নাশপাতি মূলত শীতপ্রধান অঞ্চলের
ফল হলেও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় এর সফল উৎপাদন হচ্ছে। এটির ইংরেজি নাম Pear ও
Rosaceae পরিবারের অর্ন্তভূক্ত। বহুবর্ষজীবী ও মাঝারি ধরনের গাছ। প্রতি
বছর ফল ধরে। শীতে পাতা ঝরে। গ্রীষ্মে এক সঙ্গে পাতা ও ফুল আসে। ফুলের রং
সাদা, ডালের যে কোন প্রান্তে গুচ্ছবদ্ধভাবে ফুল ফোটে। ফল দেখতে অনেকটা
পেয়ারার মত। এশিয়ায় নাশপাতির ২০ রকম আবাদি জাত বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। এর
মধ্যে প্রধান উৎপাদক দেশ চীন ও জাপান।
বর্তমান অবস্থা:
বিদেশি ফল আপেলের চেয়ে ২ গুন ভিটামিন সি
সমৃদ্ধ নাশপাতি পার্বত্য অঞ্চলের একটি নতুন সম্ভাবনাময় ফল হিসেবে বাংলাদেশে
পরিচিতি পেয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির মাটি ও
আবহাওয়া বারি-১ জাতের নাশপাতি চাষের জন্য উপযোগী। বারি-১ জাতের নাশপাতি
২০০৪ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কর্তৃক অবমুক্ত হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে
চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে
নাশপাতির চাষ হচ্ছে। তবে দেশের অন্যান্য স্থানের যে কোন উঁচু ও ঢালু জমিতে
এর চাষ করা সম্ভব। পার্বত্য অঞ্চলে যে নাশপাতি হয় সেটা কিছুটা লম্বাটে,
ধূসর থেকে বাদামী ও কালচে বর্ণের এবং পাকলে হালকা কপি বর্ণের হয়। সিলেট
এলাকায় যে জাতটির চাষ হয় তা অনেকটা বুনো ধরনের। পার্বত্য চট্টগ্রামে ছোট
ছোট পাহাড়ে দো-আঁশ ও বেলে মাটিতে নাশপাতি চাষ খুবই লাভজনক। আমাদের কৃষি
গবেষনা কেন্দ্র এই জাতের ফলের চাষাবাদ সম্প্রসারণ বেশ কয়েক বছর ধরে কৃষকের
মাঝে গুটি কলম বিতরণ করে আসছে।
নাশপাতির ফলন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
অন্যান্য ফলের চেয়ে বেশী হওয়ায় এই ফলের চাষাবাদ দিন দিন বাড়ছে। তাছাড়া
নাশপাতি অপেক্ষাকৃত শক্ত ফল হওয়ায় সংরক্ষণ করা যায় অনেক সময় পর্যন্ত পচনশীল
নয় বলে দেরীতে বাজারে সরবরাহ করার সুযোগ থাকায় এর দামও বেশী পাওয়া যায়।
তাই নাশপাতিকে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় ফল বলে মনে করা হচ্ছে। সঠিকভাবে
পরিচর্যা করলে রোপনের পর ৫ বছরের মধ্যে প্রতিটি নাশপাতি গাছ থেকে ৩০-৬০
কেজি ফল উৎপাদন সম্ভব। গত কয়েক বছর ধরে এখানকার বাগান থেকে নাশপাতি বাজারে
আসা শুরু করেছে।
বংশবিস্তার:
সাধারণত কুড়ি সংযোজনের মাধ্যমে করা হয়।
তবে এয়ার লেয়ারিং বা গুটি কলমের পদ্ধতিতেও চাষাবাদ করা যায়। সাধারণত
এপ্রিল-মে মাসে কলম করা হয়। জুলাই-আগস্ট মাসে কলম কাটার উপযুক্ত সময়।
চারা রোপন:
সাধারণত মধ্য জুন থেকে মধ্য অক্টোবর
পর্যমত্ম চারা রোপন করা হয়। রোপন দুরত্ব হবে ৪-৬ মিটার। বসত বাড়ির আশে
পাশের ঢালু জমিতেও চারা রোপন করা যায়।
সার প্রয়োগ:
চারা রোপনের জন্য ২x২ বর্গফুট
দৈর্ঘ্য-প্রস্থে গভীর করে গর্ত প্রস্তুত করে এ গর্তে ১০-১৫ কেজি পচা গোবর
সার অথবা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া ২৫০ গ্রাম সুপার ফসফেট, ২৫০
