সাকাচৌর রায় ও আদালত অবমাননা

  • মুনতাসীর মামুন
বিচারকরা যেদিন ঘোষণা করলেন সাকাচৌর মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় ঘোষণা করা হবে ২৯ জুলাই, সেদিন থেকে মানুষ রায়ের জন্য একাগ্রচিত্তে অপেক্ষা করেছে। গোলাম আযমের রায়ের পর সম্ভবত সাকাচৌর রায় নিয়েই মানুষ উদ্বিগ্ন ছিল বেশি। প্রশ্ন উঠতে পারে, আদালতে হাই প্রোফাইল কোন মামলা হলেই সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। কারণ, এ ধরনের হাই প্রোফাইল মামলার পক্ষে-বিপক্ষে থাকে রাজনৈতিক শক্তিÑ আওয়ামী লীগের পক্ষের আর বিপক্ষের মানুষজন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এই উদ্বেগ! উদ্বেগের কারণ, ১৯৭৫ সালে মোশতাক-জিয়া দেশটাকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেছেন। মানুষের মনোজগত এত সফলভাবে পাকিস্তানীরা ছাড়া আর কেউ বিভক্ত ও প্রভাবান্বিত করতে পারেনি। জিয়া পাকিস্তানী বাঙালী জাতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন মনোজগতে অস্ত্রোপচার করে এবং তাতে সফলও হয়েছেন। বিচারক, সাংবাদিক, শিক্ষক, সরকারী কর্মচারী সবাই এখন দু’ভাগে বিভক্ত। আপনি বিষয়টি অস্বীকার করতে পারেন; কিন্তু সেটা হবে বাস্তবকে বা সত্যকে অস্বীকার। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কোন বিষয় আলোচনায় এলেই দুটি ভাগ হয়ে যায়। টাকা পয়সার ক্ষেত্রে নয়।

জিয়াউর রহমান আরেকটি কাজ করেছিলেনÑ তা হলো টাকার খেলা। তার দর্শন ছিল, যে কোন মানুষকে টাকা দিয়ে, পদ দিয়ে কেনা যায়। এবং সেটা তিনি প্রমাণও করে গেছেন। এটিও কী অস্বীকার করবেন? এর ধারা কি এখনও চলছে না।
উচ্চ আদালতের অনেক রায় চরম বিতর্কিত হয়েছে, বিচারপতিরাও যখন পদ বা রাজনীতিমনস্ক হয়েছেন। বিচারপতিদের তো নিযুক্তি দেয় সরকার, সামরিক, বিএনপি-জামায়াত বা আওয়ামী লীগ। তারা যখন বিচারক নিয়োগ করেন তখন রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার থাকে না, এটি বলাও বাস্তবকে অস্বীকার। কিন্তু তারপর? এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে পারি। খালেদা জিয়া-নিজামী সরকার আমাকে ও শাহরিয়ারকে গ্রেফতার করে। মুক্তি পেয়ে আমি এবং শাহরিয়ার কবির ৫৪ ধারা, রিমান্ডের অপব্যবহার ও অন্যায় গ্রেফতার-নির্যাতনের জন্য হাইকোর্টে মামলা করি। আমাদের আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। তিনি চমৎকারভাবে শুনানি করেছিলেন এবং মনে হচ্ছিল বেঞ্চ আইনী যুক্তিগুলো মেনে নিচ্ছেন। যেদিন রায় দেয়া হবে সেদিন আদালত সম্পর্কে একটি বিবৃতি ছাপা হয়েছিল দেশের খ্যাতিমান শিল্পী-সাহিত্যিকদের। স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে আমার ও শাহরিয়ারের নামও ছিল। বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক রায় দেয়ার ঠিক আগে জ্যেষ্ঠ বিচারক হামিদুল হককে জানালেন, তিনি বিব্রত বোধ করছেন। আমরা জানতাম বিএনপি আমলে তিনি নিযুক্ত, তখনও কনফার্মড হননি। কিন্তু, আমরা কখনও প্রশ্ন তুলিনি বা ভাবিনি যে তিনি বিচারের সময় কোন পক্ষ নেবেন। তখন কিন্তু বিএনপি আমল। বিচারপতি হামিদুল হক বলেছিলেন [যথাযথ উদ্ধৃতি নয়], আমরা সবাই তো রাজনৈতিক সরকার দ্বারা নিযুক্ত। তাতে কী হয়েছে। নিযুক্তির পর তো আমরা বিচারক, তখন তো আমাদের বিবেক অনুযায়ী বিচার করতে হবে। উক্তিটি যথাযথ আমরা মানি। সে মামলা আর আদালতে তোলা যায়নি। আমাদের আইনজীবী আর আগ্রহী ছিলেন না এই মামলায়। আমরা অনেকবার তাকে অনুরোধ করেছি। কারণ, আইনের কয়েকটি বিষয় সেখানে পরীক্ষিত হতো, মামলার শুরুতে তিনি তাই বলেছিলেন।
যা হোক সে কথা, কিন্তু আমরা যদি বলি রাজনৈতিক কারণে বিচারক বিব্রত হয়েছিলেন তা কি আদালত অবমাননা হবে? কারণ, সুযোগ তো তিনিই করে দিয়েছেন। বিচারপতি মুনএমের পর প্রায় সব [ব্যতিক্রম আছে] প্রধান বিচারপতিই বিতর্কিত হয়েছেন। কেন? সেটি কি বিচারকরা ভেবে দেখেন কখনও।
সাংবাদিক ও বিচারকরা এখন সবচেয়ে ক্ষমতাবান। সাংবাদিকরা যা খুশি লিখতে পারেন, কোন অসত্য সংবাদ ছাপলেও কিছু করার নেই। মাহমুদুর নামে বিএনপি নেতা সম্পাদক হয়ে মিথ্যার পর মিথ্যা ছেপে মানুষজনকে প্ররোচিত করেছেন দাঙ্গা-হাঙ্গামায়। কী হয়েছে? বরং তাকে আইনী প্রক্রিয়ায় গ্রেফতার করা হলেও ১৫জন শক্তিশালী সম্পাদক তার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন। কারণ, সংবাদপত্রগুলোর মালিকদের স্বার্থ ভিন্ন, তারাও কোন না কোনভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত [অন্তত মানসিকভাবে]।
বিচারকরাও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত অবমাননার জন্য যে কাউকে ডাকতে পারেন, শুনানিতে সন্তুষ্ট না হলে দ- দিতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবাই ক্ষমা চেয়ে নেন। কারণ, আদালতের হাঙ্গামায় গেলে শান্তি, অর্থ সবই নষ্ট হয়। কিন্তু কিসে আদালত অবমাননা হয়? সেটি নির্ধারণ খালি বিচারকরাই করবেন? সেটি কি একতরফা হয়ে যায় না? আমেরিকায় রাজনৈতিকভাবে বিচারক নিযুক্ত হন। সেখানেও শুনানি ও রায় নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়; কিন্তু আদালত অবমাননা করা হয়েছে তা তারা মনে করেন না। আরেকটি বিষয় আমরা বলিÑ সাবজুডিস। ধরা যাক, ক নামক মানবতাবিরোধীর বিচার চলছে। অনেক খুনের সঙ্গে সে জড়িত। তার মামলা ধরা যাক চলল পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছর কি আমরা তার খুনখারাবি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে পারব না? এটি কি স্বাভাবিক! আজ যে ১১/১২ জন কুখ্যাত পরিচিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত তাদের কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা সাবজুডিস হলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করা যাবে না পাঁচ বছর? এটি কি স্বাভাবিক?
