাওয়াদের বিষয়ে সাংবাদিকদের ক্ল্যারিফাই করেছেন। দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মোট সংখ্যা ৩৭ হাজার ৪শত ৭১ শিরোনামে ওই খবরে লেখা হয়েছে : সরকার কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এই আদেশের আওতাভুক্ত সকল ব্যক্তির মুক্তি ত্বরান্বিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়াছেন। গতকাল (শনিবার) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সহিত আলাপ-আলোচনাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুল মালেক উকিল এ কথা জানান। তিনি বলেন যে, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন আদেশের সহিত দালালি আইনে আটক ব্যক্তিদের তালিকা পরীক্ষা করার পর ইহার আওতাভুক্ত সকল ব্যক্তিকে মুক্তিদানের জন্য তিনি ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়াছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে, দালালি আইন অনুযায়ী মোট অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা হইতেছে ৩৭ হাজার ৪ শত ৭১ জন। ইহার মধ্যে চলতি বছর অক্টোবর মাস পর্যন্ত ২ হাজার ৮ শত ৪৮ জনের বিরুদ্ধে মামলার নিষ্পত্তি হইয়াছে। তন্মধ্যে ৭ শত ৫২ জনের সাজা হইয়াছে এবং বাকি ২ হাজার ৯৬ জন খালাস পাইয়াছেন। তিনি বলেন একটি সংবাদপত্রে দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের সংখ্যা ৮৬ হাজার বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। কিন্তু উহা সত্য নহে বরং অতিরঞ্জিত।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, আটককৃত বা সাজাপ্রাপ্ত অনেক প্রাক্তন নেতা এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় মুক্তি লাভ করিবেন। তিনি বলেন যে যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্ণর ডাঃ এ এম মালেক ও তাহার মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ শীঘ্রই মুক্তিলাভ করিবেন। অন্যদের মধ্যে যাহারা মুক্তি পাইবেন তাহাদের মধ্যে ডঃ কাজী দীন মোহাম্মদ, ডঃ হাসান জামান, ডঃ সাজ্জাদ হোসেন, ডঃ মোহর আলী (প্রত্যেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দালাল শিক্ষক) ও খান আবদুর সবুরও রহিয়াছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাহাদের সম্পত্তি ফেরত পাইবেন এবং দেশের নাগরিকদিগকে প্রদত্ত সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করিবেন। পাকিস্তান থেকে ফিরেই বঙ্গবন্ধু খান এ সবুরকে নিজে গাড়ি চালিয়ে জেল থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন বলে যে গল্পটা শুনেছিলাম সেটার নিষ্পত্তি হলো এই খবরে।
সবশেষে তুলে ধরছি সে বছর ১৫ ডিসেম্বর রেডিও টিভিতে সম্প্রচার হওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এ প্রসঙ্গে বলা অংশটুকু :
… বিপ্লবের পর স্বাধীনতার শত্রু হিসেবে যারা অভিযুক্ত হয়েছিলো তাদেরও আমরা হত্যা করিনি, ক্ষমা করেছি… আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী নই। তাই মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা করে যারা দালাল আইনে অভিযুক্ত ও দন্ডিত হয়েছিলেন তাদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে। দেশের নাগরিক হিসাবে স্বাভাবিক জীবন যাপনে আবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি অন্যের প্রচারণায় যারা বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং হিংসার পথ গ্রহণ করেছেন তারা অনুতপ্ত হলে তাদেরও দেশ গড়ার সংগ্রামে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষাপট হিসেবে অনেক বিষয়ই এসেছে। সেগুলো নিয়ে লেখালিখিও হয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়টি এখনও কারও লেখায় রেফারেন্স হিসাবে পাইনি। সে ঘাটতিটা এই পোস্ট মেটাতে পারলে পরিশ্রমটা সার্থক হবে আমার। আমার ব্যক্তিগত ধারণা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাটি প্রজ্ঞাপন আকারে দেওয়ার পর দালাল আইন অধ্যাদেশে খানিকটা মেরামতি করা হয়, যাকে সংশোধনী বলে। কিন্তু তারপরও এটি গেজেটে কেনো নেই, তা একটা ধাঁধা হয়েই থাকবে।
সূত্র : দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলার বাণী ও বাংলাদেশ অবজারভার
http://www.jonmojuddho.com/shadharon-khoma-bongobondhu/ 
^উপরে যেতে ক্লিক করুন