- প্রকাশ করা হয়েছে মঙ্গলবার, 18 ফেব্রুয়ারী 2014 10:49
যেভাবে শুরুঃ
একটি মানবাধিকার সংস্থা মুলতঃ সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করে। দেশে-বিদেশে কোন ঘটনায় মানবাধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষন করে এই সকল বেসরকারী সংস্থা। এলক্ষ্যে তারা সমস্যা চিহ্নিত করে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে। এই তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রকাশনার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে মানবাধিকার লঙ্ঘন রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। যেকোন মানবাধিকার সংস্থার প্রধান দায়িত্ব সেই সত্যকে প্রকাশ করা যা মানুষের অধিকার কে খর্ব করছে।
বাংলাদেশের একটি তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ দাবী করে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলে। এই দাবীর প্রেক্ষিতে তাদের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রকৃত চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরা।
কিন্তু ২০১৩ সালের ১০ই জুন ‘অধিকার’ এর প্রকাশিত এক রিপোর্টে দাবী করা হয় ৬ই মে’র প্রথম প্রহরে রাজধানী ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত এক অভিযানে হেফাজত-এ ইসলামের ৬১ জন কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। হেফাজত-এ ইসলামের কর্মীরা মতিঝিলে সমাবেশ করার উদ্দেশ্যে সমবেত হয় কিন্তু তাদের নেতৃবৃন্দের উস্কানীমুলক বক্তব্যে কর্মীরা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তারা যানবাহন, ফুটপাতের দোকানপাট ইত্যাদির ওপর চড়াও হয়ে ব্যাপক ভাংচুর চালায়, পবিত্র কোরআন শরীফসহ বিভিন্ন বইপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। আশপাশের বিভিন্ন অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তারা আগ্নিসংযোগ করে। এই সমাবেশে আগতদের নিরাপত্তা বিধান করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশদের ওপরও তারা আক্রমণ করে।
স্বনামধন্য ইংরেজী দৈনিক The Daily Star এর বিশ্লেষণে দেখা যায় ৫ ও ৬ই মে ঘটনাবলীর ওপর করা ‘অধিকার’ এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন “হেফাজত-এ ইসলামের সমাবেশ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন” মূলত একটি পক্ষপাতদুষ্ট ও একপেশে একটি অর্ধসত্য প্রতিবেদন।
লিঙ্কঃ http://archive.thedailystar.net/beta2/news/questions-aplenty/
অধিকার এর দাবীর বিপরীতে প্রতিক্রিয়াসমুহঃ
পুলিশঃ
পুলিশ এর অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শহীদুল হক ৫ই সেপ্টেম্বর পুলিশ হেডকোয়ার্টার এ এক সংবাদ সম্মেলন আহবান করেন। এই সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়, ১৮ জন হেফাজত কর্মী কে তাদের ঠিকানায় খুজে পাওয়া যায়নি, ৫ জনের নাম দু’বার করে দেয়া হয়েছে, ৪ জন এখনও বেঁচে রয়েছে, ৬ জন নারায়ণগঞ্জ এবং হাটহাজারীর সংঘর্ষে মারা যায় এবং একজন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করে
লিঙ্ক http://archive.thedailystar.net/beta2/news/step-against-odhikar-jurisdiction-of-ngo-bureau-police/
ডিবি যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, “আমরা অধিকার এর রিপোর্টটি পর্যবেক্ষণ করে অনেকগুলো অসঙ্গতিপূর্ণ এবং মিথ্যা তথ্য পেয়েছি”।
তিনি আরও বলেন, এই মিথ্যা এবং অসঙ্গত তথ্য সমৃদ্ধ রিপোর্টটি দেশে সাম্প্রদায়িক বিভেদ উস্কে দিতে এবং দেশে ও বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে সহায়তা করছে।
ডিবি পুলিশ জানায়, তালিকায় প্রথম নামটি ছিল সিদ্দিকুর রহমানের, বাস চালক যিনি হেফাজতের হামলায় মারা গিয়েছিলেন। ৫৭ নং নামটি ছিল কামাল উদ্দিন খানের, এক ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজার, যিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। ডিবি পুলিশ আরও জানায়, তালিকায় ১৯ জনের বাস্তবে কোন অস্তিত্ব ছিল না। এর হচ্ছেন, নারায়ণগঞ্জের মাসুম বিল্লাহ, ময়মনসিংহের লুতফুর রহমান, মাওলানা মোহাম্মদ হাসান, হাফেজ লোকমান হোসেন, নারায়ণগঞ্জের আল আমিন, মুন্সিগঞ্জের মাওলানা জুবায়ের, গাজিপুরের শফিউল্লাহ বাদল, ময়মনসিংহের সিরাজুল ইসলাম, শরীয়তপুরের বাবু গাজী, কুমিল্লার সোহেল, বগুড়ার সিকান্দার আলী ফকির, যাত্রাবাড়ীর মোহাম্মদ সুলতান, ডেমরার রাজীব, কুমিল্লার মাওলানা মতিউর রহমান, ডেমরার সাব্বির, তাহের, আবু সায়ীদ, শরীয়তপুরের জালাল আহমেদ, কুমিল্লার সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
লিঙ্ক http://www.dhakatribune.com/bangladesh/2013/sep/02/odhikar-disowns-list-made-public-police
আসক; আইন ও সালিশ কেন্দ্রঃ
১৬ই আগস্ট এক প্রেস রিলিজ এর মাধ্যমে অধিকার জানায়, তারা তাদের এই রিপোর্টটির অনুলিপি Human Rights Watch, Amnesty International এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রে প্রেরণ করেছে।
অপরদিকে আসকের নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশের অন্যতম মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল জানান, আমরা এখন পর্যন্ত এরকম কোন তালিকা পাই নি।
এখন যদি আমরা নিচের লিঙ্ক এর রিপোর্ট টি দেখি, তবে দেখতে পাব, অধিকার এর জেনারেল সেক্রেটারি আদিলুর রহমান বলেছেন, অধিকার এর কাছে বর্তমানে ৫ই মের অভিযানে “নিহত” ৬১ জনের সম্পূর্ণ তালিকা নেই।
লিঙ্কঃ http://bdnews24.com/bangladesh/2013/08/12/odhikar-doesnt-have-the-list
গণ মাধ্যম (দ্য ডেইলি স্টার ):
৫ই মে শত শত হেফাজত কর্মী মতিঝিল এলাকায় ব্যাপক সহিংসতায় জড়িয়ে পরে। তারা বইয়ের দোকানগুলিতে আগুন দিয়ে পবিত্র কুরআন শরীফ পুড়িয়ে দেয়। যদিও অনেকগুলি টিভি চ্যানেল তাদের এই সহিংসতা সরাসরি সম্প্রচার করে, তবু অধিকারের রিপোর্ট এ এই ব্যাপারগুলো গোপন করে যাওয়া হয়েছে। তাদের রিপোর্ট এ হেফাজতে ইসলামকে একটি শান্তিকামী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় এবং হেফাজত কর্মীদের নিরাপরাধ বলা হয়।
হেফাজত কর্মীদের শাপলা চত্তর থেকে পুলিশ যখন শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তারা বিনা উস্কানিতে এক পুলিশ সদস্য কে ইট দিয়ে আঘাত করে তাকে মেরে ফেলে রেখে চলে যায়। কিন্তু অধিকার এর রিপোর্ট এ এই তথ্যের কন উল্লেখ পাওয়া যায় না।
লিঙ্ক http://archive.thedailystar.net/beta2/news/questions-aplenty/
হেফাজতে ইসলামের ৫ই মের সমাবেশে মাদ্রাসাগামী অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরকেও নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু অধিকারের রিপোর্ট এই ব্যাপারেও নীরব। এটা সম্পূর্ণ রুপে জাতিসঙ্ঘের শিশু অধিকার ঘোষণার লঙ্ঘন, যেখানে স্পষ্ট রুপে বলা হয়েছে যে এমন কোন কাজে শিশুদের ব্যাবহার করা যাবে না যা তাদের স্বাস্থ্য বা সুরক্ষার উপর হুমকী স্বরূপ।
অধিকার তাদের রিপোর্ট এ জানায়, তারা এক ফটোসাংবাদিক এর সাক্ষাৎকার গ্রহন করেছে। যিনি অধিকারকে জানিয়েছেন যে তিনি হেফাজতের মঞ্চের আশে পাশে ১৬ টি মৃতদেহ পরে থাকতে দেখেছেন।
কিন্তু পরবর্তীতে ডেইলি স্টার নাইম পারভেজ নামক সেই ফটো সাংবাদিক কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি বলেন, “ আমি ঐ রাতে যা দেখেছি অধিকার কে তাই বলেছি, কিন্তু ঐ রিপোর্ট এ আমার সকল কথা তুলে ধরা হয় নি। আমি ওখানে ৪ টি মৃতদেহ পরে থাকতে দেখেছি। আমি এর বাইরে আর কিছু বলি নি। বাকিরা হয় আহত ছিল অথবা বুলেট বিদ্ধ ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিজ্ঞতাঃ
বিবিসি বাংলার জেষ্ঠ্য সংবাদদাতা কাদির কল্লোল শাপলা চত্বরে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান প্রত্যক্ষ করেছেন এবং ৬ই মে, ২০১৩ তে বিবিসি বাংলায় তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ননা করেন। তাঁর বর্ননায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথমে পুরো শাপলা চত্বরটি ঘিরে ফেলে এবং সেখানে জড়ো হওয়া হাজার হাজার লোককে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। তাদের তৎপরতায় হেফাজত-এ ইসলামের সমর্থকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করে। তাদের অনেকেই মতিঝিল এলাকার বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেন। ভোরবেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা সেই শত শত হেফাজত কর্মীকে ওই সব ভবন থেকে নামিয়ে আনেন, এবং মতিঝিল এলাকা ছেড়ে চলে যেতে সহায়তা করেন।
কাদির কল্লোল ও আরও কয়েকজন সাংবাদিক একটি ভ্যানের ওপর কাফনের কাপড় এবং পলিথিন দিয়ে মোড়ানো চারটি মৃতদেহ দেখতে পান পুরো মতিঝিল এলাকার পরিবেশটা একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার মতোই লাগছিল, গতকাল সারাদিনের সহিংস বিক্ষোভের অনেক চিহ্ন আশপাশে ছড়িয়ে ছিল বলে তিনি বর্ননা করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শাপলা চত্বর খালি করার সময় কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।
কেন, তা ব্যাখ্যা করে এ অভিযানে অংশগ্রহণকারী র্যাকব কর্মকর্তা লে: কর্নেল জিয়াউল আহসান পরে বিবিসিকে বলেন, ‘তাদেরকে গ্রেফতার করা যেতো, কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম যে যার বাড়ি চলে যাক। সে কারণেই আমরা শক্ত অবস্থান নেই নি।’
লিঙ্কঃ http://www.bbc.co.uk/bengali/news/2013/05/130506_pg_motijheel_operation.shtml
‘অধিকার’ এর এই প্রতিবেদনে সত্যের প্রতিফলন ঘটেনি। এটি একটি উদ্দেশ্যমুলক এবং পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন। হেফাজত কর্মীদের ভাংচুর ও এর ফলে একজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুকে এই প্রতিবেদনে উপেক্ষা করা হয়েছে। এটি মূলত বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদিদের কার্যক্রমে সমর্থন দেওয়ার একটি অপপ্রয়াস। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে ‘অধিকার’ দেশের গণতান্ত্রিক ভাবমুর্তি ও সাম্প্রদায়িক ঐক্য বিনষ্ট করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।