ভুল করে না থাকলে বলি, ফয়সল মাহমুদ ফায়েজি নামে এক বিচারপতির পরীক্ষা সংক্রান্ত নম্বর জালিয়াতি নিয়ে দৈনিক ভোরের কাগজ রিপোর্ট করেছিল। রিপোর্টারকে ‘মানহানিকর বিষয় ছাপার জন্য’ নানা হেনস্থা হতে হয়েছে। বলা হয়েছিল, বিচারকের এসব নিয়ে রিপোর্ট করা অনুচিত। আমার অপরাধ নিয়ে রিপোর্ট ছাপা হলে যদি মানহানিকর না হয়, তা হলে বিচারকের অপরাধ জনসমক্ষে তুলে ধরলে অপরাধ হবে কেন? একটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া উচিত। হার্ড এভিডেন্স না থাকলে বিচারক নিয়ে কেউ কোন মন্তব্য করেন না, তা কাগজে ছাপাও হয় না। এসব বিষয় নিয়ে রাজনীতিবিদ,আইনজ্ঞ, বিচারকদের ভাবনাচিন্তা করা দরকার।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ট্রাইব্যুনালেই শেষ হওয়া উচিত ছিল, সেটি ছিল স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো, তাদের সুপ্রীমকোর্টে যাওয়ার অধিকার দেয়া। এই অস্বাভাবিকতার উৎস ডিফেন্স মেকানিজম। জিয়া-খালেদা-এরশাদ-নিজামী এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন, রাজনীতিকে টাকা দিয়ে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিলেন, ক্রিমিনালদের এমন শক্তিশালী করে তুলেছিলেন যে, তারা যখন যার বিরুদ্ধে যে কোন ব্যবস্থা নিতে পারতেন এবং তা যৌক্তিক বলে মনে করা হতো। আওয়ামী লীগ আমলে কোন কিছু করার আগে ভাবা হতো বা এখনও হয় যে, এটি কি যৌক্তিক মনে হবে, মানুষজন কি তা গ্রহণ করবে? জিয়া, খালেদা, নিজামী ও এরশাদ ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’কে দলীয় সেøাগান বলে তুলে ধরেছেন। যে কারণে কোন সভায় কেউ যদি জয় বাংলা বলেন তখন ধরে নেয়া হয় যে, তিনি দলীয় ব্যক্তি। এবং এখনও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেকে খোলা গলায় জয় বাংলা বলতে পারেন না। শিল্পী হাশেম খান আমাকে বলেছিলেন, বিএনপি আমলে এক ‘টকশো’তে বক্তব্য শেষে বলেছিলেন ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’। সঞ্চালক বলেছিলেন, ‘হাশেম তুমি তো ঝামেলায় ফেললে।’ সঞ্চালক সজ্জন ব্যক্তি, সবার শ্রদ্ধার পাত্র, আওয়ামী লীগ তাকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেছে। এই হলো আমাদের অবস্থা।
আপনাদের মনে হতে পারে আমি প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি, তা নয়, পরবর্তী আলোচনা যাতে স্পষ্ট হয় তার জন্য পটভূমি হিসেবে প্রসঙ্গগুলো তুলে ধরলাম।
দেশটি ছোট, পরস্পর সবাইকে চেনেন, তার মন জানেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার যখন সুপ্রীমকোর্টে যায় তখনই মানুষ নানা প্রশ্ন করতে থাকে। কে কোন্ বিষয়ে রায় দেবেন সেগুলো আগেই আলোচিত হতে থাকে। বিশেষ করে প্রভাবশালী ও অর্থশালী হলে সন্দেহ বাড়তেই থাকে। যেমন, গোলাম আযমের মৃত্যুদ- হবে না এ বিষয়টি সবাই আলোচনা করেছিলেন। আদালত সে রায়ই দিয়েছিলেন, কারণ হিসেবে যা দেখিয়েছেন তা মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশে বিবেচিত হয় না। সাঈদীর ফাঁসি হবে না, এটিও আলোচিত হয়েছে। হয়নি। কারণ, বিচারকরা মনে করেছেন, যথেষ্ট প্রমাণ ছিল না। আমরা বলতেই পারি, তাদের বিবেচনা যথার্থ নয়। ট্রাইব্যুনালের আইনটিই এমন যে, সেখানে এভিডেন্স এ্যাক্ট প্রযোজ্য নয়। ফৌজদারি মামলার মানসিকতা থেকে বিচারকরা বেরুতে পারেননি। যুদ্ধের সময় ধর্ষণের সাক্ষী কোথায় পাওয়া যাবে? বা গণহত্যার? তবুও রায় তো আমরা মেনে নিয়েছি।
মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেফতারকৃতদের সবাই যত সুযোগ দিয়েছেন, দেন, এমনকি সরকারও, সেটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ পায়নি, পায় না। গোলাম আযম কি আমিরি হালে বন্দীজীবন কাটাননি? সরকার থেকে বলা হলো, ছয় মাসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি বাঞ্ছনীয়। আদালত তা মানেনি। রিভিউর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমরা তো কিছু বলিনি। কিন্তু ক্ষুব্ধ হয়েছি এ কারণে, মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত বিষয়কে আদালত অন্য দশটা পাঁচটা মামলার মতো বিবেচনা করেনি। হয়ত ডিফেন্স মেকানিজম থেকেই বিবেচনাটি এসেছে। আমরা মানবতাবিরোধী সর্বোচ্চ দ- চেয়ে অবশ্যই বিবৃতি দিতে পারি, সেøাগান দিতে পারি, মিছিল করতে পারি। তা কেন সাবজুডিস বা ইন্টারফেয়ারেন্স হিসেবে বিবেচিত হবে। আদালত কি এতই ঠুনকো যে, আমাদের একটি সেøাগান বা মিছিলে ব্যতিব্যস্ত বা প্রভাবিত হবে? বিভিন্ন সময় এসব বিষয় আলোচনায় এসেছে, তাই প্রসঙ্গগুলো আলোচনা করলাম।
  • মুনতাসীর মামুন
রাজনীতিবিদরা বিশেষ করে খালেদা জিয়া এবং তার সঙ্গীরা আদালত নিয়ে প্রচুর আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছেন। কখনও শুনিনি, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত ব্যবস্থা নিয়েছে। গতকালের পর আজ পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি...


সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনের আলোচনায় বিষয়গুলো এসেছে। কারণ, অতীতে সাকাচৌ যা খুশি তা করেছেন, কেউ কোন কথা বলার সাহস রাখেনি। তার অর্থ অজস্র, বিভিন্ন উপায়ে সেগুলো উপার্জিত।
বলা যেতে পারে, তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যার কখনও বিচার হতে পারে এটি কেউ ভাবেনি। তিনি নিজেও ভাবেননি। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, এখনও ভাবছেন না। সরকারী দলের বেশ ক’জন নেতা তার আত্মীয়। আইএসআইয়ের তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি বলে পরিচিত। পাকিস্তানী বাঙালীদের দল বিএনপি-জামায়াত তার পেছনে আছে। তার আত্মীয়রা ব্যবসায়ী, প্রচুর টাকা তাদের, সাকার নিজেরও টাকা প্রচুর। এখন শুধু নয়, আগে বলতেন প্রায়ই যে, তিনি প্রয়াত শেখ কামালের বন্ধু, শেখ হাসিনা তার বোন। এ কারণে প্রকাশ্যে তিনি বলতেন, তিনি রাজাকারের পুত্র। এটা ঠিক রাজাকারের পুত্র ছিলেন বলেই বিএনপি তাকে ওআইসির মহাসচিব পদে মনোনয়ন দিয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, যেহেতু পাকিস্তান ও তার মিত্ররা রাজাকারদের পক্ষে এবং দল হিসেবেও তারা রাজাকারদের প্রতিনিধি সে কারণে জয় সাকাচৌর অবশ্যম্ভাবী। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঐ সময় ঐ নিয়োগের সমালোচনা করায় সাকা বলেছিলেন, ‘বাবু ওআইসি নিয়ে কথা বলার কে? উনাকে ওআইসি নিয়ে কথা বলতে হলে আমি ছোটবেলায় যে জিনিসটা কেটে ফেলে দিয়েছি আগে ঐ জিনিসটা কেটে ফেলতে হবে।’ তার সোনা চোরাচালান নিয়ে কথা উঠলে সাকা জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা কেন আমার সোনা নিয়ে টানাটানি করছেন।’ খালেদা জিয়া সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এতদিন কুকুর লেজ নাড়ে জানতাম, এখন দেখছি লেজ কুকুর নাড়ে।’ বাংলাদেশের এমন কিছু ছিল না যা তার ঠাট্টা তামাশার বিষয়বস্তু হয়নি। শুধু তাই নয়, ছয়বার তিনি ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরকম অশ্লীল প্রভাবশালী অর্থশালী ও মস্তান ব্যক্তির আগমন আগে হয়নি।
সাকাচৌ যা করতেন তা কি রাজনীতি? না, রাজনীতি নয়, মস্তানি। এই মস্তানদের রাজনীতিতে নিয়ে আসেন জেনারেল জিয়া। এসব ব্যক্তিকে রাজনীতিতে পোক্ত করেন জেনারেল এরশাদ। আমার মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে যারা এরশাদকে নির্বাচিত করেন বা সাকাকে, তারা কোন্্ ধরনের মানুষ? এবং যেই রাজনীতিতে এরশাদ-সাকারা রাজনীতি করতে পারেন সেই রাজনীতি কেমন!
