১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন তারা। সামরিক জান্তাদের জারি করা ১৪৪ ধারা, কাঁদুনে গ্যাস আর এলোপাথারি বুলেট- কোনটাই আটকাতে পারেনি বাঙালির অদম্য মাতৃভাষার বাসনা।
মায়ের ভাষার কথা বলা, গল্প করা, মাতৃবুলিতে সহজিয়া স্বতঃস্ফূর্ত জীবন এবং নিশ্চিত জীবিকার অধিকার কেড়ে নেয়ার প্রতিবাদে পাকিস্তানী হানাদারদের সর্বোচ্চ হায়েনা থাবা অতিক্রম করে সেদিন ঝলমলে দিনের আলোয় পিচঢালা সড়কে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে অচেতনে-অবচেতনে স্বাধীনতার সূর্যবীজই বপন করেছেন সালাম, বরকত. রফিক, জব্বার ও শফিউর সহ আরো অনেকে ছিলেন যারা। বাঙালির প্রথম জাতীয়তাবাদী অনুভব এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এই ভাষা আন্দোলনকে। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগষ্ট রাতের অন্ধকারে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরপরেই মূলত শুরু হয়ে যায় ভাষার ও সংস্কৃতির রাজনীতি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেকে আবিস্কার করলেন যে একরাতের মধ্যেই পৃথক করে দেয়া হয়েছে তাদের দেশ ও জাতীয়তাবোধ। এরপরেই তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকর্মীরা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলনের নতুন কর্মধারা নির্ধারণের জন্য ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং কলকাতায় অধ্যয়নরত পূর্বপাকিস্তানের শিক্ষার্থীরা কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে একাধিক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁরা ঢাকায় এসে তৎকালীন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদ সহ তাদের অন্যান্য নেতাকর্মীদের সাথে আলোচনায় বসেন। দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরেই এটাই ছিল ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার প্রথম প্রচেষ্টা।
এ প্রচেষ্টার মাধ্যমে, তৎকালীন পূর্ববাংলার নতুন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মকা- এবং নীতিনির্ধারণের জন্য একটি সম্মেলন করার ব্যাপারে একমত হন সবাই। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে খুব দ্রুতই, ২৪ আগষ্ট রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ হয়। তারুণ্যের গতিশীল নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার ফল হিসেবে ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ সম্মেলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় গণতান্ত্রিক যুবলীগ- এটিই ছিল তৎকালীন পূর্ববাংলায় আন্দোলনের গুণগত পরিবর্তনের শুভ সূচনার প্রথম ইঙ্গিত।
অন্যদিকে পিছিয়ে ছিল না ঢাকার ছাত্রসংগঠনগুলোও। ১৪ আগষ্টের পটভূমি পরিবর্তনের পর ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে তৎকালীন প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠন ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ এর একটি অংশের বিতর্কিত অবস্থানের প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকার প্রগতিশীল ছাত্ররা নতুন অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন গঠনের উদ্যোগ নেয়। ৩১ আগষ্ট ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের নিয়ে একটি সভা আয়োজন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে। পাকিস্তান সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী নূরুল আমিনের নির্দেশে সেদিন বেসরকারী পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ট্রাকে করে ভাড়াটিয়া গুন্ডা পাঠিয়ে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী অনুভবে অনুপ্রাণিত’ সভাটি পণ্ড করার চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনার পর আরো অদম্য হয়ে ওঠে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় জেগে ওঠা নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দিকে ধাবমান ছাত্রনেতাকর্মীদের প্রগতিশীল অংশটি। ভিতরে ভিতরে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে থাকে তারা।
