- প্রকাশ করা হয়েছে সোমবার, 28 এপ্রিল 2014 10:16
সাম্প্রতিক কালের ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের সন্ত্রাস বিষয়ক রাষ্ট্রভিত্তিক রিপোর্টে (২০১৩) বাংলাদেশ ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। এতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ‘উল্লেখযোগ্য সাফল্য’ পেয়েছে বলে স্বীকার করা হয়েছে।
রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশ সন্ত্রাস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলোতে বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে: আইন, আইন প্রণয়ন, সীমান্ত নিরাপত্তা, সন্ত্রাসী অর্থায়ন, সন্ত্রাস প্রতিরোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সন্ত্রাসের মূল কারণগুলোকে চিহ্নিত করে প্রতিরোধের সামাজিক পন্থা অবলম্বন।
রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে: “বাংলাদেশ সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংঘগুলোর প্রতিরোধে তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে এবং সন্ত্রাস প্রতিরোধী কার্যকর প্রচেষ্টার ফলে সন্ত্রাসবাদীদের জন্য বাংলাদেশকে স্বর্গরাজ্য করাটা দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।“
এই সাফল্য এসেছে দীর্ঘ সময়ের প্রচেষ্টায়। বিশেষত, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯-এ ক্ষমতার আসার পর থেকেই বাংলাদেশ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের জন্য অভয়ারণ্য বানিয়ে ফেলার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দায়িত্বগ্রহণের পর থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার সন্ত্রাস দমনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার আরোপ করেছে। আর এই নীতির কারণে, তারা ২০০৯ সালে, একটি ১৭ সদস্যবিশিষ্ট “জঙ্গীবাদ দমন এবং প্রতিরোধমূলক জাতীয় কমিটি” গঠন করেছে। এর নেতৃত্বে আছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিগণ এবং নিরাপত্তা সংস্থাসমূহ। যারা চরমপন্থী মোকাবেলা এবং তেমন তৎপরতার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির জন্য কাজ করছেন।
সরকার চারটি চরমপন্থী সংঘকে নিষিদ্ধ করেছে: জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ(জেএমবি), জাগ্রত মুসলিম জনতা(জেএমজেবি), হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামি(হুজি-বি), হিজবুত-তাহরির(এইচটি) এবং শাহাদাত-ই-আল হিকমা। এই বহুল আলোচিত সংগঠনগুলো ছাড়াও অন্যান্য যারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের কমিটির কর্তৃক চিহ্নিত সন্ত্রাসী সংঘগুলোকেও নিষিদ্ধ করেছে।
প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতি করে বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দা তৎপরতা তদারক করতে সরকার, জুলাই ২০০৯ সালে আট-সদস্যবিশিষ্ট একটি “জাতীয় গোয়েন্দা তৎপরতা তদারক কমিটি” গঠন করে। বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারি এবং গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে এই কমিটি চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্যও দায়িত্বপ্রাপ্ত।
একই বছরে, বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো সন্ত্রাস দমনের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করে: সন্ত্রাস বিরোধি আইন ২০০৯। জাতিসংঘের সন্ত্রাস দমননীতির কার্যপরিকল্পনা এবং অন্যান্য সিদ্ধান্তের সাথে এই আইনটির সামঞ্জস্য রাখতে পরবর্তীতে একে দুইবার সংশোধন করা হয়। শেষের পরিমার্জনাটিতে, সন্ত্রাস বিরোধি (সংশোধিত) আইন ২০১৩, আদালত কর্তৃক ভিডিও গ্রাহ্য করার বিধান করা হয়েছে, সাথে ছবি এবং সোশ্যাল মিডিয়া অডিও ক্লিপও প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার হবে। সংশোধিত আইনে মৃত্যুদণ্ড এবং কঠোর অর্থদণ্ডও যোগ করা হয়েছে, যাতে সন্ত্রাস এবং নাশকতামূলক অপরাধের গুরুত্বের উপর ভিত্তি করে শাস্তি দেয়া যাবে।