সাকা রাজনীতিতে কেমন ত্রাসের সৃষ্টি করেছিলেন তার একটি উদাহরণ দিই। তার মৃত্যুদ-ের রায়ের দিনও তার নির্বাচনী এলাকার মানুষজন ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করেছিলেন। যেখানে খুশিতে বিভিন্ন জায়গায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে সেখানে ঐ এলাকায় মানুষজন ছিলেন নিশ্চুপ। সাকাচৌ কতটা শক্তিশালী বা তার মস্তানিতে কতটা প্রভাবিত একটি দল তা বোঝা যাবে তার মৃত্যুদ-ের রায়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়ায়। বিএনপি এর আগে মানবতাবিরোধী রায়ে খুব একটা প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কিন্তু সাকার রায়ে জানিয়েছে। এই প্রতিক্রিয়াটি আমাদের ভালভাবে পড়া উচিত। এই প্রতিক্রিয়ায় ভালভাবে উন্মোচিত হয়েছে বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্র, লক্ষ্য। সে কারণে, অন্তত রেকর্ডের খাতিরে বিএনপি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপনের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি।
আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, “সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এদেশের একজন জনপ্রিয় ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। তাকে ছয়বার জাতীয় সংসদে তার নির্বাচনী এলাকার জনগণ প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করেছেন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তার কণ্ঠ ছিল সুউচ্চ।
রিপন বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী যেসব অভিযোগ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তিনি তার সংশ্লিষ্টতা সব সময় অস্বীকার করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনি যে দেশে ছিলেন না, এর সপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণাদিও আদালতের বিবেচনায় উপস্থাপন করেছিলেন। ওই সময়ে দেশে তার অনুপস্থিতির দাবির সপক্ষে তিনি দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিককেও সাক্ষী মেনেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি। তা সত্ত্বেও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী অভিযুক্ত হওয়ায় আমরা বিস্মিত।
রিপন বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীদের মতো আমাদের দলও মনে করে, তিনি ন্যায় বিচার লাভ করেননি। অন্যায়ভাবে তাকে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়া হয়েছে। আমরা এ রায়ে সংক্ষুব্ধ ও সত্যিই মর্মাহত। আমাদের দল মনে করে তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। আমাদের দল আরও মনে করে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচারে আইনী স্বচ্ছতার অভাব ও নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে।” [জনকণ্ঠ ৩০.৭.১৫]
১. সাকাচৌর রাজনীতিকে মস্তানি বা ক্রিমিনালের রাজনীতি না বলে বলতে হবে, ‘দেশ ও কল্যাণের রাজনীতি’।
২. কোন্্ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনি ছিলেন সোচ্চার? বাংলাদেশের? একটি উদাহরণও দেয়া যাবে না। রিপন বোঝাতে চেয়েছেন, সাকাচৌ পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সোচ্চার, যেটি বিএনপি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে।
৩. মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সাকাচৌ দেশে ছিলেন না এমন একটি মিথ সব সময় তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। আসলে, তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যখন তার ওপর আক্রমণ করেন ও আহত করেন তখন তিনি পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগে হত্যা-লুণ্ঠন যা করার তিনি করেছেন এবং সেসব তথ্য প্রমাণ দেয়া হয়েছে। এ্যাটর্নি জেনারেলও দিয়েছেন। সুতরাং বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি এটি অসত্য।
৪. সাকাচৌ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। অর্থাৎ সরকার আদালতের মাধ্যমে রায় দিয়েছে। অর্থাৎ আদালত রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছে, আইনকে নয়। এটি আদালত অবমাননা। শুধু তাই নয়, এটি ভবিষ্যতে জুডিসিয়াল মার্ডার হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে বলে মনে করে বিএনপি। বাংলাদেশের কোন আদালতে এমন কোন উদাহরণ নেই। তারা প্রত্যাশা করছেন, রিভিউতে সাকাচৌ মুক্তি পাবেন। সাকাচৌও তা বিশ্বাস করেন। রিপনের বক্তব্যের কোন প্রতিক্রিয়া আদালত দেখায়নি।

(৩)
সাকাচৌ কেন সব কিছু প্রভাবিত করতে পারেনÑ এ ধারণা কেন গড়ে উঠছিল তার পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করলাম। স্বাভাবিক কারণেই আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম। এবং এ নিয়ে নানা গুজব পল্লবিত হয়েছিল, আদালত ঘিরেও। এর কোন কারণ ছিল না এমন বলা যাবে না। আমাদের জোর-জবরদস্তি করলে আমরা সেগুলো বলতে বাধ্য হব। কিন্তু আমরা চাই না সেগুলো আলোচিত হোক। আমরা সুষ্ঠু বিচার চাই দেখেই আদালতে গেছি। আদালতের ভাবমূর্তি বিপন্ন করতে চাইনি। আদালত একটি প্রতিষ্ঠান এ কথা আমরা মনে রাখি। আশা করি আদালতের সঙ্গে যারা যুক্ত আইনজীবী ও বিচারক তারাও সেটি মনে রাখবেন।
যেদিন রায় হয় সেদিন আমি দেশের বাইরে। ২৯ তারিখ সকাল ৯ টায়ই সহকর্মী চৌধুরী শহীদ কাদেরকে বললাম ইন্টারনেট দেখতে। মুহূর্তে জানা গেল সাকাচৌর দ-াদেশ বহাল আছে। এ রায় জানার পর আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নাস্তা করতে বসলাম।
পরদিন ঢাকা এসে শুনি এবং কাগজে দেখি দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় ও সম্পাদক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে আদালত অবমাননায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ খবর শুধু আমাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মহলকে ক্ষুব্ধ ও বিব্রত করেছে। শত ডামাডোলেও দৈনিক জনকণ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার, অন্য কাগজ নয়, সেটিকেই অভিযুক্ত করা হলো। কেন? কেন বিচারকরা মনে করেছেন এই দুই সম্পাদক আদালত অবমাননা করেছেন? তবে এর মানে এ নয় যে, সেই কাগজ আদালত অবমাননা করবে।
আমরা মামলা নিয়ে আলোচনা করব না, কিন্তু আদালত যে অভিযোগ করেছে তাতে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে যা নিয়ে অবশ্যই এ্যাকাডেমিক আলোচনা করা যেতে পারে, অবশ্যই আইনের এবং মানুষের স্বার্থে। আদালত বলে, নিবন্ধে বলা হয়েছে, “প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আদালতের গঠনমূলক সমালোচনা করা যাবে। তাই তার কাছে বিনীত প্রশ্ন, ১৪৩ জনকে পুড়িয়ে মারার অন্যতম হুকুমের আসামি কিভাবে চিকিৎসার জন্য জামিন পায়। জমির আইল নিয়ে লাঠি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে হাজার হাজার দরিদ্র আসামি যেখানে বছরের পর বছর জেলে আটকা, সেখানে রাজনীতির নামে প্রকাশ্যে এই ১৪৩ জনকে খুন করার পরেও সে জামিন পাবে! এই কি বিচারের ন্যায়দ-! বিচারকরা নিশ্চয়ই জানেন, কেন তারা পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে এভাবে নৃশংস হত্যাকা- চালাচ্ছে। বাস্তবে এটা আইএসের পদ্ধতি। আইএস সবখানে এভাবে ভয়াবহ নৃশংসতা সৃষ্টি করে দেশের মানুষকে পাজলড করে দিতে চায়, যাতে কেউ প্রতিরোধে এগিয়ে না আসে। ফখরুলের জামিনের ভেতর দিয়ে বিচারকরা কি বাংলাদেশকে আইএসের পথে অগ্রসর হওয়ার সুবিধা করে দিলেন না? এসব ঘটে কি ফখরুলের টাকা আছে বলে আর যারা জমির আইল নিয়ে মাথা ফাটায় ওদের টাকা নেই বলে?
