৬০ বছর বঙ্গবন্ধুর সাইকেলটি আগলে রেখেছেন তিনি


Mahfujur, Rajbari news (2) ১৯৭২ সালে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আবদুল ওয়াজেদ মন্ডলকে প্রথম দেখাতেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘সেই সাইকেলটি কোথায়? আমি মরে গেলে বাইসাইকেলটি জাদুঘরে দিয়ে দিস।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও জানতেন না তার ব্যবহৃত সেই সাইকেলটি সযত্নে রেখেছেন ওয়াজেদ। প্রশ্নের জবাবে ওয়াজেদ বলেন, সাইকেলটি তার কাছেই আছে। সাইকেলটি ফেরত না দিয়ে নিজের কাছে রাখার আবদার করেছিলেন। দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর সেই সাইকেলটি আগলে রেখেছেন ওয়াজেদ। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত সেই বাইসাইকেলটি এখন তিনি জাদুঘরে দিতে চান।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামের মৃত ওমেদ আলী মন্ডলের ছেলে আবদুল ওয়াজেদ মন্ডল। যখন বঙ্গবন্ধু তার সাইকেলটি ব্যবহার করেছিলেন তখন তিনি ছিলেন ১৫ বছরের কিশোর। এখন তার বয়স ৭৫ বছর। তার এক ছেলে ও তিন মেয়ে। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে ওয়াহিদুজ্জামান বকুল তাদের যেটুকু জমি আছে তা চাষাবাদ করে সংসার চলে। ওয়াজেদ মন্ডলের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেসার নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা।

রাজবাড়ীতে বঙ্গবন্ধুর আগমন সম্পর্কে জানতে চাইলে ওয়াজেদ মণ্ডল বলেন, ‘১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী ওয়াজেদ চৌধুরীর পক্ষে নির্বাচনি প্রচার চালাতে রাজবাড়ীতে এসেছিলেন শেখ মুজিব। ওয়াজেদ চৌধুরীর বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু ১০-১২ সঙ্গী নিয়ে সাইকেল চালিয়ে গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়িয়েছেন, ভোট চেয়েছেন।’
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখাতেই সারা জীবনের জন্য তার ভক্ত হয়ে যাই। ৫৮ বছর আগে যে মানুষটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেই দিনটির কথা আজও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। বঙ্গবন্ধু ও তার সঙ্গীরা একদিন রাজবাড়ীর জেলা সদরের বেলগাছির জৌকুড়া এলাকার মোনাক্কা চেয়ারম্যানের বাড়িতে যান। মোনাক্কা চেয়ারম্যান ছিলেন আমার চাচাতো ভাই। ওই বাড়িতেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়।’
সাইকেল ব্যবহার প্রসঙ্গে বলেন, “তখন আমি ৮ম শ্রেণিতে পড়ি। ফরিদপুর শহরের সাইনোফোন নামের একটি দোকান থেকে ইংল্যান্ডের ডানলপ কোম্পানির বিএসএ মডেলের একটা সাইকেল ২২০ টাকা দিয়ে কিনি। সেই সাইকেলে করে বাড়ি থেকে আমি মোনাক্কার চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাই। সাইকেলটি উঠানে লিচুগাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখতেই বঙ্গবন্ধুর চোখ পড়ে এটির ওপর। তিনি আমার চাচাতো ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলেন, সাইকেলটি কার? সাইকেলটি আমার জানতে পেরে তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তোর সাইকেলটি কয়েক দিনের জন্য আমাকে দে।’ বঙ্গবন্ধু আমার সাইকেলটি নিয়ে যাওয়ার সময় বলে যান, ‘আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত ওয়াজেদ চৌধুরীর বাড়িতে থাকবি। সেখানে তোর সাইকেল আমি ফেরত দিয়ে দেব।’ কী আর করা, আমি ওয়াজেদ চৌধুরীর বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম। ১৫ দিন পর বঙ্গবন্ধু সাইকেল ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভালো থাকিস, মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করিস। আর মানুষকে ভালোবাসতে শিখিস। পারলে রাজনীতি করিস।’ সেই থেকে আমি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ও তার রাজনীতির কর্মী হয়ে গেলাম।’’
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ধানমণ্ডির বাড়িতে প্রথম দেখাতেই বঙ্গবন্ধু ওয়াজেদ মন্ডলের কাছে সেই সাইকেলটি কোথায় আছে জানতে চেয়েছিলেন। সাইকেলটি ফেরত না দিয়ে নিজের কাছে রাখার আবদার করলে হেসে অনুমতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মরে গেলে সাইকেলটি জাদুঘরে দিয়ে দিস।’ তিনি বঙ্গবন্ধুকে জানান, রাজাকাররা তার বাড়ি লুট করে তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। জবাবে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘আমার দেশকেও ওরা নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমার দেশও গরিব, তুইও গরিব। ভাবিস না, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত সাইকেলটি দেখতে তার বাড়িতে প্রায়ই লোকজন আসেন। কেউ কেউ সাইকেলটি জড়িয়ে ধরে আবেগে কেঁদে ফেলেন। তা দেখে তার বুক গর্বে ভরে ওঠে। ভাবেন, সাইকেলটি এবার জাদুঘরে দিয়ে যেতে পারলে দায়িত্ব শেষ। তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত সেই বাইসাইকেলটিও রেখে দিয়েছি পরম যত্নে। জীবনের শেষ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার জীবনের শেষ চাওয়া, সাইকেলটি জাদুঘরে পৌঁছে দেওয়া এবং বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একটিবার সাক্ষাতের সুযোগ পাওয়া।’
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত সেই সাইকেলটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার জন্য গত ১৮ আগস্ট ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগের কিপার ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক ও বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে এক চিঠিতে বিষয়টি যাচাইয়ের অনুরোধ করেছেন।
২৬ আগস্ট জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের এক চিঠি পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান ওয়াজেদের বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে দেখতে পান বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত সাইকেলটির বডি, সিট কভার, পেছনের চাকার রিং, মার্ডগার্ড, হ্যান্ডেল, ফরপাইপ ওয়াজেদ স্বযত্নে রেখেছেন। সাইকেলটি মূল কাঠামো আজো ঠিক আছে। বিষয়টি পরীক্ষা নিরিক্ষারসহ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠাবেন তিনি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা আসলেই সাইকেলটি জাদুঘরে পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।
^উপরে যেতে ক্লিক করুন