- প্রকাশ করা হয়েছে মঙ্গলবার, 18 মার্চ 2014 12:15
কৃষির নিরন্তর সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একটি দীর্ঘ সময় নানাবিধ বাধা বিপত্তির কারণে আমরা কৃষি খাতে তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারি নি। ১৯৯৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্যা কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম এদেশের কৃষক তথা কৃষি খাতের উন্নতির জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল “একটি বাড়ি, একটি খামার” প্রকল্প।
কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগেই সরকার পরিবর্তিত হয়ে যায়। নতুন সরকার এসে এই উন্নয়নমূলক প্রকল্পটির কাজ বন্ধ করে রাখে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রকল্পটি আবার পুনরুজ্জীবিত করা হয়। গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান সরকার ঘোষিত “দিন বদলের সনদ” বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন অন্যতম। ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ অঙ্গীকারের আলোকে বর্তমান সরকার মানব শক্তির সর্বোত্তম ব্যাবহার তথা জীবিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে “একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প” বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
কেন এই প্রকল্পঃ
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু একথা সত্য যে এখনও বাংলাদেশের শতকরা ২৬ জন মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। এজন্য বাংলাদেশের যেকোনো উন্নয়নমূলক প্রকল্পে দারিদ্র দূরীকরণ সর্বাগ্রে প্রাধান্য পায়। অপরদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও সরকার গঠনের পর আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে এদেশের দারিদ্র দূরীকরণকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছে। আমরা আগেই বলেছি এদেশের অর্থনীতির মুল চালিকা শক্তি কৃষি তথা আমাদের গ্রাম বাংলার কৃষকেরা। তাই আমাদের গ্রাম বাংলার মানুষেরা যাতে তাদের কৃষি কাজের পাশাপাশি তাদের বাড়ি থেকেই তাদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করতে পারে এবং আরও কিছু উপার্জনের মাধ্যমে দারিদ্র্যের দুষ্ট শেকল ভেঙ্গে বের হয়ে আসতে পারে, সে জন্যই সরকার এই প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
এই প্রকল্প টি গ্রামীণ সমাজকে শারীরিক ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে তাদের আত্মকর্মসংস্থানের পথ সুগম করেছে। এছাড়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে যে গ্রাম সমিতিগুলো গঠিত হয়েছে সেগুলো গ্রামের দরিদ্র মহিলাদের কর্মসংস্থানেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সর্বপরি এই প্রকল্পটির মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামঞ্চলের একটি বিরাট সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী আত্মকর্মসংস্থানের ধারায় এসেছে। এবং এর মাধ্যমে গ্রামীণ দারিদ্র অনেকাংশেই দূর হয়েছে।
অভীষ্ঠ জনগোষ্ঠীঃ
প্রকল্প এলাকাতে নিম্নে বর্ণীত মাপকাঠির ভিত্তিতে প্রকল্পটির জন্য অভীষ্ঠ জনগোষ্ঠী নির্ধারণ করা হয়ে থাকেঃ
১। গ্রামের যে সকল পরিবারের প্রধান হচ্ছেন একজন দরিদ্র মহিলা
২। যে সকল পরিবারের শুধুমাত্র একটি ঘর রয়েছে।
৩। যে সকল পরিবারের জমির পরিমান .৫০ একরের কম (তাদের বাড়ি সহ), কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় এবং যাদের উপার্জন অনিয়মিত।
৪। যে সকল দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের কৃষি জমির পরিমাণ ২.৫০ একরের কম।
এক নজরে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প (জুলাই ২০১৩ পর্যন্ত) :
একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প জুলাই ২০০৯ থেকে জুন ২০১৪ মেয়াদ পর্যন্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১০।১১।২০০৯ তারিখে একনেক কতৃক অনুমোদিত হয় এবং প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১১৯৭ কোটি টাঁকা। প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের ৪৮২ টি উপজেলার ১৯২৮ টি ইউনিয়নের ৯৬৪০ টি গ্রামের ৫,৭৮,৪০০ টি পরিবারের জীবিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করা হয়।
