১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপট ও অপপ্রচার

বিএনপি এবং জামায়াত জোট প্রায়ই অভিযোগ করে থাকে যে, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের জন্য কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ সরকারই দায়ী ছিল। এ মিথ্যা অভিযোগটি প্রকৃতপক্ষে কতটুকু সত্য?

তাদের মিথ্যা অভিযোগ হল “চোরাচালানের মাধ্যমে বিপুল পরিমান খাদ্যশস্য ভারতে পাচারই দুর্ভিক্ষের মূল কারণ। বঙ্গবন্ধুর সরকার চোরা-চালানকারীদের বাধা দেয়নি কারণ তারা নাকি সবাই আওয়ামীলীগের কর্মী বা সদস্য ছিল”।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর, বঙ্গবন্ধুর নামে যে কুৎসা রচনার প্রতিযোগীতা শুরু হয় তারই ধারাবাহিকতায় এই অবান্তর ও অতিরঞ্জিত কাহিনী প্রচার করে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিকে খাটো করার অপচেষ্টা চালানো হয়। খালেদা জিয়া, এরশাদ বা জামায়াত-শিবির তথা স্বাধীনতা বিরোধীরা সবাই এই অপপ্রচারে অংশগ্রহণ করেছেন। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় বোবা বাসন্তীকে জাল পরিয়ে আফতাব আহমেদের সেই বিখ্যাত ছবিও এসব ষড়যন্ত্র এবং অপপ্রচারেরই একটি অংশ ছিল। যার স্বরূপ পরবর্তীতে জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়েছে।


যা হোক, সত্যিকারের ইতিহাস হল, ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী কারণগুলো আসলে বাংলাদেশ সরকারের আয়ত্ত্বের বাইরে ছিল। একটি বড় কারন হল ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশাল বন্যা। দ্বিতীয় বিষয়টি পরে জানা যায়, ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত আমেরিকার কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশানস এর ত্রৈমাসিক পত্রিকা ''ফরেন এ্যাফেরার্স'' এর এক গবেষণামূলক নিবন্ধে, যেখানে এমা রথসচাইল্ড বিচিন্ন সরকারী দলিলপত্র দিয়ে প্রমাণ করেন যে, ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের প্রায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্যে দায়ী ছিল আসলে মার্কিন সরকার। তারা বাংলাদেশের সাথে কিউবার পাট রপ্তানির চুক্তির কারনে খাদ্য সহযোগিতা করতে নাকচ করে দিয়েছিল। এমা রথসচাইল্ডের ‘ফুড পলিটিক্স’ শিরোনামের গবেষণালব্ধ নিবন্ধটি বিস্তারিত পড়তে ক্লিক করুন- https://www.foreignaffairs.com/articles/1976-01-01/food-politics

সাধারনত যখন খাদ্য সহায়তা পাওয়া যায় না তখন সবচেয়ে দুঃস্থ রাষ্ট্রগুলিও বাণিজ্যিক বাজারে খাদ্য ক্রয় করবে। ১৯৭৪ সালে বিশ্বের ৩২ টি দরিদ্র রাষ্ট্র, যাদের অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের মার্কিন কৃষি পণ্য ক্রয় করেছিল। তারা ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাণিজ্যিকভাবে কৃষি পণ্য আমদানি তিনগুন করেছিল, যাকে সিআইএর বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে বলা যেতে পারে, গমের বাণিজ্যের শো-রুমগুলিতে ব্যাপক অভিবাসন।

যা হোক, পরবর্তীতে বাংলাদেশ ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সালে বাণিজ্যিক বাজার থেকে আমেরিকান খাদ্যশস্য ক্রয় করেছিল দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করার জন্য। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপট বিশৃঙ্খলার ফলাফল বর্ণনা করে, যেখানে খাদ্য নীতি উদ্দেশ্যহীনভাবে বাজারে গৃহীত হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের প্রথমাংশে বাংলাদেশ সরকার গমের আমদানি চাহিদা পূরণের জন্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ করেছিল। বিদ্যমান উচ্চ বাজার দরের এই ক্রয়গুলো স্বল্প মেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করার কথা ছিল। ১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মে বাংলাদেশ সরকার, যা তখন চরম বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ছিল, এই ঋণটি পেতে ব্যর্থ হয়। যার ফলশ্রুতিতে, আমেরিকান গম কোম্পানিগুলোর দুইটি বৃহৎ বিক্রয় যেগুলো শরতে সরবরাহের কথা ছিল সেগুলো বাতিল করা হয়। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঋণ পেতে ব্যর্থ হয়।

অন্যদিকে, অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দরে দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খাদ্য বাজার থেকে কিনে আনা শস্য বোঝাই জাহাজ ডুবে যায়। যেসব কারনে বঙ্গবন্ধুর শত চেষ্টা সত্ত্বেও যুদ্ধ বিধ্বস্ত এই দেশের ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকে পুরোপুরি মোকাবেলা করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু সুখের বিষয় হচ্ছে, এই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই, বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ।

তবে বিএনপি-জামায়াত যে, কোন হোমওয়ার্ক ছাড়াই মিথ্যা গুজব ছড়ায় তা ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের প্রোপ্যাগান্ডার মাধ্যমেই প্রথমে প্রমাণিত হয়েছে। আসলে যখন নিজের অপকর্ম লুকানোর জন্যে অন্যকে খারাপ বলা হয়, তখন অবস্থা এমনই হয়। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, বিষয়টি হচ্ছে নিজের দালালি জায়েজ করার জন্য অন্যকে দালাল বলে গালি দেওয়ার মতো।

পরিশেষে, আশা করি, স্বাধীনতা বিরোধীরা আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে তাদের এসব মিথ্যাচার এবং গুজব ছড়ানোর ঘৃণ্য আদর্শ ও নীতি থেকে বেরিয়ে আসবেন এবং সুস্থ ও আদর্শভিত্তিক রাজনীতি চর্চা করবেন। তাদের বোঝা উচিত মিথ্যাচার এবং গুজবের উপর ভিত্তি করে রাজনীতি করে বেশীদিন টিকে থাকা যায় না। এসব অসুস্থ ও ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি চর্চাকারীদের একদিন এদেশের সাধারন মানুষেরা বর্জন করবেই। হয়তোবা সেই দিন আর খুব বেশী দূরে নয়...।
^উপরে যেতে ক্লিক করুন