আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে নতুন সিল্ক রুটঃ গঠিত হচ্ছে আঞ্চলিক ইকনোমিক করিডর


বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার নিয়ে গঠিত হচ্ছে আঞ্চলিক ইকোনমিক করিডর। আর এ করিডর গঠিত হলে বাংলাদেশ বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পাবে। এতে করিডরে অংশগ্রহণকারী চারটি দেশের মধ্যে বছরে ৪৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। আর ওই বাণিজ্য বৃদ্ধি থেকেই বাংলাদেশ সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পাবে।

চারটি দেশের মধ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার (বিসিআইএম) ফোরাম নিয়ে আলোচনা চলছে। ইতোমধ্যে এ ফোরাম গঠনে আগ্রহী চার দেশের মধ্যে প্রথম সরকারী পর্যায়ের বৈঠক গত ২১ ডিসেম্বর চীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশের রাজধানী কুনমিং থেকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ হয়ে ভারতের কলকাতা পর্যন্ত একটি অর্থনৈতিক করিডর গঠনের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ করিডরটি হবে একটি ‘মাল্টি মডেল কানেকটিভিটি।’ এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে- বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তার আগে ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর বিসিআইএম জয়েন্ট স্টাডি গ্রুপের প্রথম বৈঠক চীনে অনুষ্ঠিত হয়। স্টাডি গ্রুপের প্রথম বৈঠকে ধাপে ধাপে চার দেশের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক করিডর স্থাপনের কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষরের ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়। স্টাডি গ্রুপের পরবর্তী বৈঠক আগামী জুনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে।
বিসিআইএমের সূত্রপাত ॥ বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে চার জাতির উপ-আঞ্চলিক কানেকটিভিটি সম্ভব কিনা, তা যাচাইয়ের জন্য ২০১৩ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি মোটর শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে চার দেশের মোটর শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন।
বিসিআইএম অঞ্চলে ১২ দিনের এ শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিই শুধু নয়, জনগণের পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধিও অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল। এ বছর চীন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী ও বেজিং সফরেও এ ফোরামের বিষয়ে আলোচনা হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে চীন সব দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি খসড়া প্রস্তাব পাঠায়। তাতে সব দেশই সমর্থন প্রদান করে। বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও ওই খসড়ার ওপর ইতিবাচক মতামত প্রদান করে। পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও নীতিগত সমর্থন দেয়।
বিসিআইএম করিডর ॥ ২০১৩ সালের মে মাসে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কে চিয়াং ভারত সফরে এসে ‘বিসিআইএম’ করিডর চালুর প্রস্তাব দেন। ভারত সরকার এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। ওই সফর শেষে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াঙ্গ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং গত ২০ মে দিল্লীতে একটি যৌথ বিবৃতি দেন। এ যুক্ত বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, বিসিআইএম আঞ্চলিক ফোরামে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তাতে উভয় নেতা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে বিসিআইএম মোটর শোভাযাত্রা সফলভাবে সম্পাদিত হওয়ায় উৎসাহিত হয়ে বিসিআইএম অঞ্চলে নিবিড় অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং জনগণের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে একটি যৌথ সমীক্ষা দল গঠনের মাধ্যমে বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের অক্টোবরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের চীন সফরকালে বাংলাদেশ, ভারত ও চীন এই অর্থনৈতিক করিডর বিষয়ের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। মূলত চীনে ত্রিদেশীয় ওই বৈঠকে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক করিডরের বিষয়টি এগিয়ে নিতে জোরালোভাবে আলোচনা করার বিষয়ে একমত প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে একটি সমীক্ষা পরিচালনায় একমত হয় চীন ও ভারত। এ অঞ্চলের দুই বড় দেশ চীন ও ভারত সমীক্ষা করার বিষয়ে একমত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও ঘোষণা করে যে, এ অর্থনৈতিক করিডর গড়ে তোলার সমীক্ষায় ঢাকা সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে। মিয়ানমারও এ প্রক্রিয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছে।
বিসিআইএম নিয়ে স্টাডি ॥ এশিয়া প্যাসিফিক রিসার্চ এ্যান্ড ট্রেনিং নেটওয়ার্ক অন ট্রেড বিসিআইএম নিয়ে সম্প্রতি একটি স্টাডি করেছে। ওই স্টাডির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিসিআইএম হলে কোন্ দেশ কী সুবিধা পাবে, তা খুঁজে বের করা। ওই স্টাডিতে দেখা যাচ্ছে চারটি দেশের মধ্যে যদি বাণিজ্য নীতি আংশিক উদারীকরণ করা হয়, তাহলে সর্বনিম্ন ৩ হাজার ১২০ কোটি টাকার শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করতে পারবে বাংলাদেশ। আর সর্বোচ্চ সুবিধা পাবে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার। এ ছাড়া সব মিলিয়ে এই চার দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
এশিয়া প্যাসিফিক রিসার্চ এ্যান্ড ট্রেনিং নেটওয়ার্ক অন ট্রেডের সমীক্ষায় দেখা যায়, বিসিআইএম হলে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে ৫৭০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য অবশ্য সব দেশের বাণিজ্য নীতি উদারীকরণ করতে হবে। পাশাপাশি বাণিজ্য নীতি পরিমিত উদারীকরণ হলে বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে ৪১০ কোটি মার্কিন ডলার এবং আংশিক উদারীকরণ হলে বাণিজ্য বাড়বে ২৭০ কোটি ডলার। ওই স্টাডিতে বলা হয়, বিসিআইএম হলে বিসিআইএমের বাইরে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য তৈরি হবে সর্বোচ্চ ৩৮০ কোটি মার্কিন ডলার এবং সর্বনিম্ন ১৮০ কোটি ডলারের। পাশাপাশি বাণিজ্য বিকেন্দ্রীকরণ বা বহুকরণ হবে সর্বোচ্চ ১৮০ কোটি ডলার এবং সর্বনিম্ন ৯০ কোটি ডলার। বিসিআইএমের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার ফ্রি ট্রেড এ্যাগ্রিমেন্ট অতিরিক্ত যুক্ত হলে এবং সঙ্গে চীন ও মিয়ানমার থাকলে এই বাণিজ্য ১২০০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছবে। তবে বাণিজ্য নীতি পরিমিত উদারীকরণ হলে বাণিজ্য বাড়বে ৯০০ কোটি ডলারে।
বিসিআইএমে অন্তর্ভুক্ত হলে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৭০ কোটি মার্কিন ডলার এবং সর্বনিম্ন ৪০ কোটি ডলারের শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে। তবে বলা হয়, যে দেশের অর্থনীতির আকার বড় ওই দেশ এই শুল্ক সুবিধা বেশি ভোগ করতে পারবে। সে হিসাবে ভারত সর্বোচ্চ ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে ৩৬০ কোটি ডলারের শুল্কমুক্ত সুবিধার বাণিজ্য করতে পারবে। চীন শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা নিতে পারবে ৬০ কোটি ডলার থেকে ১২০ কোটি ডলার এবং মিয়ানমার ভোগ করতে পারবে ৩০ লাখ থেকে ১০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত।
বাংলাদেশ বিসিআইএমে সম্পৃক্ততার পর যে বাণিজ্য সুবিধা পাবে বিপরীতে যা রাজস্ব আয় কমবে উভয় মিলে সমান থাকবে। ফলে বাংলাদেশের কোন রাজস্ব ক্ষতি হবে না।
এ ছাড়া চারটি দেশের মধ্যে কল্যাণমূলক সুবিধার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকছে বাংলাদেশ। বিসিআইএমের মধ্যে কল্যাণমূলক সুবিধা ভোগ করবে ভারত। আর্থিক দিক থেকে এ সুবিধার মূল্যমান হচ্ছে প্রায় ২৭ কোটি মার্কিন ডলার। সবচেয়ে কম সুবিধা পাবে মিয়ানমার। তাদের ক্ষেত্রে কল্যাণমূলক সুবিধার আর্থিক মূল্য হচ্ছে ৫০ লাখ ডলার। তবে দ্বিতীয় স্থানে বাংলাদেশ কল্যাণমূলক আর্থিক সুবিধা ভোগ করতে পারবে ৭ কোটি মার্কিন ডলারের।
সমীক্ষায় বিসিআইএম অঞ্চলে রফতানির জন্য ১৫টি পণ্যকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রয়েছে শস্যকণা, চামড়া, শুকনা খাবার, ছাগলের মাংস, হস্তশিল্প ও সিনথেটিক ফেব্রিক্স। এটি মূলত চীনের বাজারে রফতানির জন্য শনাক্ত করা হয়। পাশাপাশি ভারতের বাজারের জন্য শনাক্ত করা হয় এন হাইড্রোঅক্সাইড এ্যামোনিয়া, লিড এ্যাসিড, সবজি, পাট ও টেক্সটাইল পণ্য।
কৃতজ্ঞতা: দৈনিক জনকণ্ঠ
^উপরে যেতে ক্লিক করুন