এখানেই শেষ নয়। ’৭১-এর অন্যতম নৃশংস খুনী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। নিষ্পাপ বাঙালীর রক্তে যে গাদ্দারগুলো সব থেকে বেশি হোলি খেলেছিল এই সাকা তাদের একজন। এই যুদ্ধাপরাধীর আপীল বিভাগের রায় ২৯ জুলাই। পিতা মুজিব তোমার কন্যাকে এখানেও ত্রুুশে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। তাই যদি না হয়, তা হলে কিভাবে যারা বিচার করেছেন সেই বিচারকদের একজনের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে সালাউদ্দিন কাদেরের পরিবারের লোকেরা। তারা কোন্্ পথে বিচারকের কাছে ঢোকে। আইএসআই ও উলফার পথে, না অন্য পথে। ভিকটিমের পরিবারের লোকদের কি কখনও কোন বিচারপতি সাক্ষাত দেন। বিচারকের এথিকসে পড়ে। কেন শেখ হাসিনার সরকারকে কোন কোন বিচারপতির এ মুহূর্তের বিশেষ সফর ঠেকাতে ব্যস্ত হতে হয়। সে সফরের উদ্যোক্তা জামায়াত-বিএনপির অর্গানাইজেশন। কেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী আগে গিয়ে সেখানে অবস্থান নেন। কি ঘটেছে সেখানে। ক্যামেরনই পরোক্ষভাবে বলছেন সকল সন্ত্রাসীর একটি অভয়ারণ্য হয়েছে লন্ডনে।
এ মন্তব্যগুলো শুধুমাত্র আদালতের বিশ্বস্ততা ও নিরপেক্ষতার জন্য হানিকর নয়, বরং উচ্চ আদালতের বিচারকদেরও হেয় করে এবং তাতে করে আদালতের কর্তৃত্বকেও খর্ব করে। সে অনুযায়ী আদালত ২০১৫ সালের ১৬ জুলাইয়ের দৈনিক জনকণ্ঠে ‘সাকার পরিবারের তৎপরতা ॥ পালাবার পথ কমে গেছে’ শিরোনামের নিবন্ধের লেখক স্বদেশ রায় এবং দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে (এম এ খান মাসুদ) ৩ আগস্ট ২০১৫ তারিখে সকাল ৯টায় আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেন আইনী ব্যবস্থা নেয়া এবং আদালত অবমাননার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দিচ্ছে।’ [জনকণ্ঠ ৩০.৭.১৫]
আদালত মনে করছেন, দুটি ক্ষেত্রে অবমাননা হয়েছে। একটি মির্জা ফখরুলের ক্ষেত্রে মন্তব্য করায়, অন্যটি সাকাচৌকে নিয়ে মন্তব্য করায়। স্বদেশ রায় আমাদের অনুজ, বন্ধু। তিন দশক সাংবাদিকতা করছেন। কোথায় কী লিখতে হবে সে ক্ষেত্রে আমাদের থেকে তিনি বেশি সচেতন। আমরা যারা কলাম লিখি তাদের অনেকেই কোন না কোন সময় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সুতরাং আদালত সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট সতর্ক থাকি। আমাদের চেয়ে আইনজীবীরা গত তিন দশকে আদালতে এমন অনেক কিছু করেছেন যা অবমাননামূলক কিন্তু যার বিরুদ্ধে কোন বেঞ্চ কখনও কোন মন্তব্য করেনি। স্বদেশ রায় এ বক্তব্যে খুব স্পষ্ট করে তার প্রশ্ন করেছেন, আমরা যারা সাকাচৌ নিয়ে লিখেছি তারা প্রশ্নটি অস্পষ্ট রেখেছি। স্বদেশ রায় জনকণ্ঠে লেখার আগে সাউথ এশিয়ান মনিটরে একই বিষয়ে লিখেছেন।
হ্যাঁ, আদালত মনে করতে পারেন, স্বদেশের লেখায় আদালত অবমাননা হয়েছে, যদি তাঁর বক্তব্যে সত্য না থাকে। তবে আদালতের কর্তৃত্ব খর্ব হয়নি। একজন লেখক আদালতের কর্তৃত্ব খর্ব করতে পারেন না, রাজনীতিবিদরা সমষ্টিগতভাবে পারেন সংসদের মাধ্যমে। এখানে একটি প্রশ্ন মনে হলো, রাজনীতিবিদরা বিশেষ করে খালেদা জিয়া এবং তার সঙ্গীরা আদালত নিয়ে প্রচুর আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছেন। কখনও শুনিনি, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত ব্যবস্থা নিয়েছে।
১. খালেদা বলেছেন- ‘বিচারপতি খায়রুল হক বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছেন। তিনি টাকার বিনিময়ে রায় দিয়েছেন। খায়রুল হক যেন মনে না করেন সারাজীবন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে।’ [জনকণ্ঠ ৩.১.২০১১]
২. বিচারপতিদের উদ্দেশে বেগম জিয়া, ‘আওয়ামী লীগের কথা মতো চললে সেটা ঠিক হবে না। আপনারা জনগণের পক্ষে থাকুন। ভুলে যাবেন না আপনারাও মানুষ। একদিন মরতে হবে। আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবেন। [ঐ ১৯.১২.২০১৪]
