আধুনিক পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ

 আধুনিক পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ


বাংলা নাম: স্ট্রবেরি
ইংরেজি নাম: Strawberry
বৈজ্ঞানিক নাম: Fragaria ananasa
পরিবার: Rosaceae

স্ট্রবেরি সারা বিশ্বব্যাপি একটি জনপ্রিয় ফল। স্ট্রবেরি সাধারণত শীত প্রধান দেশের ফল। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে বর্তমানে নানা জাত উদ্ভাবিত হয়েছে যা শীতপ্রধান এমনকি ট্রপিক্যাল পরিবেশেও চাষ করা যেতে পারে। প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে প্রায় ২,০০,০০০ হেক্টর জমিতে স্ট্রবেরি চাষ হয় এবং প্রায় ৩০ লক্ষ মে. টন স্ট্রবেরি উৎপাদিত হয় (FAOSTAT, Database, 2011)। স্ট্রবেরি উৎপাদনে আমেরিকা প্রথম (২৭%)। এছাড়াও জাপান, রাশিয়া, পোল্যান্ড এবং সাম্প্রতিক বাংলাদেশেও অনেক স্ট্রবেরি চাষের ব্যাপারে ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।


স্ট্রবেরি অত্যন্ত রসালো ও সুস্বাদু ফল। স্ট্রবেরি গাছ দেখতে অনেকটা থানকুনি অথবা আলু গাছের মত, তবে পাতা আরো বড় এবং চওড়া। থানকুনি গাছের মতই রানারের মাধ্যমে এর চারা চারদিকে ছড়াতে থাকে। পাশ থেকে বের হওয়া পরিণত রানার কেটে আলাদা লাগিয়ে এর চাষ করা সম্ভব। তবে এর বীজ বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে। একটি স্ট্রবেরি গাছ থেকে রানারের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করলে বছরে কয়েকশত চারা ‍উৎপাদন করা সম্ভব। স্ট্রবেরি শীত প্রধান দেশের ফল তাই বেশি তাপমাত্রার কারণে বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এ গাছ বাঁচিয়ে রাখা খুব কষ্টসাধ্য। স্ট্রবেরি ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকা অবস্থায় টকটকে লাল রঙের হয়। ফলটি দেখতে অনেকটা লিচুর মত। স্ট্রবেরি জীবন রক্ষাকারী নানা পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। এতে আছে ভিটামিন এ, সি, ই, ফলিক এসিড, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম, পলিফেনল, এলাজিক এসিড, ফেরালিক এসিড, কুমারিক এসিড, কুয়েরসিটিন, জ্যান্থোমাইসিন ও ফাইটোস্টেরল। এদের মধ্যে এলাজিক এসিডে ক্যান্সার, বার্ধক্য, যৌনরোগ প্রতিরোধের গুণাগুণ আছে বলে জানা গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম. মনজুর হোসেন ১৯৯৬ সালে জাপান থেকে একটি স্বল্প দিবা দৈর্ঘ্য জাতের স্ট্রবেরি বাংলাদেশে আবাদের চেষ্টা করেন।

সংগ্রহ
স্ট্রবেরি নন-ক্লাইমেটিক ফল। স্ট্রবেরি দ্রুত পচনশীল ফলগুলোর অন্যতম। স্ট্রবেরি সংগ্রহের পর পরিপক্ক হয় না। সুতরাং ফলটিকে সঠিক পরিপক্কতার পর্যায়ে সংগ্রহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্ট্রবেরি গাছ রোপণের ৩-৪ মাস পর থেকেই ফল সংগ্রহ করা যায়। ফল যখন অর্ধেক অথবা তিন-চতুর্থাংশ ক্রিমসন বর্ণ ধারণ করে তখন ফল সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। আবার ফল এর ত্বক টকটকে লাল অথবা কোন সবুজ বা সাদা অংশ থাকবে না তখন ফল সংগ্রহ করলে সেই ফলের মিষ্টতা এবং স্বাদ উন্নতমানের হবে। মৌসুমে ফল সপ্তাহে ৩-৪ বার সংগ্রহ করা যায়। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি (অক্টোবর মাসের শুরু)  সময়ে রোপণকৃত বারি স্ট্রবেরি-১ এর ফল সংগ্রহ পৌষ মাসে শুরু হয়ে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে। ফলগুলি বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনীর মাধ্যমে টান দিয়ে অথবা চিমটি কাটার মত করে কিছুটা কান্ড বা বোঁটাসহ সংগ্রহ করা ভাল তবে লক্ষণীয় ফলের গায়ে কোন ক্ষতি সৃষ্টি না হয় এবং ফল সংগ্রহের সময় বাছাই করে শুধুমাত্র পরিষ্কার,  অক্ষত ও আকার অনুযায়ী বাছাইকৃত ফল পৃথক প্যাকেটে রাখতে হবে। ফল খুব সকালে অথবা সন্ধ্যার দিকে সংগ্রহ করা ভাল। যদি সকালে সংগ্রহ করা হয় তবে বিকালের মধ্যেই সেটি বাজারজাত এবং সন্ধ্যায় সংগ্রহ করলে অবশ্যই পরদিন ভোর বেলায় বাজারজাত করতে হবে। ফল মাঠ থেকে সংগ্রহ করার পর মাঠের তাপমাত্র সরিয়ে ফেলতে হবে এজন্য ফলগুলিকে ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে। অগভীর প্লাাস্টিক, কার্ডবোর্ড, বাঁশ বা কাগজের ট্রেতে ১ বা ২ লেয়ার করে সংগ্রহ করা হয়। ফলটি দ্রুত পচনশীল হওয়ায় গভীর ট্রেতে ফল সংগ্রহ করলে দ্রুত পচে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায়। সংগ্রহের পরপরই ফলগুলিকে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের প্যাকেট অথবা করুগেটেড ফাইবার বক্সে অথবা টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা ডিমের ট্রেতে সংরক্ষণ করতে হবে। স্ট্রবেরির সংরক্ষণকাল খুব কম ফলে সংগ্রহের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজারজাত করতে হবে। স্থানীয় বাজারের জন্য পরিপক্ক ফল এবং দুরবর্তী বাজারের জন্য ফলটি সম্পূর্ণ রং ধারনের পূর্বেই ও যখন ফলটি শক্ত থাকে তখন সংগ্রহ করা উত্তম।