গ্রাম পটাশ মিশ্রিত করে দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়। নাশপাতি গাছে নাইট্রোজেন
সার অর্থ্যাৎ ইউরিয়া সারের চাহিদা বেশী তাই গাছ লাগানোর ৩০-৪০ দিন পর গাছ
প্রতি ১০০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। ১-৫ বছর বয়সী গাছে
১৫০-২০০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে।
অঙ্গ ছাটাই:
নাশপাতি গাছের অঙ্গ ছাটাই অত্যাবশ্যক।
ছাঁটাই না করলে ডালপালার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় না এবং ডালগুলো সরু ও লম্বা হয়ে
উপরে দিকে বেড়ে যায়। এতে আশানুরুপ ফল পাওয়া যায় না। গাছের উচ্চতা ২-৩ ফুট
হওয়ার পর প্রথম অঙ্গছাঁটাই বা ডগা কেটে ফেলতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে গাছের
গোড়ায় ২-৩ দিন পর পর সেচ দিতে হবে। তবে লক্ষণীয় যে, যেন গাছের গোড়ায় পানি
জমে না থাকে কারণ নাশপাতি গাছ জমা পানি সহ্য করতে পারে না।
পোকামাকড়: এক ধরনের পোকা
কচি নাশপাতি ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে। এর ফলে নাশপাতি নষ্ট হয়ে যায়।
পোকার আক্রমণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক পানির সঙ্গে
মিশিয়ে স্প্রে করলে পোকার আক্রমণ থেকে নাশপাতি রক্ষা পায়। এছাড়া কাঠবিড়ালী
এবং কোনো কোনো প্রজাতির পাখি নাশপাতি খেয়ে থাকে।
ফল সংগ্রহ ও ফলন: কলমের
গাছ রোপনের ২ থেকে ৩ বছর পর থেকেই ফল দেয়া শুরু করে। মার্চ-এপ্রিলে ফুল আসে
এবং জুলাই-আগষ্ট মাসে ফল পরিপক্ক হয়। বয়ষ্ক গাছে ২০০ থেকে ৩০০ টির মত ফল
ধরে।
১. প্রচুর ভিটামিন সি, কে ও এ রয়েছে।
২. প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান যা আমাদের শরীরের কোষ ধ্বংস হতে বিরত রাখে।
৩. ১০০ গ্রাম ফলে ৮% ফাইবার/আঁশ থাকে। প্রতিদিন নাশপাতি খেলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।
৪. প্রচুর পরিমানে কপার, আয়রণ, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম নামক খনিজ পদার্থ ও রয়েছে।
৫. এটি অত্যন্ত Low Calorie ফল প্রতি ১০০ গ্রাম ফলে মাত্র ৫৮ ক্যালোরী শক্তি থাকে । Low Calorie কিন্তু বেশী আঁশ থাকায় এটি শরীরের ওজন কমাতে এবং রক্তের কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৬. ইহা ক্যান্সার প্রতিরোধেও সহায়তা করে।
৭. ইহা ডায়েবেটিক রোগীদের জন্য ভাল একটি ফল।
উপসংহার:
প্রতি বছর গবেষণা কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত
নাশপাতির প্রায় ২ হাজার গুটি কলম কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে খাগড়াছড়ি জেলায় সহস্রাধিক সৃজিত বাগানের কৃষকদের রোপন পদ্ধতি ও
বিনামূল্যে চারা গুটি কলম বিতরণ করা হয়েছে। তাছাড়া কৃষক ভাইদেরকে চাষ
পদ্ধতি সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
বিদেশি ফলের ওপর নির্ভরতা কমানো, মূল্যবান
বিদেশি মুদ্রার সাশ্রয়, অধিক কর্মস্থল এবং লাভজনক ফল উৎপাদনে আগ্রহী
উদ্যোক্ততারা নাশপাতি চাষে এগিয়ে আসবেন বলে আশা করা যায়।