একুশ শতক ॥ হাওড় বাংলার রূপান্তর

একুশ শতক ॥ হাওড় বাংলার রূপান্তর

তারিখ: ২১/০৬/২০১৫
  • মোস্তাফা জব্বার
॥ এক ॥
বাংলাদেশ কতটা বদলেছে আর কতটা সফল হয়েছে তার নানা ধরনের মাপকাঠি আছে। দুনিয়ার সকল দেশ নিয়েই এমনটা আছে। তবে যদি আজ (১৮ জুন ২০১৫) বাংলাদেশের সাফল্যের কথা কাউকে জিজ্ঞেস করেন তবে তার একটিই মন্তব্য হবে- এই বাংলাদেশ সেই বাংলাদেশ তো নাই-ই- এটি আনন্দবাজারের ভাষায় শের-ই-বাংলা; ক্রিকেটের টাইগারদের দেশ।
এই দেশটি ১৯৪৭ সাল থেকে ২৩ বছর পাকিস্তানে ছিল। সেই দেশটি দুনিয়াজোড়া ক্রিকেট খেলত। কিন্তু ২৩ বছরে একজন বাঙালী ক্রিকেট খেলোয়াড় পাকিস্তান ক্রিকেট টিমে ঠাঁই পায়নি। স্বাধীনতার পর আমরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ডাংগুলির মতো ক্রিকেট খেলা শুরু করেছি। অতি কষ্টে ওয়ান ডে স্ট্যাটাস ও আরও বহুগুণ বেশি কষ্টে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছি। পাকিস্তান-ভারত দুই দেশই আমাদের খেলা দেখে হাসত। আমাদের আন্তর্জাতিক স্ট্যাটাস বাতিলের কথাও বলা হয়েছে। ক্রিকেটে সিধুজীদের হাসি-ঠাট্টা-তামাশা নিয়ে আমরা বুড়ো হয়েছি। আমাদের সন্তানরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে মাথা নিচু করে ঘরে ফিরত। মার আঁচলে মুখ লুকিয়ে চোখের পানি ফেলত। সেই বাংলাদেশ মাত্র ক’দিন আগে পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করেছে এবং ১৮ জুন ২০১৫ প্রথম ওয়ানডেতে ভারতকে তুলাধোনা করে ৭৯ রানে হারিয়েছে। আরও দুটি খেলা ভারতের সঙ্গে হবে। হতে পারে তাতেও আমরা সফল হব। হতে পারে ভারতের সঙ্গে সিরিজ জিতব বা হতে পারে ভারতকেও বাংলাওয়াশ করব। যদি তা নাও হয় তবুও ১৮ জুনই আমাদের বিজয়ের এক মাইলফলক। ১০ বছর আগেও এমন একটি মাইলফলক আমরা তৈরি করেছিলাম অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে। সঙ্গত কারণেই এটি হচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে সফলতার বাংলাদেশ।
তবে অন্যভাবেও বাংলাদেশের সফলতা মাপা যেতে পারে। জীবনযাত্রার মান, মাথাপিছু আয়, শিক্ষার হার, জাতীয় প্রবৃদ্ধি এসব নানা সূচকে আমরা বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপনের পরিবর্তনকে মেপে থাকি। শুধু আমরা নই, দুনিয়াজোড়াই এমনটি হয়ে থাকে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল সূচকেই বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে চার দশকের অগ্রগতি নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। রাজনৈতিক সঙ্কট, ঝড়-ঝঞ্ঝা-অস্থিরতা সত্ত্বেও আমরা সামনেই পা বাড়িয়েছি। কি পেলাম, দেশটাকে স্বাধীন করে কি হলো; এসব হাহুতাশের মাঝেও বাংলাদেশের সকল পরিসংখ্যান এখন আমাদের সম্মানের কথা, গৌরবের কথা আর অগ্রগতির কথা বলে। শিক্ষা, মাথাপিছু আয়, যোগাযোগ, শিল্পায়ন, রফতানি, তথ্যপ্রযুক্তি এবং মা ও শিশুর মৃত্যু থেকে শুরু করে এমন কোন সূচক নেই যাতে আমরা সামনে যাইনি। ১৯৭১ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৮৫ ডলার। ২০১৫ সালে হয়েছে ১৩১৪ ডলার। ২০০৯ সালেও এটি ছিল এর অর্ধেক। ৭১ সালে শিক্ষার হার ছিল শতকরা ২০ ভাগের কাছাকাছি। এখন ৭০-এর কাছে। ৭২-৭৩ সালের ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ২০১৫ সালে ৩ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। তলাবিহীন ঝুড়ির দেশে এখন ২৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ রয়েছে। গত ছয় বছরে যেসব ডিজিটাল রূপান্তর হয়েছে তার বিবরণ দিলে তো ভারতকেও বলতে হবেÑ চল যাই বাংলাদেশ থেকে ডিজিটাল ইন্ডিয়া বানানো শিখে আসি।