৩. খালেদা আরো বলেছেন, একদেশে দুই আইন চলছে। বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। বিচারপতিরা আজ চেহারা দেখে বিচার করছেন। আওয়ামী লীগ হলে তারা গুম-খুন-হত্যা যা-ই করুক না কেন, তাদের সব কিছু মাফ। আওয়ামী লীগের জন্য একরকম আইন ও বিএনপির জন্য অন্যরকম আইন। [দিনকাল, ১৯.১২.২০১৪]
৪. খালেদা আরো বলেছেন, বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে ঠিকই কিন্তু বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়নি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এখনো খর্ব হচ্ছে। বরং এখন আরো বেশি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতেই সরকার বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা পার্লামেন্টের কাছে হস্তান্তর করেছে। ...সরকারি দলের হলে একরকম বিচার হয় আর বিরোধী দলের বা সাধারণ মানুষ হলে অন্য রকম বিচার হয়। [নয়া দিগন্ত, ০৫.০৭.২০১৫]
৫. খালেদা বলেছেন, আজ বিচার হয় দুই রকমের। সরকারী দলের হলে একরকম, আর বিরোধী দল হলে ভিন্ন রকম বিচার হচ্ছে। তারা জামিন পায় না, দিনের পর দিন কারাগারে থাকতে হচ্ছে। বিরোধী নেতাকর্মীরা সুবিচার পায় না। [দিনকাল, ২১.০৭.২০১৫]
আরও আছে। সংক্ষিপ্ত সময় দেখে আরও উদাহরণ দেয়া গেল না। এ ধরনের বক্তব্য শুধু খালেদা নন, অনেক রাজনীতিবিদই দিয়েছেন।
প্রথমে আসা যাক মির্জা ফখরুলের বিষয়ে। আমি তো মনে করি, পাকিস্তানী বাঙালীদের রাজনীতি করতে দেয়াই উচিত নয় গণতন্ত্র ও দেশের স্বার্থে। অবশ্য রুলিং পার্টি তা মনে করে না। এ বিষয়ে রুলিং ও অপজিশন পার্টি সব এক। যাক সে অন্য প্রসঙ্গ। প্রসঙ্গ হলো-
১. খালেদা-ফখরুল যে গৃহযুদ্ধের অবতারণা করেছিলেন সেখানে ১৪৩ জন নিহত হয়েছিল কিনা? উত্তর, হয়েছিল। এ সংখ্যা মনে হয় খানিকটা কম। অগ্নিদগ্ধ হয়েছিল কতজন? এরকম বীভৎস অবস্থা আগে কখনও হয়েছিল কিনা? নিরাপত্তারক্ষী মারা গিয়েছিল ক’জন? সুতরাং বিষয়টি অসত্য নয় এবং ঐতিহাসিক সত্য।
২. এইভাবে তারা প্ররোচনা দিয়েছিলেন কিনা? গোলাম আযমকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির দায়ে। ফখরুলের দায় সেরকম কিনা!
৩. পাকিস্তানী-বাঙালীদের দল বিএনপি-জামায়াত জঙ্গী মৌলবাদকে সমর্থন করে কিনা? আগে এ প্রশ্নের সমাধান হতে হবে। কে কি মনে করলেন তাতে মাথা না ঘামিয়ে বলা যেতে পারে, এটি ঐতিহাসিক সত্য। জামায়াতকে মার্কিন কংগ্রেসে ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন বলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে একই কথা বলা হয়েছে। অভিযুক্ত সবাই বিএনপি-জামায়াত নেতা। আমরা এ দেশে জঙ্গী মৌলবাদ চাই না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আদালতও চান না। তা হলে এদের ক্ষেত্রে কেন নমনীয়তা প্রদর্শিত হবে? পত্রিকায় পড়েছি, অনেক জঙ্গীকে জামিন দেয়া হয়েছে। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী যতদূর মনে পড়ে, আদালতে এভাবে জঙ্গীদের জামিন দেয়ার বিরোধিতা করেছিলেন। এবং বলেছিলেন এটি ঠিক নয়। এ নমনীয়তা জঙ্গীদের সহায়তা করে কিনা? এটি কি আগে উল্লিখিত সেই ডিফেন্স মেকানিজম?
একটি উদাহরণ দিই। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার প্রথম আমলে চারজন বিএনপি নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের পক্ষে রিট করলে, বিচারপতি তাদের শুধু মুক্ত নন, সরকারকে এক লাখ টাকা করে প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দিতে বলেন। আমি ও শাহরিয়ার যখন রিট করি বা আমাদের মুক্তির জন্য যখন রিট করা হয় তখন আমাদের মুক্তি দেয়া হয়, কিন্তু ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। বিচারক তাঁর রায়ে তা বলেননি। এর অর্থ, একই বিষয়ে ভিন্ন রায় হতে পারে। তা হলে রায়ে কি একজন সুবিধা পাবে আরেকজন পাবে না? আলাদা ক্ষতিপূরণ মামলার রায়ের সময় বিএনপি আমলে নিযুক্ত বিচারক বিব্রতবোধ করায় সে মামলা আর চলেনি। এসব কারণেই এ ধরনের প্রশ্ন ওঠে?