এর ভিতরেই বাংলা ভাষার অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়ার পাকিস্তানী ষড়যন্ত্র এগিয়ে যায় আরো একধাপ। পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মের মাত্র তিন মাসের মাথায় তৎকালীন রাজধানী করাচীতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে পাকিস্তান সরকার। যদিও পাকিস্তানের কোন অংশেরই প্রধান ভাষা ছিল না উর্দু। পাঞ্জাবি ১৮ শতাংশ, পশতু ও উর্দু ৭ শতাংশ, সিন্ধি ৫ শতাংশ এবং ৫৪ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি ভাষাভাষির সবগুলোর চাইতেও বেশী সংখ্যক মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার প্রস্তাবের সংবাদটি ৬ ডিসেম্বরের পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তীব্র ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ সহ ঢাকাস্থ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সরকারের সাথে আঁতাত করা ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ ভেঙ্গে নতুন প্রগতিশীল সংগঠনের দিকে ধাবমান ছাত্রদের অংশটি অনানুষ্ঠানিকভাবেই তাদের সাংগঠনিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে গতিশীল করে তোলে আপামর ছাত্র-জনতার এ বিক্ষোভকে। তৎকালীর প্রাদেশিক মন্ত্রী নূরুল আমিন ও প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবন এবং সাচিবালয়ের সামনে মিছিল সমাবেশ ও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা।
এদিকে ভাষা ও সংস্কৃতির উপর পাকিস্তানী আগ্রাসন রোধে এবং জাতীয়তাবাদী আত্মমর্যাদাবোধের চেতনা থেকেই একটি গতিশীল আন্দোলন চালিয়ে যাবার প্রত্যয় নিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও দেশাত্ববোধের মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত তরুণ-যুবা’রা ভাষার প্রশ্নে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ এর ন্যাক্কারজনক ভূমিকাকে ধিক্কার জানিয়ে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করে। ছাত্র রাজনীতি থেকে প্রায় বিদায় নেয়া ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে নতুন আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে পুর্নগঠিত হয় ছাত্রলীগ। ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতিগত অস্তিত্বের প্রশ্নে ছাত্রলীগের বিদ্রোহাত্মক কর্মকা-ই ‘বিপরীত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের কিন্তু ধর্মীয় বিষবাষ্পের মেঘের ভেলায় ভাসতে থাকা’ নবীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রথম বিরোধদলীয় কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটায়। ভাষার প্রশ্নে উত্তাল ঢেউয়ে ফুঁসতে থাকে বাঙালি জাতি এবং বাংলা।
পাকিস্তানের জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয় ভাষার দাবিটি। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ববাংলার অন্যতম প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাধ দত্ত ‘উর্দু-ইংরেজির সাথে বাংলাকেও’ গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি জানান। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান প্রস্তাবটিকে ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেন এবং পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন বাংলা নয় বরং উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবি জানান। এ ঘোষণার পর উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়। আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলাকে প্রাদেশিক সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। এবং পরবর্তীতে ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সাথে সাথে প্রতিবাদ করে ওঠেন উপস্থিত শিক্ষার্থীরা। ভয়ে কুঞ্চিত হয়ে পড়ে জিন্নাহ।
মজার ব্যাপার হলো তৎকালীন পাকিস্তানের কোথাও ফারসি ভাষাভাষির অস্তিত্ব না থাকলেও ফারসি ভাষায় জাতীয় সংগীত ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’ গাইতে অভ্যস্ত পাকিস্তানী শাসকরা ‘ভাষার জন্য’ বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত উত্তাল গর্জন দেখে ভয় না পেয়েই পারে না। বাকি ইতিহাস আমাদের সবার জানা। প্রথমে ভাষা, তারপর স্বাধিকারের আন্দোলন এবং অবশেষে রক্তার্জিত স্বাধীনতা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং উত্থান পর্ব থেকে শুরু করে চূড়ান্তভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে একটি জাতির স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দেখিয়েছেন যিনি, তিনি একজন তুখোর ছাত্রনেতা থেকে ঐতিহাসিক বিশ্বনেতা- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনি আমাদের জাতির পিতা, মাতৃভাষার স্বপ্ন দেখানোর শুরুর পথ থেকে স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ পর্যন্ত তীব্র স্রোত হয়ে বেয়নেট-বুলেট-গারদের সব বাঁধা ভেঙ্গে মুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন বাঙালি জাতিকে।