- প্রকাশ করা হয়েছে সোমবার, 03 মার্চ 2014 11:00
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারকে বাস্তবতায় রূপান্তর করতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সময়ক্ষেপন করছেনা। আওয়ামী লীগের চুড়ান্ত লক্ষ্য দেশের শান্তিকামী মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তি সাধন এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বেড়াজাল ছিন্ন করে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালে গৃহীত কর্মসুচী ও অসমাপ্ত প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো তা পূরণের পথে একধাপ এগিয়েছে সরকার। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক পরিবর্তনের লক্ষ্যে সরকার ছয়টি মেগা প্রকল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।
সরকারের গৃহিত এই অগ্রাধিকার তালিকার প্রথমেই রয়েছে পদ্মাসেতু প্রকল্প। সেই সঙ্গে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন এবং ঢাকা গণপরিবহন উন্নয়ন প্রকল্পও (মেট্রোরেল) প্রাধিকার পাচ্ছে। এছাড়া আছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প।
এসব প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হবে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে। ওই প্রকল্পের ব্যয় এরই মধ্যে ৪৩ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকায়। ব্যয়ের দিক দিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রকল্প হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে। ওই প্রকল্পে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা (তিন বিলিয়ন ডলার) ব্যয় হবে। অন্যান্য প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ২৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা, মেট্রো রেল প্রকল্পে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা (২০১ কোটি ডলার), এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে ২৫ কোটি ডলার বা ৪১৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
প্রকল্পগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে এবং দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রথম পর্যায়ের দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত মাসের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম পর্যায়ের (ফার্স্ট ট্র্যাক) পুনর্গঠিত প্রকল্প মনিটরিং কমিটির উদ্বোধনী বৈঠকে এ নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
রাজধানী ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে গৃহীত মেট্রোরেল প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটির মধ্যে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা দেবে জাপান সরকার। এরই মধ্যে জাইকার সঙ্গে এ বিষয়ে একটি ঋণচুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিভিন্ন জটিলতায় এই প্রকল্পের কাজে ছেদ পড়লেও দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ দ্রুততার সঙ্গে করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জেল হোসেনকে এরই মধ্যে মেট্রোরেলের নতুন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে সরকার বহুমুখী উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্যই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগ নিয়েছে। গত সরকারের শেষ দিকে রূপপুর প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমানে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন জরিপ চলছে বলে জানা গেছে। জরিপ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মূল নির্মাণকাজ শুরুর কথা রয়েছে। রাশিয়া সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করছে। ওই প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়ের ৯০ শতাংশও ঋণ হিসেবে সরবরাহ করবে দেশটি। ২৮ বছর মেয়াদি ওই ঋণের সুদের হার হবে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ। মহাজোট সরকারের শুরু থেকেই বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ায় রূপপুর প্রকল্পটি দীর্ঘ ৫০ বছর পর আলোর মুখ দেখে। পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে ১৯৬১ সালে প্রকল্পের প্রথম পরিকল্পনা শুরু হয়। পরে ১৯৭১ সালে অর্থাভাবে পরিত্যক্ত হয় প্রকল্পটি। এরপর ২০১১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে সরকার।
সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ। সমুদ্রবন্দরকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাইপলাইন বিবেচনা করে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগ সরকার দেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করে। তবে জোট সরকারের সময় তা আর এগোয়নি। পরে ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার গঠনের পর আবারো প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে অর্থায়নসহ দাপ্তরিক জটিলতায় কাজ পিছিয়ে যায়। অবশ্য এরই মধ্যে স্থান নির্বাচন ও স্থ’ানের বিষয়ে সরকারি অনুমোদন মিলেছে। অর্থায়নের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন-সংক্রান্ত ১৫ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে দাতাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন-সংক্রান্ত একটি আইনও প্রণয়ন করা হচ্ছে। ২০৫৫ সাল নাগাদ নির্মাণকাজ শেষ হলে এটিই হবে বাংলাদেশের একক বৃহত্তম প্রকল্প।
ওই বন্দরটি নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬ সাল নাগাদ প্রথম পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন করতে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রথম ধাপে ১টি, দ্বিতীয় ধাপে ২টি এবং তৃতীয় ধাপে ৩টি পোতাশ্রয় নির্মাণ করা হবে। প্রতিটির আয়তন হবে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের তিন গুণ। প্রতিটি পোতাশ্রয়ে কন্টেইনারবাহী ৪টি এবং সাধারণ পণ্যবাহী ৫টি জাহাজ একসঙ্গে ভিড়তে পারবে। বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ৪০ কিলোমিটার করে সড়ক এবং রেলপথ নির্মাণ করা হবে। মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপকে একটি উপশহর হিসেবে সাজানো হবে। বন্দরের সার্বিক চাহিদা মাথায় রেখে উপশহরটি সাজানো হবে। বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জন্য ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। চীনসহ কয়েকটি দেশ এরই মধ্যে গভীর সমুদ্রবন্দরে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানা গেছে।
দেশের অন্যতম ভোটব্যাংক দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। রাজনৈতিক হিসাব ছাড়াও অর্থনীতির সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসেবে মংলা বন্দরসহ পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ সৃষ্টি হলে সমৃদ্ধির নতুন দ্বার উন্মোচন হবে বলে মনে করছে সরকার। নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মূল সেতু নির্মাণের জন্য গত জুনে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এ ছাড়া নদীশাসন এবং অন্যান্য টেন্ডার-প্রক্রিয়া চলছে। প্রথম পর্যায়ের প্রকল্প মনিটরিং কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৬৩২ কোটি টাকা। এর প্রায় ৯৮ শতাংশই ব্যয় হয়েছে। চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের এডিপিতে মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্য ১ হাজার ৬০০ কোটি এবং ভারত সরকার তাদের দেয়া অনুদানের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার চেক হস্তান্তর করেছে।
এছাড়া রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে অর্থ বিভাগের কাছে টাকা চাওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভূমি অধিগ্রহণ এবং ভূমি উন্নয়নের কাজ চলছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্রের জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেয়ারও প্রস্তুতি চলছে। এ জন্য ৩টি প্রতিষ্ঠানকে সংক্ষিপ্ত তালিকায় রাখা হয়েছে। এলএনজি টার্মিনাল বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট তরল গ্যাস আমদানির জন্য এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে।