কেন আলবদরদের জন্য ফাঁসিও যথেষ্ট নয় (৪)

কেন আলবদরদের জন্য ফাঁসিও যথেষ্ট নয়

তারিখ: ২১/০৬/২০১৫
  • মুনতাসীর মামুন
জিয়াউর রহমান ও লে. জে. এরশাদ সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করে আলবদরদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। খালেদা জিয়া সেটিকে আরো জোরদার করার জন্য আলবদরদের মন্ত্রী-এমপি বানিয়েছিলেন। শুক্রবারের পর আজ পড়ুন শেষ কিস্তি।

এদের পক্ষে বলার জন্য টিভি চ্যানেলগুলোতে খুঁজে খুঁজে লোক আনা হয়। অনেক পত্রিকা এদের দলগুলোর প্রতি সমব্যথী, শুধু এই কারণে যে, শেখ হাসিনাকে তারা পছন্দ করেন না। এরা প্রগতিশীল হিসেবে খ্যাত। কিন্তু এরা এ বিষয়টি বুঝেও বুঝতে চান না যে, টিভির টকশোয়ের রেটিং বৃদ্ধির নামে, কাগজের সার্কুলেশন বৃদ্ধি বা নিরপেক্ষতার নামে এরা আলবদরদের সমর্থন করছেন।

অনেকে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেন, এদের গাড়িতে স্বাধীনতার পতাকা তুলে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এ কথা বলে তারা কী বলতে চান? প্রশ্ন তারা তখন কী করেছিলেন? এত বড় একটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ছিল, মুক্তিযোদ্ধারা কী করছিলেন? খালি সুযোগ-সুবিধার জন্য উত্তাল হওয়াই কি মুক্তিযোদ্ধার লক্ষণ? মুুজাহিদরা যে ১৯৭১ সালের পরও আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিল তার একটা বড় কারণ আমরা। আমাদের যে অংশ এদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তাদের আমরা প্রতিহত করিনি। টাকা খেয়েছি, পদ নিয়েছি, আত্মীয়তা করেছি, ভয় পেয়েছি। আমাদের আত্মসমালোচনাটা বারবার করলে হয়ত তাও প্রতিরোধের ভূমিকা পালন করত।

