জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান



তিনি শুধুমাত্র একজন ব্যাক্তি নন। একটি প্রতিষ্ঠান। একটি আন্দোলন। একটি বিপ্লব। একটি অভ্যুত্থান। জাতি নির্মাণের কারিগর। মহাকাব্যের অমর গাঁথা এবং একটি ইতিহাস।
এই ইতিহাসের ব্যাপ্তি হাজার বছর। তাই সমকাল তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী হিসেবে। ভাবীকাল তাঁকে স্বীকৃতি দেবে মহাকালের মহানায়ক রুপে।

তিনিও ইতিহাসে অক্ষয় ধ্রুবতারার মত অম্লান গরিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবেন। বাঙালি জাতিকে পথ দেখাবেন। তাঁর স্বপ্ন বাঙালির অস্তিত্ব। তাঁর স্মৃতি বাঙালি জাতির আরাধ্য সমাজ ও সংস্কৃতি। যে সকল সম্ভাবনা এবং প্রতিশ্রুতি তিনি তুলে ধরেছিলেন তাই বাঙালি জাতি ও তাঁর সভ্যতার ফল্গুধারা।
জনগণের কাছে তিনি বন্ধু। জাতির কাছে তিনি পিতা। বিদেশিদের চোখে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা।তাঁর সম্পর্কে বিদেশী সাংবাদিক সিরিল ডান বলেন, “ বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, কৃষ্টিতে এবং জন্মসূত্রেও ছিলেন খাঁটি বাঙালি। তাঁর দীর্ঘ শালপ্রাংশু দেহ, বজ্রকণ্ঠ, মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার বাগ্মিতা এবং জনগণকে নেতৃত্বদানের আকর্ষণীয় ব্যাক্তিত্ব ও সাহস তাঁকে এ যুগের এক বিরল মহানায়কে রুপান্তর করেছে”। যুক্তরাষ্ট্রের “নিউজউইক” পত্রিকা বলেছে, “ শেখ মুজিব Poet of Politics- রাজনীতির কবি”। বিলেতের মানবতাবাদী আন্দোলনের প্রয়াত নেতা মনীষী লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে বলেছেন, “ জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, ডি ভ্যালেরার চেয়েও শেখ মুজিব এক অর্থে বড় নেতা”। নতুন মিশরের শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক হাসনাইন হাইকেল বলেছেন, “নাসের কেবল মিশরের নন, সারা আরব জাতির মুক্তি দূত। তাঁর আরব জাতীয়তাবাদ আরব জনগণের শ্রেষ্ঠ মুক্তি-প্রেরনা। তেমনি শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নন, বাঙালি জাতির মুক্তিদূত। তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালির সভ্যতা ও সংস্কৃতির নব অভ্যুদয় মন্ত্র”। মুজিব বাঙালির অতীত ও বর্তমানের শ্রেষ্ঠ মহানায়ক। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ারসে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, “আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি। শেখ মুজিব কে দেখলাম। ব্যাক্তিত্ব ও সাহসে মানুষটি হিমালয়। আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম”। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইলসন লন্ডনের এক বাঙালি সাংবাদিকের কাছে লেখা শোকবাণী তে বলেন, “ এটা আপনাদের কাছে অবশ্যই এক বিরাত ন্যাশনাল ট্রাজেডি। আমার কাছে এটা পরম শোকাবহ পার্সোনাল ট্রাজেডি”।
আসলে জাতির পিতা বলতে এখানে নেশন ষ্টেট এর প্রতিষ্ঠাতাকে বুঝানো হয়েছে। আধুনিক ইউরোপের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চেতনার ফসল আধুনিক জাতীয়তা ও জাতীয় রাষ্ট্র। এই আধুনিক নেশন ও নেশন স্টেটের প্রতিষ্ঠার যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, জাতি তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে পিতা ও রাষ্ট্র নির্মাতার সুউচ্চ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। এজন্য কামাল আতাতুর্ক নব্যতুরস্কের জনক, মহাত্না গান্ধী নতুন ভারতের পিতা, শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মডার্ন নেশন স্টেটের নির্মাতা এবং বাঙালি জাতির জনক।
কামাল আতাতুর্ক এবং গান্ধীর চেয়েও শেখ মুজিব আরও বেশি সার্থকভাবে জাতির পিতার মর্যাদার অধিকারী। ওসমানিয়া বা অটোম্যান সাম্রাজ্যের আমলেও তুর্কি জাতির নাম ও অস্তিত্ব বহাল ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধে অটোম্যান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার পর কামাল পাশা সেই সাম্রাজ্যের শেশ ভগ্নাবশেষ তুরস্ককে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক নেশন ষ্টেট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। গান্ধীর আগে এবং তাঁর আমলেও ভারত তার নাম এবং জাতিত্বের পরিচয় হারায় নি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর বাংলাদেশ ও বাঙালির নামটি মুছে দেয়া হয়েছিল। নতুন পাকিস্তানি শাসকেরা তাদের সংবিধানেই বাংলাদেশের নামটি দেন পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হাজার বছরের জাতিত্বের পরিচয় মুছে দিয়ে তাদের কপালে সেটে দেয়া হয় একমাত্র পরিচয় “পাকিস্তানি”। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বলা এবং এই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বাঙালি হিসেবে আত্মপরিচয় দেয়াও ছিল দেশদ্রোহিতামূলক দণ্ডযোগ্য অপরাধ।
বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার এই নব্য উপনিবেশবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধেও প্রথম সাহসের সঙ্গে প্রতিবাদ জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৫ সালের ২৫শে আগস্ট তারিখ পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি বলেন, “ স্পীকার মহোদয়, ওরা পূর্ব বাংলার নাম বদল করে পূর্ব পাকিস্তান রাখতে চায়। আমরা বারংবার দাবি জানাচ্ছি, আপ্নারা বাংলা নাম ব্যাবহার করুন। বাংলা নামের ইতিহাস আছে। আছে নিজস্ব ঐতিহ্য- ট্র্যাডিশন। এই নাম পরিবর্তন করতে হলে বাংলার জনগণের কাছে আগে জিজ্ঞেস করতে হবে, তারা এই নামবদল মানতে রাজি আছে কিনা?”
শেখ মুজিবের এই সুস্পষ্ট প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে এবং বাংলাদেশের জনগণের কোন মতামত না নিয়ে পাকিস্তানি শাসকরা বাংলা নামকে মুছে দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটি চাপিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে শেখ মুজিব কারান্তল থেকে বেরিয়ে এসে বাঙ্গালির কপাল থেকে এই দাসত্বমুলক পরিচয় মুছে ফেলার পদক্ষেপ নেন। এ বছর ৫ ডিসেম্বর তারিখে তিনি ঘোষণা করেন, “একসময় এদেশ থেকে, এদেশের মানচিত্র থেকে ‘বাংলা’ কথাটার সর্বশেষ চিহ্নও চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। শুধু বঙ্গোপসাগর আর কোথাও নামটির চিহ্ন খুজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের নাম পূর্ব পাকিস্তানের বদলে শুধু বাংলাদেশ হবে।”
প্রকৃতপক্ষে এক ক্রান্তিলগ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের নবজন্মের প্রথম প্রকাশ্য ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকেই উচ্চারিত হয়। এটা বাংলাদেশ ও বাঙ্গালি জাতির নব অভ্যুদয়েরও ঘোষণা। বাঙ্গালির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবরুদ্ধ স্রোতেরও মুক্তিলাভের ঘোষণা। বাংলাদেশ ও বাঙালি এই দুটি লুপ্ত নামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা যার হাতে, বাঙ্গালির নিজস্ব দেশ প্রতিষ্ঠা যাঁর দীর্ঘ চব্বিশ বছরের আন্দোলন ও সংগ্রামের ফল তাঁকে বাঙালি জাতির জনক, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাতা-পিতা ছাড়া আর কি যোগ্য নামে ডাকা যায়।
শেখ মুজিবের বিপ্লব শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের বিপ্লব নয়। বাঙ্গালির আধুনিক ও গণতান্ত্রিক ন্যাশন-স্টেট প্রতিষ্ঠার পর তিনি দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং শোষিতের মুক্তির লক্ষ্যে তাঁর দুঃসাহসী দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন। এখন অনেকেই স্বীকার করেন গান্ধী ছিলেন অহিংস, অসহযোগ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের স্রষ্টা। কিন্তু তাকে সফলভাবে প্রয়োগ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন শেখ মুজিব। তাঁর রাজনৈতিক রণনীতি ও কৌশল ছিল বাংলার সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার সংগ্রাম। নীলচাষ বিদ্রোহ ও প্রজা আন্দোলনের ধারা, গান্ধীজির সত্যাগ্রহের প্রেরণা, সুভাষচন্দ্র বসুর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অসাম্প্রদায়িকতা, শেরে বাংলা ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তাঁর রাজনৈতিক চরিত্র গঠন করেছে। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে নেমে তিনি হয়েছেন সমাজবাদী। পশ্চিমা গনতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি চেয়েছিলেন শোষিতের গনতন্ত্রের বাস্তবায়ন। জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তির ওপর যে অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে তাকে তিনি মুক্ত সমাজবাদী চেতনা ও কর্মসূচীর সঙ্গে মেলাতে চেয়েছিলেন। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ যেন হয় বাংলাদেশের সকল ধর্মের, সকল অঞ্চলের, সকল মানুষের মিলন মোহন, বাংলা ভাষা যেন হয় বিশ্বসভায় বাঙ্গালির সভ্যতার শ্রেষ্ঠ পরিচয়, এই স্বপ্ন সাধনা নিয়েই গড়ে উঠেছে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন। তাই জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে তিনিই সর্বপ্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। জাতিসংঘের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করেছেন বাংলা ভাষার। রবীন্দ্রনাথের নোবেল সাহিত্য পুরষ্কার লাভের পর এটাই বাংলা ভাষার আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
এই শতকের স্রাম্রাজ্যবাদ - বিরোধী ও নব্য উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে গান্ধী, টিটো নাসের সুকণ, লুম্বুবা নক্রুমার নামের পাশাপাশি শেখ মুজিব নামটি ও সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি তার স্বপ্ন সাধনা, সংগ্রামের মধ্যেই আত্মাহুতি দিয়েছেন। নিজের বুকের রক্তে, নিজের স্বজন-পরিজনের রক্তে তিনি বাংলার নতুন ইতিহাস লিখে রেখে গেছেন স্বাধীন বাংলার নতুন প্রজন্মের জন্যে। তিনি আজ বাংলার জাতীয় পতাকার নতুন রক্তসূয্য।বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধু এই দুটি নাম আজ অভিন্ন। বাংলার স্বাধীনতা, ভাষা, সমাজ সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু চিরকালের জন্য চিরজাগ্রত। তাঁর মৃত্যু হয়নি। তিনি মৃত্যুঞ্জয়।
বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ কীতি। তিনি তো আবহবান বাংলার চিরকালের প্রাণপ্রবাহ। বাংলার পাখির গানে, নদীর কলতানে, বাতাসের উচ্ছাসে, আকাশের গরিমায়, সূর্যের শৌর্যে, চাঁদের কিরণে, নক্ষত্রের ছায়াপথে, ভোরের শিশির, মসজিদের আযানে, মন্দিরের কাঁসরধ্বনিতে, গির্যার ঘন্টায়, জারি সারি শরতের শ্যামলিমায়, বৈশাখের ভৈরবীতে, বাঙালির হাঁসি-কান্না, প্রেম-ভালবাসা, মিলনের বিরহে তিনি চিরদিনের জন্য চিরকালের জন্য জাগ্রত, জীবন্ত। তিনি আরও বেশী জীবিত চিরকালের বাঙালির মনে ও মননে।
তাঁর বিচিত্র বর্ণাঢ্য জীবনের ছবি ভাষায়, রঙে বা আলোকচিত্রে সম্পূণভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। কারণ তোমার কৃর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ।’’ এই মহত্ত্বের কোন ছবি তোলা যায় না। জাতীয় চেতনার বিশাল উপলব্ধিতে তাঁর অবস্থান। তবু কেউ ভাষায়, কেউ রঙে, কেউ ছবিতে-মহামানুষের, মহানায়কের স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করেন। এই অ্যালবাম টিও বাংলার মহানায়কের স্মৃতি ধরে রাখার এমনি এক প্রচেষ্টা। বতমান ও ভাবী প্রজন্মের বাঙালির কাছে হবে এই অ্যালবাম বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কম সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত। মৃত্যুর তুচ্ছতা অতিক্রম করে যে মহানায়ক নিজের স্বপ্ন ও সংগ্রামের আলোকে আজ আলোকিত,তাঁর সেই আলোকেই আমরা ভবিষ্যতের পথ চিনে নিতে চাই। তিনি আমাদের মুক্তিদাতা। আজকের এবং আগামী দিনের ও তাঁর আদর্শের উত্তরাধিকার বাঙালির সবচেয়ে বড় সম্পদ ও পাথেয়।
তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী,তাঁর স্মৃতি অক্ষয় ও অমর।
আবদুল গাফফার চৌধুরী
^উপরে যেতে ক্লিক করুন