যা হোক, খবরে প্রকাশ, আমরা মিলিনিয়াম গোলও অনেক আগেই অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছি। দারিদ্র্য দূরীকরণে আমাদের অসাধারণ অর্জন আছে। সামনের দশকে সবচেয়ে উদীয়মান টাইগার তো আমরাই। কিন্তু আমরা কি চোখ মেলে চারপাশে তাকিয়ে দেখেছি দেশটা তৃণমূলে কেমন বদলেছে? বদলানোর রূপটা কেমন। আমার জন্য সবচেয়ে সহজ হয়েছে নিজের গ্রামটার রূপান্তর দেখা।
২০১৪ সালে ঈদে যারাই বাড়ি গেছেন তাদের মুখে কেবল গ্রামের বাড়ির প্রশংসা। এমনটি আগেও দেখেছি। দেখেই আসছি। ২০১৫ সালেও যে এমনটি হবে তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। ফেসবুকে গ্রামের ছবি, গ্রামের স্মৃতি আর অসাধারণ সব প্রশংসার বাণী। বোঝা যায়, আমাদের সকলেরই সুখানুভূতির নাম গ্রাম। গ্রামে যারা থাকেন তাঁরা হয়ত ভিন্ন কথা বলেন। জীবন ধারণের কষ্ট এবং সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা হয়ত তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু তবুও বাংলাদেশের গ্রামগুলোর রূপ-রস-গন্ধ এখনও যে কোন মানুষকে মুগ্ধ করে রাখতে পারে। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের জীবনপ্রবাহের নামই গ্রাম। হতে পারে সুউচ্চ দালান কোঠা, শপিংমল আর ফ্লাইওভারের ভিড়ে প্রধানত ঢাকাই আমাদের দেশটির কেন্দ্রভূমি হিসেবে গণ্য হয়, কিন্তু কাউকে কখনও খুশি মনে গ্রাম ছাড়তে দেখলাম না।
আমি গত কয়েক ঈদে বাড়ি যাইনি। তবুও জানি আমার বাড়ির চাইতে সুন্দর কিছু অন্তত এদেশে আর নেই। ২০১৪ সালে প্রথম আলোর পল্লব মোহাইমান কুলিয়ারচর থেকে নৌকায় চড়ে গারো পাহাড় হয়ে আবার কুরিয়ারচর ফিরে এসেছে। ক্যামেরা হাতে ৬ দিনের এই ভ্রমণের কিছুু কথা সে লিখেছে। পত্রিকাটিতে দু’বার তার সেই ভ্রমণের কথা ছাপা হয়েছে। আমার নিজের ধারণা, পল্লবের চোখে যারা আমার সেই স্বপ্নভূমিকে দেখবেন, তাঁরা অনুভব করবেন, দেশের এক অনন্য সাধারণ জনপদের নাম হাওড়।
২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরের প্রথম আলোতে পল্লব লেখেন, ‘নৌকা ছাড়তেই চোখ জুড়িয়ে গেল, শরীরও জুড়াল হিমেল বাতাসে।’ যদিও তখন দুপুর ১২টা। ২৯ আগস্ট কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর বাজার ঘাট থেকে শুরু হলো জলযাত্রা। কালী নদীর কালো জল, শরতের নীল আকাশ, পুবালি বাতাসে ইঞ্জিন নৌকার ভট ভট আওয়াজও আমাদের কানে যেন সুরেলা হয়ে ওঠে। ঘাটে বিদায় দেয়ার সময় বন্ধু কাউসার খান জানিয়ে দিয়েছেন কুলিয়ারচর হলো হাওর অঞ্চলের গেটওয়ে- সিংহ দুয়ার। কালী নদী পেরোতে না-পেরোতে হাওড়ের দেখা পাই। চারদিকে দিগন্তজুড়ে পানি। মাঝে ইতিউঁতি স্থল, একেকটা জনপদ। পানিমগ্ন ইটভাটা, সাবমার্জ সড়ক ধরে বিদ্যুতের খুঁটি, আর নানা কিছিমের নৌযান দেখতে দেখতে আমরা পড়ি জমশার হাওরে। হাওর-যাত্রার শুরু বলা যায়।...