২০১০ সালে সরকার জঙ্গিবাদ বিরোধি একটি মজবুত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে, যেখানে মাদ্রাসা পাঠ্যক্রমকে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সরকার চরমপন্থি বিরোধি অধ্যায়ও যোগ করেছে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যপুস্তকসমূহে। তদুপরি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতনা সৃষ্টির প্রোগ্রামেরও আয়োজন করে চলেছে। ২০১১ সালে, সরকার একটি ‘জাতীয় সন্ত্রাস বিরোধি কৌশল’ প্রণয়ন করে। সে বছরের আগস্টে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে পেলার্মো কনভেনশনে যোগ দেয়।
জঙ্গী অর্থায়ন প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও অনেক সংস্কার করা হয়েছে। ২০১২ সালে, সরকার মানি লন্ডারিং প্রতিরোধি আইন ২০১২ প্রণয়ন করে, যা বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং এবং জঙ্গী অর্থায়নের বিরুদ্ধে বিশেষায়িত প্রথম কোনো আইন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দাদের ফিনান্সিয়াল ইউনিট সন্ত্রাসে অর্থায়নের বিরুদ্ধে কার্যকরি পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ব এবং প্রাইভেট কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন সার্কুলারের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং এবং সন্ত্রাসে অর্থায়নের ব্যাপারগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে জানিয়েছে।
২০১২ সালে বাংলাদেশে পারস্পরিক আইনি সহায়তা আইন ২০১২ প্রণয়ন করে যা আন্ত:দেশীয় আইনি কাঠামোর সহযোগিতায় জিজ্ঞাসাবাদ, অভিযুক্তকরণ এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিচারের সুযোগ ঘটাবে। এই আইন বাংলাদেশ সরকারকে অন্য কোনো দেশের অনুরোধে যেকোনো অপরাধি ও জঙ্গীদের সম্পদ এবং তাদের অপরাধকর্মে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেয়।
২০১৩ সালের জানুয়ারি ২৮, বাংলাদেশ ও ভারত, দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসীদের আঞ্চলিক যোগাযোগ এবং নেটওয়ার্ককে ব্যাহত করতে একটি হস্তান্তর চুক্তিতে স্বাক্ষর। তদুপরি, বাংলাদেশ ও ভারত একটি সমন্বিত সীমান্ত পরিচালনা পরিকল্পনা (CBMP) প্রণয়নে সম্মত হয় এবং অপরাধ তৎপরতা ও সন্ত্রাসবাদিতা মোকাবেলায় দীর্ঘ এবং বিস্তীর্ণ সীমান্ততে যুগ্মভাবে প্রহরার সংখ্যা বাড়াবার ব্যাপারেও সম্মত হয়।
২০১৩ সালের জুলাইতে, বাংলাদেশ এগমন্ট গ্রুপের সদস্যপদ গ্রহণ করে, যেটি একটি ১৩১ সদস্যরাষ্ট্রবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থা যা মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসাবাদে অর্থায়ন এবং অন্যান্য অর্থসংক্রান্ত অপরাধের বিরুদ্ধে কাজ করে। এছাড়া বাংলাদেশ মানি লন্ডারিং বিষয়ক এশিয়া প্যাসিফিক সংঘেরও সদস্য হয়েছে, ৪১টি সদস্য আর কিছু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকের সমন্বয়ে একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত এবং সহযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক সংস্থা।
২২ অক্টোবর ২০১৩, বাংলাদেশ ইউএসএর সাথে একটি অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করে যার লক্ষ্য হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে সন্ত্রাসবিরোধি সহযোগিতাবৃদ্ধি, সামর্থ্যবৃদ্ধি, তথ্য বিনিময় এবং আইন প্রয়োগকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে অধিকতর সহযোগিতা বিনিময় নিশ্চিতকরণ।
ফেব্রুয়ারি ২০১৪তে, মানি লন্ডারিং বিরোধি সংস্কার এবং সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের ব্যাপারে সফল সংস্কারের ফলে ফিনান্সিয়াল একশন টাস্ক ফোর্স (৩৪টি উন্নত দেশ ও দুটি আঞ্চলিক সংস্থা মিলিয়ে একটি আন্তদেশিয় সংস্থা) বাংলাদেশের নামটি তাদের “ধূসর তালিকা” থেকে বাদ দিয়েছে।
আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন ছাড়াও মিডিয়াকে সরকার সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রচারণাকে জোরদার করতে নাগরিক সমাজ এবং এনজিওসমূহকেও সম্পৃক্ত করছে।
তথ্য ও উপাত্তের উৎস
1. Country Reports on Terrorism 2013, USA State Department [http://1.usa.gov/1mASERy]
2. Khan S E, “Bangladesh: A Success Story in Counter Terrorism”, Vibrant Bangladesh, Embassy of the People’s Republic of Bangladesh, Issue 6, 26 March 2013 [http://bit.ly/1niuHhe]
3. “Bangladesh in Egmont Group”, bdnews24.com, 4 July 2013 [http://bit.ly/1o4VKgj]
4. “Bangladesh out of FATF grey list”, the Daily Star, 17 February 2014 [http://bit.ly/1iqpBYO]