॥ ৬ ॥

মুজাহিদের বিচার শুরু হয়েছিল ২১ জুন ২০১২ সালে। ১৭ জুলাই ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির রায় হয়েছিল দুটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায়। ১. বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতা এবং ২. ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যা। প্রসিকিউশন সাতটি অভিযোগ উপস্থাপন করেছিলেন। ২০১৩ সালের ১১ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন বাদী। ১৬ জুন ২০১৫ সালে আপিল বিভাগ বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়টি বহাল রাখেন। ট্রাইব্যুনালের বিচারে সময় লেগেছিল এক বছর। সুপ্রিম কোর্টের রায় দিতে লাগল দুই বছর। বিচারের এই দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে সাধারণে ক্ষোভ আছে। বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও।
আমরা অনেকে বারবার বলেছি, এই বিচার বিশেষ আইনে হচ্ছে, যেখানে ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট নয়। এতো বছর পরও দেখা যাচ্ছে, কোন পক্ষই ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে বেরুতে পারছেন না। ১৫ জুন যমুনা টিভিতে সাবেক বিচারপতি আমিরুল ইসলাম বলেছিলেন, তদন্ত সংস্থা, প্রসিকিউশন, ট্রাইব্যুনালের বিচারক, এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরাও ফৌজদারি প্রক্রিয়ায় প্রভাবান্বিত। এটি কেন হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। গণহত্যা যেখানে মূল বিষয়, সেখানে ব্যক্তি হত্যা গুরুত্ব পাচ্ছে। সাক্ষীর বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। অথচ এই আইনে ফৌজদারি সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য নয়। যে কারণে আসামী পক্ষ বারবার সাক্ষীর কথা তোলেন। আলবদরদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব বলেছেন, মুজাহিদ যে আলবদর তা প্রমাণিত হয়নি। ‘মুজাহিদ একাত্তরে ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন, কিন্তু আলবদর বাহিনীতে ছিলেন না। একাত্তরের অক্টোবর থেকে তিনি ছাত্রসংঘের সভাপতি হন। তদন্ত কর্মকর্তা আলবদর বাহিনীর নামের তালিকায় মুজাহিদের নাম পাননি।’ (প্রথম আলো, ১৬.০৬.২০১৫)
আগেই উল্লেখ করেছি ছাত্রসংঘই পরিণত হয়েছিল আলবদর বাহিনীতে। ছাত্রনেতা হিসেবে তাই মুজাহিদ হয়ে যান আলবদর। অক্টোবরে ছাত্র সংঘ প্রধান হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলবদর প্রধানের ভার পান। দৈনিক সংগ্রামেই আছে তিনি আলবদর নেতা হিসেবে বক্তৃতা দিচ্ছেন। শাহরিয়ার লাহোর থেকে সেলিম মনসুর খালেদের লেখা আলবদর বইটি এনে ট্রাইব্যুনালে দিয়েছিলেন! জামায়াতকর্মী খালেদ বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে সাক্ষাৎকার নিয়ে বইটি লিখেছেন। আমার আলবদর ১৯৭১ বইটিতে সে বই থেকে প্রভূত সাহায্য নিয়েছি। সেখানে মুজাহিদ আছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (১৯৭১) রাজনৈতিক রিপোর্টে আলবদর নেতা হিসেবে মুজাহিদের নাম আছে। আর কী প্রমাণের দরকার? আর সাক্ষ্যেরও বা কী দরকার?
অনেক সময় বিচারকরাও বলছেন, সাক্ষ্যের অভাব। যেখানে এভিডেন্স অ্যাক্ট প্রযোজ্য নয়, সেখানে সাক্ষ্যের অভাব কী? বকচর কি গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত নয়? যদি বিবেচিত হয়, তা’হলে গণহত্যার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হবে না কেন? বিচারকের লজিক থাকতে পারে, কিন্তু আমরা লজিকহীন মানুষ সেটি ভাবাও ঠিক নয়। জুয়েল, বদি, রুমির হত্যার ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। এ প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যে কার কী হবে তা নিয়ে বাজি ধরা হচ্ছে। এটি আমাদের ভালো লাগছে না। গণহত্যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী কিভাবে পাওয়া যাবে? এগুলো বিবেচনায় রাখা উচিত। আদালতে গেলেও আইনের ফাঁক ফোকর গলিয়ে ইতিহাস অস্বীকার করা আইনের এক ধরনের অপব্যবহার। ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠা করাই আইনের কাজ, যেটি স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত মামলায় বিচারপতি খায়রুল হক করেছিলেন। নিজামী-মুজাহিদ এরা আমার শিক্ষকদের হত্যা করেছেন। কোন অজুহাতে তাদের দ- হ্রাস কেউ মেনে নিতে পারে না। আইনের দোহাই দিয়েও। বিচারপতি হাবিবুর রহমান বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, সম্মানীয় ছিলেন, ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায় তাই ছিলেন। কিন্তু অন্তিমে ব্যাপারটা দাঁড়াল এই যে, ‘ওহ্ তিনিতো গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।’ বিচারপতি রহমান ১৯৭১ সালে এ দেশে থাকার পরও আইনের টেকনিক্যাল পয়েন্টে রায় দিয়েছিলেন ইতিহাস উপেক্ষা করে।
নির্বাহী/আইন বিভাগের একটি পরামর্শ ছিল ছয় মাসের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করা। উচ্চ আদালত সেটি উপেক্ষা করেছেন। প্রচলিত ধারায় ক্রমানুসারে বিচার করছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা কাজ করলে মানুষ শুধু আনন্দিত নয়, উপকৃত হতো। আপনি অনেক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন, কিন্তু ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা একই মাপকাঠিতে দেখবেন, সেটি মন থেকে কেউ গ্রহণ করেন না। প্রধান বিচারপতি অবশ্য আপিল বিবেচনার জন্য আলাদা বেঞ্চ গঠন করতে পারেন। কিন্তু সেখানে সরকারী সহায়তা দরকার। এ ব্যাপারে সরকার নির্লিপ্ত।