থইথই পানি। নদী, খালবিল, হাওড়, ফসলের খেত পানিতে একাকার। নৌকা দিয়ে চলাচল করা যায় একেবারে কোনাকুনি। এ সময়ে এই অঞ্চলের জীবনযাত্রা আমাদের নাগরিক চোখে নেহাতই অন্য রকম।... আবছা পাহাড়, নীল আকাশে মেঘের খেলা, নিচে প্রায় স্বচ্ছ পানি। চলেছি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়ের দিকে। দুপুরের দিকে মূল হাওড়ে ঢুকে গেল নৌকা। মাঝে মধ্যে চিল, বক আর পানকৌড়ি চোখে পড়ছে। নৌকার মাঝি বলে, ‘এতবড় পাহাড় দেখি নাই। চলেন গোড়াদ যাই।’ ঘণ্টাখানেক চলার পর পাহাড়ের কাছে পৌঁছাতে পারি। ফিরে আসি হাওড়ের হিজল-করচ বনের পাশ দিয়ে। পেছনে দিগন্ত বিস্তৃত নীল পাহাড়।... আগেই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বলেছিলেন, ‘আমার গ্রামে যেও।’ ৩০ আগস্ট মিঠামইন থেকে ইটনা হয়ে আমরা চলি ছায়ার হাওরের দিকে। এ হাওরের তীরেই ছোট্ট গ্রাম কৃষ্ণপুর, নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। হাওর ঘেঁষেই মেয়েদের স্কুল। ১৯৯৪ সালে মোস্তাফা জব্বার এটা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রধান শিক্ষক রুবি আক্তার সরকার জানালেন, এসএসসিতে পাসের হার ৯৭ শতাংশ। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কিবরিয়া জব্বার নিয়ে গেলেন হাজি আলী আকবর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। বললেন, ‘পুরো ভাটি অঞ্চলে এটি একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।’ অধ্যক্ষ মোঃ আবুল কালাম আজাদ জানালেন সমাজকর্ম, বাংলা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয় এ কলেজে। কলেজে ছাত্রীদের থাকার হোস্টেলও আছে। জানা গেল, ১৯৮৬ সালে ১০ হাজার টাকা খরচে তৈরি একটা টিনের ঘরে এ কলেজের শুরু হয়। তারপর গ্রামের সবার অংশগ্রহণে এ কলেজ এখন দাঁড়িয়ে গেছে স্বমহিমায়। এই গ্রামে আরও আছে একটি হাইস্কুল ও একটি আলিম মাদ্রাসা। কেউ কি ভাবতে পারেন ১৯৬১ সালে আমি এই গ্রাম তো দূরের কথা এর চারপাশের ৪০ কিলোমিটারে একটি হাইস্কুল পাইনি?