তারিখ: ০৫/০৮/২০১৫
  • মুনতাসীর মামুন
আদালত একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তির কারণে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি না হয় সেটি আমাদের সাংবাদিকদের যেমন ভাবা উচিত, তেমনি বিচারকদেরও। গতকালের পর আজ পড়ুন শেষ কিস্তি...

৪. গরিবরা কি বিচার পায়? পায় না। পত্রিকায় দেখেছি অনেক গরিব নিরপরাধ এক দশক বা দু’দশকের বেশি জেলে পড়ে আছেন কোন শুনানি ছাড়া। ব্যবহারজীবীরা তাদের কাজের জন্য পারিশ্রমিক নেবেন ঠিক আছে, কিন্তু একবার মক্কেল ধরতে পারলে তার কি হেনস্থা হয় বিচারকরা নিশ্চয় তা জানেন। কারণ, তারা আগে ব্যবহারজীবী ছিলেন। এখানে মিথ্যা কি হলো? গরিবদের আইনজীবীরা পাত্তা দেন, এমন আশ্চর্য কথা কেউ কখনও শুনেছে। গরিব দূরের কথা, শুনেছি স্বদেশের পক্ষে এফিডেভিট ও দাঁড়াবার জন্য আওয়ামী লীগ নামধারী কাউকে রাজি করানো যায়নি। অথচ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলবদলকারী জনৈক রায় চৌধুরীর কাছে নামী-অনামী, দামী-অদামী আইনজীবীরা ধর্ণা দেন তাদের সহায়তা করার জন্য। আমি এসব বিশ্বাস করি না। শুনে একজন বলল, তাহলে আপনাকে কি রেকর্ড করে শোনাব?
যাক, আমি এসব আলোচনা করব না। কারণ, আমার ক্ষেত্রে নামী-অনামী অনেক আইনজীবী দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বেচ্ছায়। আমি তাদের কাজে কৃতজ্ঞ।
সালাউদ্দিন কাদের নিয়েও মন্তব্য করেছেন স্বদেশ রায়। হ্যাঁ, সাকাচৌ নিয়ে কেন সবার মধ্যে উদ্বেগ ছিল তার কথা আগেই বলেছি। তারপরও বলা যেতে পারে স্বদেশ যে অভিযোগ তুলেছেন তা গুরুতর এবং আদালতের তাতে ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। স্বদেশ লিখেছেন- ‘কিভাবে যারা বিচার করছেন সেই বিচারকদের একজনের সঙ্গে দেখা করে সালাউদ্দিন পরিবারের লোকেরা?’
১. স্বদেশ কারো নাম উল্লেখ না করলেও চারজনের বেঞ্চের সবাই মনে করতে পারেন তাদের কাউকে না কাউকে উদ্দেশ করে মন্তব্য করা হয়েছে। এই মন্তব্য অবশ্যই ক্ষুব্ধ করতে পারে তাদের, বিশেষ করে যেখানে এ ধরনের সাক্ষাত গ্রহণযোগ্য নয়।
২. এরই মধ্যে কোন বিচারককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিনা পাকিস্তানী বাঙালী অধ্যুষিত কোন প্রতিষ্ঠান থেকে? যেখানে ‘মিটিং’ হতে পারে। লন্ডন থেকে আমাকেও খবরটি জানানো হয়েছিল, কিন্তু আমি একটু ভীতু টাইপের দেখে এটি উল্লেখ করিনি। তবে, ঐ ধরনের কোন বিষয় হলে সে সব কাগজপত্র থাকবে।

॥ চার ॥
স্বদেশের মামলা আইন যেভাবে চলে সে ভাবেই চলবে। কিন্তু প্রশ্নগুলো কেন ওঠে তাও বিচার্য।
১. মানবতাবিরোধী অপরাধে একই অভিযোগে সব অভিযুক্তকে একই ধরনের দ- দেয়া হয়েছে, না ব্যতিক্রম করা হয়েছে? যদি করা হয়ে থাকে তা’হলে সেটি গ্রহণযোগ্য কিনা?