অসুবিধা আছে, প্রতিরোধ আছে, তারপরও বলব এই প্রক্রিয়া চলছে। অন্তত কয়েকজনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত রায় হয়েছে। দেশীয় আইনে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার এই প্রথম। ট্রাইব্যুনালের অনেক রায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিবেচ্য হবে। শেখ হাসিনা অন্তত এই একটি কারণে ইতিহাসে থাকবেন।
বিএনপি-জামায়াত দক্ষতার সঙ্গে গত ৩০ বছরের মানসিক জগতে আধিপত্য বিস্তার করেছে তাদের দর্শন দিয়ে। এই সরকার সেই কাজে ভয়ানকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার দায় ভবিষ্যতে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে বহন করতে হবে। মানবতাবিরোধী বিচার সুযোগ এনে দিয়েছে নতুনভাবে জামায়াতের নেতা এবং দলের কর্মকা- ও চরিত্র তুলে ধরার। এবং বিএনপি তাদের সমর্থক হিসেবে কিভাবে অপরাধ করছে তাও বর্ণনা করা। কিন্তু শেখ হাসিনা ছাড়া এ বিষয়ে কারো উৎসাহ নেই। কমিটমেন্টের অভাবটা প্রকট হয়ে উঠছে।
আমি জানি এ ধরনের বক্তব্য রুলিং পার্টির এলিটরা পছন্দ করবেন না। তাতে কিছু আসে যায় না। এ দেশটি ছোট, কে কী করেন তা সবাই জানে। শেখ হাসিনা এখন তাদের দিচ্ছেন, দু’হাতে লুটে পুটে নিচ্ছেন। তিনি তাদেরই দিচ্ছেন, যারা বিপদে তার পাশে ছিলেন না। তার উপদেষ্টা ও মন্ত্রীদের একটি অংশ ফখরুল-মইনের শাসনের সময় বিদেশে কেটে পড়েছিলেন। এদের প্রতি তার পৃষ্ঠপোষকতা আওয়ামী লীগ ও রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ঘটাচ্ছে। তিনি যখন বলছেন জামায়াতী অনুপ্রবেশ চলবে না, পাতি লিডাররা পর্যন্ত তার কথায় কর্ণপাত করছেন না। জামায়াতের সমালোচনা করেন তিনি। আর তার নেতারা জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্নভাবে টাকা নেয়। তিনি বিএনপির সমালোচনা করেন। আর তার ঘনিষ্ঠ মিডিয়া মালিক/কর্মকর্তারা বিএনপি ঘেঁষা ব্যক্তিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের বক্তব্যগুলোকে শুধু প্রচার নয়, গ্লোরিফাই করেন। কেননা ঐ সব নিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতা এই বার্তাই দিচ্ছে, যত তার বিরুদ্ধে কাজ করবে তত পৃষ্ঠপোষকতা পাবে। শেখ হাসিনা বিপাকে পড়লে অবশ্যই কেটে পড়বেন। আগেও পড়েছেন। আর সামরিক-বেসামরিক আমলাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে, ক্ষমতা দিয়ে সমাজের অন্যান্য অংশ বা কমিটেডদের দমন করা যায় না।
সরকারের এখন পুরো ঝোঁক শুধু জিডিপি বৃদ্ধির দিকে। যেন এটিই রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ধারণাটা ভুল। আদর্শগত আধিপত্য মানস জগতে বিস্তার করতে না পারলে উন্নয়ন কোন কাজে আসবে না। কারণ মৌল জঙ্গীবাদ উন্নয়নবিরোধী। পাকিস্তান ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হলো শুধু এ কারণে। এখন তারা এ চক্র থেকে বেরুবার চেষ্ট করছে। আর বাংলাদেশ ঠিক তার উল্টোটা করছে। একটি উদাহরণ দিই। সরকার নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসায়, রাষ্ট্রের আদর্শবিরোধী, সরকারবিরোধী এবং মওদুদীর ও মওদুদী আদর্শের পক্ষে সমস্ত কর্মকা-/পড়ানো চলছে। এ নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন রিপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিছুই করেনি। কারণ, তারা চায় বাচ্চা মওদুদীর সংখ্যা বাড়ুক। তারা ক্ষমতায় এলে মন্ত্রী/কর্মকর্তাকে বিপদে পড়তে হবে না। সরকারী দল বা ১৪ দলীয় জোটের আশা, আলিয়া মাদ্রাসায় মওদুদীবাদে দীক্ষিত এই সব নওজোয়ানরা তাদের ভোটের বাক্স ভরে দেবে। অর্থমন্ত্রী জনাব মুহিতের ভাষাটা রপ্ত করতে পারলে এ ধারণায় বিশ্বাসীদের এডুকেটেড ‘ইডিয়ট’ হিসেবে অভিধা দেয়া যেত।
আমরা সবশেষে বলতে চাই, নিজামী-মুজাহিদরা যে অপরাধ করেছে, তা বর্ণনার অতীত। কিভাবে একটির পর একটি আঙ্গুল, হাত-পা কেটে, চক্ষু উৎপাটন করে, গায়ের চামড়া তুলে নুন-মরিচ দিয়ে, নারীর স্তন কেটে অত্যাচার করেছে, উল্লাস করেছে। আমাদের জেনারেশনের পক্ষে তা ভোলা মুশকিল। সে জন্য বলি, সাদেক খান টাইপের লোকজনের মা মেয়ে বোন স্ত্রীকে যদি আলবদরদের হাতে তুলে দেয়া হতো, তাহলে তারা বুঝতেন বেদনা কী, অবশ্য এ সব মানসিকতার লোক তাতে খুশি হতো। কারণ ধর্ষণ করলে পাকিস্তানীরাই তো করছে। মারহাবা! অত্যাচার করলে তো পাকিস্তানীরাই করেছেÑ মারহাবা! মারহাবা! যারা রায় দেন তারাও যেন অনুধাবন করেন, গণহত্যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয় না, ধর্ষণের সাক্ষী [প্রায় ক্ষেত্রে] হয় না, এবং এ সব অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন নামমাত্র শাস্তি। সেটি আইনের অপব্যবহার। আমাদের দেশে এ ধরনের একটি ঝোঁক বাড়ছে যে, খুনীদের মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে, ভিকটিমের নয়। খুনীদের মৃত্যুদ- দেয়া যাবে না। যে মারা গেছে, সে তো গেছে। সে মরতে গেল কেন? দুঃখ এই যে, মুজাহিদ-নিজামী-সাকাচৌ-মীর কাশেমের মতো খুনীরা সব জায়গায় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে কষ্ট না পেয়ে মারা যাবে। সে জন্যই লিখেছি, সর্বোচ্চ শাস্তিও তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। সান্ত¡না এই যে, জীবিত থাকাকালীন বিচারটা দেখে যেতে পারলাম। রায় শুনে গেলাম। সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিবাদন।


^উপরে যেতে ক্লিক করুন