২০১৪ সালের জুন মাসে আমি আমার সেই গ্রামে গিয়েছিলাম। হয়েছিলাম এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। আমার নিজের কাছেই মনে হয়েছে মাত্র অর্ধ শতকেরও কম সময়ে এমন রূপান্তর সম্ভবত আমরা ভাবতেও পারিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তো বটেই, ’৭২ সালেও আমার গ্রামে শিক্ষা নামক কিছু ছিল না। যোগাযোগ তো এখনও দুর্গম। পুরো দেশটারই যোগাযোগ, শিল্প-স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য কোন কিছুই একটি বিশ শতকের দেশের উপযোগী বলে চিন্তাই করা যেত না। আমরা ছিলাম কিসিঞ্জারের ভাষায়, একটি তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ। সেই দেশটা চার দশকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমি আমার গ্রামকে দিয়ে দেখতে চাই কতটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে এই দেশটা।
আমরা যারা ষাট অতিক্রম করেছি বা যারা এর চাইতে একটু কমবেশি বয়সী তাদের জন্য বিশেষ করে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রূপান্তরটা দারুণভাবে দৃশ্যমান হওয়ার কথা। গায়ে কাদা মাখানো একটি জাতি কেমন করে বিশ্ব জয় করল সেটি উপলব্ধির বিষয়- কেবল পরিসংখ্যানের বিষয় নয়। বাইশ বছর বয়সে যখন এই দেশটাকে স্বাধীন করার চেষ্টা করি তখন হয়ত স্বপ্নটা আরও বড় ছিল। হয়ত ধরেই নিয়েছিলাম যে, মাত্র চার দশকেই এটি আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে। তেমনটি হয়ত হয়নি। কিন্তু তবুও আমার নিজের কাছে এখন পুরো দেশটাকে অনেক বদলে যাওয়া দেশ বলে মনে হয়। আমি ধারণা করি আপনারও তা-ই মনে হয়।
শহরে এই পরিবর্তনটা ইট-কাঠের বাইরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচকভাবে চোখে পড়ে। মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ও যানজট অনেক সময়েই ভাল লাগাটাকে মন্দতে পরিবর্তন করে দেয়। আইনশৃঙ্খলা, সামাজিকতা, টানাপড়েন সব কিছুই শহরে সঙ্কটের সূচনা করে থাকে। আরও অনেক নেতিবাচক বিষয়গুলো শহরকে যতটা গ্রাস করে, গ্রামকে ততটা করে না। আবার গ্রামগুলো অনেক পিছিয়ে থাকার ফলে এতে যখনই কোন পরিবর্তন আসে তখনই সেটি বেশ বড় করেই চোখে পড়ে। তাই গ্রামের রূপান্তরটার দৃশ্যমানতা অনেক বেশি।
কেবল প্রকৃতির অসামান্য রূপ নয়, গ্রামের মানুষের জীবনধারাও এই সৌন্দর্যকে অনেক বেশি প্রতিভাত করে। তবে দেশের রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জীবনধারা রীতিমতো বীভৎস হলেও অন্য শহরগুলোর অবস্থা এতটা নাজুক নয়। যদিও উপজেলা বা গ্রামগুলোও এখন শহরের মতো, তবুও অনেক জেলা শহরকেও এখন গ্রামই মনে হয়। আবার কোন কোন গ্রামকে পুরোই শহর মনে হয়। বাংলাদেশের বহু গ্রাম আছে যার প্রতিটি বাড়িতে এখন গাড়ি যেতে পারে। বাংলাদেশের বহু গ্রাম আছে যেখানে শহরের মতো ফ্ল্যাট বাড়ি আছে। এমনকি কোন কোন হাট-বাজারে পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও আছে। গ্যাস-বিদ্যুত ও স্যাটেলাইট কেবলসহ মোবাইল নেটওয়ার্ক তো সব গ্রামেই বিরাজ করে। (চলবে)

ঢাকা, ১৮ জুন, ২০১৫
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥
ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com
ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
^উপরে যেতে ক্লিক করুন