কেন আলবদরদের জন্য ফাঁসিও যথেষ্ট নয়
তারিখ: ১৯/০৬/২০১৫
- মুনতাসীর মামুন
যদি আপনাদের ঘরের দহলিজগুলো আপনাদের জন্য বন্ধ এবং আরাম আলয়গুলির প্রশস্ততা আপনাদের জন্য সঙ্কীর্ণ করে দেয়া হয় তাহলে হিজরত করে চলে যাবেন। কেননা হিজরত হচ্ছে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পালন পথে অনিবার্য সফর। হিজরত আল্লাহর সর্বশেষ নবীর সুন্নত।...
ওহে আমার ভাইয়েরা,
কার জানা আছে যে, আগামীকাল আমাদের মধ্যে কে জীবিত থাকবে এবং কার সঙ্গে কার দেখা হবে। আর ওখানে তো অবশ্যই সাক্ষাত হবে। তবে এই জগত ছেড়ে যাওয়ার আগে সেই চেহারাগুলো প্রাণভরে দেখে নিন, এই রক্তগুলোর সঙ্গে শেষবারের মতো আলিঙ্গনবদ্ধ হোন। কারণ হয়ত আর একবার এখানে এভাবে একত্রিত হতে পারব না।
তবে আমাদের প্রতিপালক যদি চান আর যদি তিনি চান তাহলে আমরা আবারও এখানে মিলিত হতে পারি।
সাথীরা, বন্ধুরা, ভাইয়েরা,
এখন আমাদের পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যেতে হবে। আপনাদের অনুভূতিগুলো একত্রিত করে নিন। আল্লাহ আমাদের সহায় ও সাহায্যকারী । আসুন, আমরা একে অপরকে দোয়ার সঙ্গে বিদায় দেই। ফি আমানিল্লাহ।’
বক্তৃতা শেষ। আলবদরের ডেপুটি চীফ মুজাহিদকে সবাই ‘অশ্রুসিক্ত নয়নে’ ও ‘কম্পিত ঠোঁটে’ অনুরোধ জানাল পালাতে। কিন্তু মুজাহিদ বলেন, ‘না, আপনাদের যাওয়ার পর আমি যাব। আমিই হব ক্যাম্পের শেষ ব্যক্তি।’
আলবদররা তখনও ক্যাম্প ছেড়ে নড়ছে না। গলাগলি করে হিক্কা তুলে কাঁদছে। তখন মুজাহিদ বললেন- ‘আমি বাধ্য হয়ে আদেশ দিচ্ছি আপনারা হিজরতে বের হয়ে যান।’ তাদের হিজরত ছিল লেজ গুটিয়ে পালানো।
তখন আলবদররা তাদের সদর দফতর ছেড়ে, তাদের ভাষায়, ‘হিজরতে’ গেল। আমাদের ভাষায় পালাল। নিরস্ত্র ব্যক্তিদের হত্যাকারী পাকিস্তানী সিপাহীদের ভৃত্য আলী আহসান মুজাহিদও বীরবিক্রমে ঢাকা ছেড়ে কাঠমান্ডুর পথে দৌড়াতে লাগলেন।
তার দিল্লী দূরে থাকুক অসম জয় করাও হলো না।
॥ ৫ ॥
এইসব খুনীকে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন জেনারেল জিয়া। বঙ্গবন্ধু রাজাকারদের বিচার শুরু করেছিলেন, দুই বছরের মধ্যে ৭৮০ জনেরও বেশি দালালকে দ- দেয়া হয়েছিল। এই সময় নিজামী-মুজাহিদদের মধ্যে ওপর দিকের পরিকল্পক ও খুনীরা পাকিস্তানে পালিয়ে ছিলেন। একটি যুক্তি দেয়া হয় অলবদর ও তাদের সমর্থক বিএনপির পক্ষ থেকে যে, নিজামী-মুজাহিদ-কাদের-কামারুজ্জামানরা দোষী হলে বঙ্গবন্ধু সরকার তাদের গ্রেফতার করল না কেন? এর কারণ, তারা পালিয়ে ছিলেন।
এই খুনীদের যদি পুনর্বাসন না করা হতো তা হলে বাংলাদেশের রাজনীতি এত কলুষিত হতো না। খুনী সমর্থক এসব রাজনীতিবিদের উত্থান হতো না। বাংলাদেশ এখন বিভক্ত হতো না (মানসিক দিক থেকে)। কিন্তু জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন দেশটিকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে। তাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়তে বাধ্য করা হয়েছিল, এ কারণে তার প্রতিশোধ তিনি নিতে চেয়েছিলেন। একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা কি পারেন নিজ দেশ তছনছ করতে?