২. ট্রাইব্যুনাল ও উচ্চ আদালতে অনেক ক্ষেত্রে শুনি, সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে অভিযোগ বাতিল বা দ- হ্রাস বা বাতিল। এ প্রশ্ন কেন আসে? যেখানে ফৌজদারি মামলার এভিডেন্স অ্যাক্ট আদৌ প্রযোজ্য নয়।
৩. উচ্চ আদালতের বিচারক খালাস দিয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধীকে। অথবা একমত হননি। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের উদাহরণ আছে কিনা? একটি আছে। টোকিও ট্রাইব্যুনালে ভারতীয় বিচারক রাধাবিনোদ পাল জাপানের অপরাধ সম্পর্কে একমত হননি। জাপানীরা তারা ভাস্কর্য গড়েছে। এটি গ্রহণযোগ্য কিনা? সাঈদীর মৃত্যুদ- রদ কেউ মানতে পারেনি। কেননা এ রায় ইতিহাসের বিরুদ্ধে।
গণহত্যায় একজন জড়িত, ইতিহাস সাক্ষী আর বলা হবে তিনি অভিযুক্ত নন, বা নীরব থাকবেন এটা হতে পারে? আইন ইতিহাসের বিরুদ্ধে যেতে পারে? আইনতো মানুষের সৃষ্টি। কিন্তু, আদালতের স্বার্থে আমরা মেনে নিয়েছি। অথচ, এ ধরনের ঘটনা দেশজুড়ে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে। তখন তার দায় কে নিবেন? আমরাই বরং বলেছি এই স্বদেশ রায় শুদ্ধ যে, আদালতে গেছি, পছন্দ না হলেও আদালত মানতে হবে।
স্বদেশ রায় দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি মাহমুদুর রহমান টাইপ নন। এটা কি সম্ভব কোন প্রমাণ ছাড়া তার মতো সাংবাদিক এ ধরনের মন্তব্য করবেন? যদি করেন তবে তিনি বুদ্ধিমান এবং সতর্ক এমন বলা যাবে না এবং তার কাফফারা তাকে দিতে হবে। এটি বিবেচনায় নেয়া উচিত এবং বিষয়টি ভেবেচিন্তে সময় নিয়ে নিষ্পত্তি করা উচিত। কোন পক্ষেরই আবেগতাড়িত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
স্বদেশ রায় যাই লিখুন, আমরা যাই ভাবি না কেন, সাকাচৌর ক্ষেত্রে বিচারকরা কিন্তু ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখেছেন। অর্থাৎ প্রমাণিত হয়েছে আমরা যাই বলি না কেন, যাই লিখি না কেন বিচারকরা ইতিহাস ভোলেননি, ইতিহাসের পক্ষে গেছেন, সে কারণে মানুষ মনে করেছে তারা ন্যায় বিচার পেয়েছেন। এবং আমরা যা ভেবেছি, লিখেছি তা ভুল। তারা ন্যায়ের পক্ষে। নতুনভাবে আস্থা পেয়েছে সবাই আদালতে এবং আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, যে যাই বলুক না কেন মানবতাবিরোধী অপরাধীরা ছাড় পাবে না, কেননা আদালত ইতিহাসের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে না। কিন্তু আদালত অবমাননা সমন সমস্ত কিছুকে ওলটপালট করে দিয়েছে।
সাংবাদিকতার বিষয়ে আরেকটি উদাহরণ দিতে চাই। সাংবাদিকতার জগত এখন আমূল বদলে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যম বলতে আমরা পত্রপত্রিকা ও টিভি বুঝি। সে জন্য কোন পত্রিকা বা কোন টিভিতে বিতর্কমূলক, মানহানিকর সংবাদ প্রকাশ করলে তাকে চিহ্নিত করতে পারি। কিন্তু এখন ফেসবুক ও ইন্টারনেটের কারণে সব কিছু বদলে যাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে খবর চলে যাচ্ছে ইন্টারনেট ও ফেসবুকে। সেখানে নানান খবর, ব্লগ, নিজের তোলা ছবি- সবই আপলোড করা হচ্ছে। এর ফলে সাক্ষ্য আইন সম্পর্কে প্রচলিত ধ্যান-ধারণাও বদলে যাচ্ছে। ভারতের ‘তেহলিকা’য় ভিডিওতে চিত্রধারণ করে খবর প্রচার করে অনেক মন্ত্রীর সর্বনাশ করা হয়েছে। সেলফোনে গোপনে কথোপকথন রেকর্ড বা ছবি তোলা হচ্ছে। মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়ছে, যে কারণে স্বৈরাচারী শাসকরা আগের মতো খবর চেপে রাখতে পারছেন না। এটিকে বলা যেতে পারে ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’। বাংলাদেশে এখন ইন্টারনেট কাগজের সংখ্যা কত সরকারও তা জানে কিনা জানি না। অসংখ্য ইন্টারনেট সংবাদপত্রে সত্য-মিথ্যা নানান খবর ছাপা হচ্ছে। কেউ পারছে তা থামাতে? সরকারই পারছে না। আদালত পারবে তাদের আদালত অবমাননার আওতায় আনতে? পারবে না। অথচ, এদের পাঠক প্রচলিত ছাপা বিদ্যুতায়ন মাধ্যম থেকে বেশি। ধরা যাক, কোন বিচারক নির্দিষ্ট একটি কাগজকে আদালত অবমাননার আওতায় আনলেন, ইন্টারনেট কাগজকে নয়। তাহলে কি ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয় না? বিষয়গুলো সবার ভেবে দেখা দরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট আইন ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও প্রয়োজন। এখন আমাদের প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। সরকার সমস্ত ফোন টেপ করার অধিকার রাখে। এ নিয়ে আমেরিকায় দারুণ হৈচৈয়ের পর গোপনে টেপ করার আইন বাতিল হয়েছে। আমরা মনে করি সাংবাদিক, বিচারক সবাইকে কম আবেগপ্রবণ ও স্পর্শকাতর হতে। কারণ, বন্যা-নিরোধক বাঁধ খুলে গেলে একবার, বন্যায় সব একাকার হয়ে যাবে। আমরা কেউ মনে রাখি না ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী এবং ইতিহাস তা মনেও রাখে না। ব্যক্তির বা সামগ্রিক অর্জনই টিকে থাকে।
আমরা মনে করি, আদালত একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তির কারণে, প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি না হয় সেটি আমাদের, সাংবাদিকদের যেমন ভাবা উচিত, তেমনি বিচারকদেরও। তারা বিজ্ঞ দেখে বিচারক। আমরা ফালতু, অনেক কথা বলতে পারি, মিছিল করতে পারি, সেøাগান দিতে পারি, কিন্তু সংসদ বা নির্বাহীর মতো আদালত প্রতিক্রিয়া জানালে প্রতিষ্ঠান অজস্র প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। বিচারকরাও তো মানুষ। আমরা সে পরিস্থিতি চাই না। বেশি স্পর্শকাতর হলে বিপদ।
এ মন্তব্য সত্ত্বেও বলব- এদেশে নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগ থেকেও উর্ধে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লাখ শহীদ, ৬ লাখ নির্যাতিত নারী, অগণিত আহত। এদের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ। আজ যিনি মন্ত্রী, জেনারেল, শিক্ষক, ব্যাংকার, বিচারক সবার ভিত্তি ঐ রক্তস্রোত। এর বিরোধিতা যিনি করবেন তিনিই সেই বাঙালীর প্রতিরোধের সম্মুখীন হবেন। এ কথা যেন আমরা মনে রাখি।


^উপরে যেতে ক্লিক করুন