বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বঙ্গভবনে খুনিদের যতো কাণ্ডকীর্তি

১৪ অগাস্ট ২০১৫, ২৩:০৭ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বঙ্গভবনে খুনিদের যতো কাণ্ডকীর্তি
‘১৫ আগস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফোন করি। খুনিরা বাড়ির সব টিএন্ডটি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকুর শোবার ঘরের ফোনটির কথা তারা জানতো না। রিং হতে ওপাশ থেকে একটি কণ্ঠ সেদিন উর্দুতে জবাব দিয়েছেলো ‘‘হ্যালো আপ কৌন হ্যায় (আপনি কে)?" উত্তরে বলেছিলাম “শেখ কামালের বন্ধু”। কণ্ঠটি তখন বলে উঠেছিলো “বহুত আচ্ছা, আপ কাহা সে” (খুব ভালো, আপনি কোথা থেকে বলছেন)। বঙ্গভবন থেকে পরিস্থিতি কি জিজ্ঞেস করতে উত্তর আসলো “বহুত আচ্ছা, সাব খুশি মানা রাহা হ্যায়’’ (খুব ভালো, সবাই আনন্দ করছে)। এই পরিস্থিতিতে খুশির কারণ জানতে চাইলে ওপাশ থেকে "বাঙালি বলে গালমন্দ করে ফোন কেটে দিলো।"
’৭৫ এর ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হওয়ার পর ৩২ নম্বর বাড়ির একটি মাত্র সচল ফোনে সেদিন সকাল ৭টায় করা ফোন কল, কথোপকথন এবং মুশতাক সরকারের শপথ গ্রহণের আগে ও সেদিন রাতে বঙ্গভবনে খুনিদের উল্লাসের চিত্র চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে তুলে ধরেছেন সেসময়ের বঙ্গভবনের তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপালনকারী মোহাম্মদ মুসা।

মোহাম্মদ মুসা আক্ষেপের সাথে বলেন, "সেদিন মুশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে খোশ আমেজে থাকা এক জেনারেল পরবর্তীতে বসেছিলেন রাষ্ট্রক্ষতায়, আর খুনিদের ‘হিরো’ বলা উচ্চপদস্থ একজন এখন সরকারের উচুঁ পদে আছেন।"
’৭১ এ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যুদ্ধ বিষয়ক প্রতিনিধি ও পরবর্তীতে বঙ্গভবনের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা এবং সর্বশেষ সচিবের দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যাওয়া মুসা তুলে ধরেছেন ১৫ আগস্ট দিনটিতে তার চোখে দেখা বঙ্গভবনের চিত্র।
সাবেক এই সচিব ও ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার গোপন পরম্পরা’ বইয়ের লেখক বলেন, "৭৫ এর ১৫ আগস্ট আমি বঙ্গভবনে ছিলাম। ভোর সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হয়েছেন শুনলাম। সেখানকার পরিস্থিতি জানতে ফোন করে ৩২ নম্বর বাড়ির সব লাইন বিচ্ছিন্ন পেলাম। অবশেষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এক সময়ের সহযোদ্ধা এক শিল্পীর কাছে খুকুর (সুলতানা কামাল) ঘরের নম্বর পেলাম। উল্লেখ্য, ওই শিল্পী খুকুকে গান শেখাতেন। খুকুর কক্ষের টেলিফোনটির কথা খুনি চক্র জানতো না বলেই হয়তো সেটি সচল পেয়েছিলেন বলে জানান মুসা।
ফোন ধরার পর ওপাশ থেকে উর্দুতে কথোপকথনের বিষয়টি চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে তুলে ধরেছেন তিনি।
ফোন কেটে যাওয়ার পর তিনি করণীয় ঠিক করতে ফোন করেন তৎকালীন সিনিয়র সেক্রেটারি ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত রুহুল কুদ্দুসকে।
মুসা বলেন,"সম্পর্কে রুহুল কুদ্দুস আমার মামা। তাকে ফোন করলাম। তিনি বললেন তাৎক্ষণিক ভাবে খালেদ মোশাররফের সাথে যোগাযোগ করতে। তবে জেনারেল জিয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেছিলেন সেক্রেটারিয়েটের সঙ্গে কথা বলছি।"
সেসময় মুসা সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলবেন কি না জানতে চাইলে রুহুল কুদ্দুস বলেছিলেন ‘লাভ নেই, মনে হয় না সে কিছু করতে পারবে’। এ প্রসঙ্গে মুসা বলেন, "আসলে হত্যাকাণ্ডের পর শফিউল্লাহ সেনাপ্রধানের পুতুল দায়িত্বে থাকলেও কলকাঠি নাড়ছিলেন আরেকজন উর্দিধারী, সে উর্দিধারীই পরবর্তীতে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিলেন।"
৩২ নম্বরের টেলিফোন রেখে মুসা বের হন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। তিনি বলেন, "গুলিস্তান ঘুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে তিনি পৌঁছান বলাকা সিনেমার সামনে আসতেই দেখলাম লোকজন জটলা করছে। পুলিশের পোশাক পড়া একজনকে তো ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে শুনলাম। অনেকে আবার বঙ্গবন্ধুর জন্য আহাজারি করছিলেন। ইডেন মহিলা কলেজেও দেখেছিলাম আহাজারিরত নারীদের’।
এরপর ধানমণ্ডির দিকে যেতে চাইলে সায়েন্স ল্যাবে কালো পোশাকের সশস্ত্র কয়েকজন আমাকে বাধা দিলো।
"আবারও বঙ্গভবনে ফিরে আসি। ততোক্ষণে মুশতাক সরকারের শপথ গ্রহণের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। ফোন করলাম খালেদ মোশাররফকে। তিনি আমাদের মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন। তবে ততোক্ষণে সবাই বঙ্গভবনে আসছে। পটপরিবর্তনে পক্ষ বদলে ফেলেছেন চেনা-জানা অনেকেই। তবে সবচেয়ে অবাক লাগলো একজনকে মুশতাকের পা ছুঁয়ে সালাম করতে দেখে। শপথ অনুষ্ঠানে খুনিদের তিনি সম্বোধন করেছিলেন ‘দে আর দ্য হিরোজ অব দ্য নেশন!’ শপথের আগে দেখলাম তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদারকে শাসাচ্ছেন ওই উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি। ফণিবাবু বঙ্গবন্ধুকে খুনের বিষয়ে কথা বলায় ওই কর্মকর্তা তাকে সেনাদের হাতে প্রাণ যাওয়ার ভয়ও দেখান।"
সেদিন বঙ্গভবনে জেনারেল জিয়াকে বেশ খোশ মেজাজে দেখার দাবি করে মুসা জানান সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর মুখ ছিলো থমথমে। মুশতাক সরকার শপথ নেয়ার পর বঙ্গভবনে উৎসবের আমেজ ছিলো জানিয়ে তিনি বলেন, "খুনিরা বঙ্গভবনের দোতলায় মাতাল হয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গালাগাল দিচ্ছিলো। এমনকি তাদের মনোরঞ্জনে দুই মাইক্রোবাসে ভরে নাচ-গানের দলও আনা হয়েছিলো।"
^উপরে যেতে ক্লিক করুন