আলবদরদের বিচারকালে এ ইতিহাসটুকু মনে রাখা দরকার। এ কারণে, অনেক আগে লিখেছিলাম- মুক্তিযুদ্ধ করাটা যত সহজ ছিল, অন্তিমে মুক্তিযোদ্ধা থাকাটা সহজ ছিল না।
এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ একসময় বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ও ক্ষমতা দখলকারী প্রেসিডেন্ট লে. জে. জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান ও তার অনুসারী সামরিক কর্মকর্তাদের পরবর্তীকালে আচরণ দেখে এই প্রতীতি জন্মেছে যে, তাদের অধিকাংশ বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে নয়। তৎকালীন ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম বা মেজর খালেদ মোশাররফরা আগে থেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। জিয়াউর রহমান ২৫ মার্চ রাতেও সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র উদ্ধারে গিয়ে বাধা পেয়ে বলেছিলেন, ‘আই রিভোল্ট’।
জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা দখলের সঙ্গে আলবদরদের একটি সম্পর্ক আছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর আমরা দেখেছি আলবদররা পালাচ্ছে। আলবদরদের বৃহৎ অংশ মিশে গেল সাধারণ মানুষের ভিড়ে। যারা পরিচিত তারা চলে গেল পাকিস্তানে। আলবদররা ছিল সংঘবদ্ধ। শত্রুদের শায়েস্তা করার বিষয়ে তাদের একটা পরিকল্পনা ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোভাব ছিল সংঘবদ্ধ, তাদের ওপর কমান্ড থাকলেও তা ছিল শিথিল আর শত্রুদের নিয়ে কী করা হবে সে সম্পর্কে তাদের কোন পরিকল্পনা ছিল না। আলবদরদের আশ্রয় দিয়েছেন অনেকে, টাকার বিনিময়ে ছাড়াও পেয়েছে অনেকে। অনেককে গ্রেফতারে শৈথিল্য দেখান হয়েছে। দালাল আইনে কিছু আলবদর ধরা পড়লেও বৃহৎসংখ্যক ধরা পড়েনি। এরা চুপচাপ বসেছিল না। এরা সংঘবদ্ধ হচ্ছিল। ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের সংঘবদ্ধ ও সংহত করছিল। পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা আলবদর নেতাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল। জামায়াতের নেতা গোলাম আযম লন্ডন থেকে তাদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী অনেক দেশ তাদের সহায়তা করছিল, ফলে তারাও একটি শক্তি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।
এই ধারণার কারণ, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান যে কাজগুলো করেছিলেন, তা ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত। মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদররাও একই কাজ করছিল। শুধু তাই নয়, জঘন্য অপরাধের জন্য শাস্তি হিসেবে আলবদরদের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল মৃত্যুদ-। দ-তো নয়ই, তাদের বরং করা হয় পুরস্কৃত।
জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর সাহায্যে ক্ষমতা দখল করে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন প্রথম। বাংলাদেশে সংবিধানের ওপর প্রথম হামলাকারী তিনি, দ্বিতীয় লে. জে. এরশাদ। সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করেছিলেন তারা। আলবদররা যেমন খুনের রাজনীতি করেছেন, এরাও তেমন খুনের রাজনীতি করেছেন। খালেদা জিয়া সেটিকে আরো জোরদার করার জন্য আলবদরদের মন্ত্রী করেছিলেন।
(চলবে)