সংরক্ষণ
স্ট্রবেরির মত সুস্বাদু ফলগুলিকে সংগ্রহের পরপরেই অথবা বাজার থেকে কেনার পরপরই ব্যবহার করতে হবে। রেফ্রিজারেটরে রাখলে স্ট্রবেরির গুণাগুণ বৃদ্ধি পায়না। ফলগুলিকে ক্ষ তাপমাত্রায় কযেক ঘন্টার বেশি রাখা ঠিক নয়। স্ট্রবেরি সংরক্ষণের উপযুক্ত তাপমাত্রা হচ্ছে ০-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং উপুক্ত আর্দ্রতা হচ্ছে ৯০-৯৫%। শুষ্ক তাপমাত্রায় ফলের গায়ে বাদামী দাগ পড়ে যায়। অ্যান্থোসায়ানিন নামক পিগমেন্ট যা কিনা স্ট্রবেরির লাল রং-এর জন্য দায়ী তা শুষ্ক তাপমাত্রায় নষ্ট হয়ে যায় এবং ভিটামিন সি-ও তাপমাত্রা সংবেদনশীল। ফলগুলিকে পানি দিয়ে ধৌত না করে প্লাস্টিক প্যাকেটে আলগাভাবে ফ্রিজের ঠান্ডা অংশে রেখে দিলে ২-৩ দিন এমনকি কখনও কখনও ৬-৭ দিন পর্যন্ত রাখা যায়। পানি দ্বারা ধৌত করলে অতিরিক্ত আর্দ্রতা শোষণের কারণে পচন তরান্বিত হয়।

সংরক্ষণের সতর্কতা
১. ফ্রিজে সংরক্ষণ করলে স্ট্রবেরি ধৌত করা যাবে না।
২. ছত্রাক আক্রান্ত ফল সংরক্ষণ করা যাবে না।
৩. স্ট্রবেরিকে ক্ষ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে যদি এটি কয়েক ঘন্টার মধ্যে ব্যবহার করা হয়।
৪. প্লাস্টিক কন্টেইনারে সংরক্ষণ না করাই ভাল, এক্ষেত্রে টাপারওয়ার কন্টেইনার ভাল।
কন্টেইনারের মুখ সিল করা যাবে না।

বাজারজাতকরণ
স্ট্রবেরি বাজারজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়গুলি হচ্ছে ফল সংগ্রহ, পরিবহন, ডেলিভারি, দ্রুত-প্রিকুলিং, রেফ্রিজারেটেড সংরক্ষণ, রেফ্রিজারেটেড ট্র্যাকে পরিবহন ইত্যাদি। বাজারজাতকরণের পূর্বেই প্যাকেজিং করতে হবে। প্যাকেজিং সাধারণত ওজন, আকার, আকৃতি, রং ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে করা হয়। ভাল মানের ফলগুলিকে ছিদ্রযুক্ত কার্ডবোর্ডের কার্টনে কাগজ অথবা ফোম দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়। বাজারজাতকরণের জন্য  ০ ডিগ্রি সে. থেকে ২ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ফল সাধারণত তাপমাত্রা ৩-৭ দিন পর্যন্ত থাকে। রেফ্রিজারেটরে স্ট্রবেরি ফল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। দ্রুত পচনশীলতার কারণে সংগ্রহ ও বিক্রির মাঝখানের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই সময়টি যত কম হবে পণ্যের বা ফলের মান তত ভাল থাকবে। ফলের মান ভাল রাখা ও ভাল মূল্য পাওয়ার জন্য ক্লামশেল কন্টেইনার ব্যবহার করা ভাল। ফল তোলার পর অতিদ্রুত বাজারজাত করাই উত্তম।

উপসংহার
ফলটি এদেশে নতুন তাই ঝুঁকিও বেশি। তবুও মেধা ও বুদ্ধি প্রয়োগ করে স্ট্রবেরি চাষ একদিন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হবে সে কথা বলা যায়। স্ট্রবেরি সংরক্ষণ গুণ ও পরিবহন সহিষ্ণুতা কম হওয়ায় বড় বড় শহরের কাছাকাছি এর চাষ করা উত্তম। স্ট্রবেরি একদিন আমাদের গর্বিত ফল হিসেবে আমাদের উন্নয়ন আর সমৃদ্ধিকে আরো বেগবান করবে, আমাদের কৃষির এ অংশকে দূর বহুদূরে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

সতর্কতা
অতি সম্প্রতি ওয়াশিংটনের একটি খামারে উৎপাদিত স্ট্রবেরিতে ই কোলাই (E. coli) নামক ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গিয়েছে যা কিনা মানবদেহের অন্ত্রে বিষাক্ততা তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য স্ট্রবেরি ফলটি খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই ভালভাবে ধৌত করতে হবে।
^উপরে যেতে ক্লিক করুন