প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ে ২০১০ সালের জুন থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত গ্রাম সমিতি গঠন করা হয়েছে ১৭ হাজার ৩০০টি।যাতে উপকারভোগী পরিবারের সংখ্যা ১০ লাখ ৩৮ হাজার।আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ প্রকল্পে উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ৫১ লাখ।সমিতির প্রতিটিতে সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০ জন এবং সর্বনিম্ন ৪০ জন।৬০ সদস্যের সমিতি থেকে কয়েকজনকে নিয়ে গ্রুপ করা হয়।প্রতিটি গ্রুপ নিজেদের সুবিধা বা পছন্দ অনুযায়ী এবং যে এলাকায় যে ধরনের জীবিকা গ্রহণ করা সম্ভব সেটা করতে পারেন।এক্ষেত্রে হাঁস-মুরগির খামার, মৎস্য চাষ, দুগ্ধ উৎপাদন, মৌমাছি পালন, শস্য উৎপাদন, বনায়ন, উদ্যান সৃজনসহ নানা ক্ষুদ্রশিল্প রয়েছে।কর্মকর্তারা জানান, সমিতিগুলোতে সদস্যরা নিজেরা যে সঞ্চয় করেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে ঠিক সমপরিমাণ অর্থ সমিতিগুলোতে জমা দিয়ে তহবিল করা হয়েছে।একই সঙ্গে সরকার ঘূর্ণায়মান ঋণ হিসেবে সমপরিমাণ টাকা দিয়েছে প্রতিটি সমিতিকে।এ হিসাবে 'একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে'র আওতায় সমিতিগুলোতে এখন পর্যন্ত সঞ্চয় জমা হয়েছে ৩৫৫ কোটি টাকা।আবার সরকারের পক্ষ থেকে আরও ৩৫৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে সমিতিগুলোকে।আর ঘূর্ণায়মান ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে ৪৯০ কোটি টাকা।সব মিলিয়ে বর্তমানে প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র মানুষের মোট তহবিলের পরিমাণ এক হাজার ৩৩২ কোটি টাকা।গ্রামে গ্রামে জীবিকাভিত্তিক ক্ষুদ্র খামার গড়ে উঠেছে ছয় লাখ ৮০ হাজারটি।প্রকল্পের আওতায় গত এক বছরে দরিদ্র পরিবারপ্রতি আয় বেড়েছে ১০ হাজার ৯২১ টাকা করে।প্রকল্প এলাকায় নিম্ন আয়ের পরিবারের সংখ্যা ১৫ শতাংশ থেকে তিন শতাংশে নেমে এসেছে।দারিদ্র্য হ্রাসের পাশাপাশি অধিক আয়ের পরিবারের সংখ্যা আগের চেয়ে ২২ দশমিক আট শতাংশ থেকে ৩১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় পর্যায়ে জুলাই-২০১৩ থেকে জুন ২০১৫ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় মোট ৪০ হাজার ৫২৭টি গ্রাম সমিতি গঠন করা হবে।এ হিসাবে এখন নতুন সমিতি গঠনের লক্ষ্য হচ্ছে ২৩ হাজার ২২৭টি।আগামী দুই বছরে মোট ২৪ লাখ ২৬ হাজার ৩৪০টি পরিবারকে প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসার কাজ চলছে।যাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকারভোগীর সংখ্যা হবে এক কোটি ২১ লাখ।দুই বছরে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৭০০ ব্যক্তিকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।প্রকল্পের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হলে অর্থাৎ ২০১৫ সালে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিজস্ব তহবিল দাঁড়াবে তিন হাজার ১২৬ কোটি টাকায়।যা বর্তমানে এক হাজার ৩৩২ কোটি টাকা।
শতভাগ সাফল্য:
বর্ণিত লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য এ পর্যন্ত প্রকল্প অফিস, বি আর ডি বি এবং মাঠ প্রশাসন আন্তরিকভাবে কাজ করে আসছে। সর্বোপরি পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় বিভাগ হতে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে যার ফলে প্রকল্পের কাজে শতভাগ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে যা নিম্নরুপঃ
১। গ্রাম সমিতি গঠিত হয়েছে ১৭,০০০ যা লক্ষ্যমাত্রার ৯৯ %
২। উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়েছে ১০,৩৮০০০ ( ৯৯ %)
৩। প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে ১,০৪,২৯৪ জনের (৯৯%)
৪। সদস্যদের নিজস্ব সঞ্চয় ২৬২ কোটি টাকার বিপরীতে উৎসাহ ঋণ প্রদান করা হয়েছে ২৬২ কোটি টাকা।
৫। সমিতি প্রতি প্রশিক্ষনত্তর সহায়তা বিতরণ ২৯২ কোটি টাকা।
এদেশের গ্রামীণ জনশক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার বদ্ধপরিকর। আর এজন্যই “একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্প”। কিন্তু শুধু সরকারই না, এজন্য দরকার আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। তাতেই সমৃদ্ধ হবে বাংলার কৃষিভান্ডার। নতুনভাবে প্রাণ পাবে চিরায়ত বাংলার কৃষি। আমাদের কৃষির জয়তানে বিশ্ব থমকে যাবে, নতুন করে চিনবে কৃষি প্রধান বাংলাদেশকে।