শহীদ আসাদ : মিছিল তরে লাশ মেলেনি, শার্ট মিলেছে…


[ষাটের দশকের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির দলিলপত্র ঘাটলে মাঝে মধ্যে মাথা খারাপ হয়ে যায়। কে যে কার মিত্র, কার ভূমিকা যে কখন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে যায়- তার হিসেব মেলানো আসলেই জটিল এক কাজ। যাক সে কথা। আলোচ্য ঘটনার সময়কাল ১৯৬৯, এ বছরই পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক এক গণ অভ্যুত্থান ঘটেছিলো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমান, লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও সঙ্গীরা বন্দী। ২১ ফেব্রুয়ারি তারা বেকসুর খালাস পাওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকার রাজপথ ছিলো বারুদ আর রক্তের গন্ধে মাখামাখি। সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে আসাদ-মতিউর-সার্জেন্ট জহুরুল হক আর রাজশাহীতে ডক্টর শামসুজ্জোহা ছিলেন আলোচিত শহীদ, তবে একমাত্র নন। তাদের রক্তেই পতন ঘটেছিলো আইউব খানের, কিন্তু ২৫ মার্চ তার জায়গায় আসেন আরেক জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এটি আসাদুজ্জামানের শহীদ হওয়ার দিনটির কাহিনী। ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯। গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপাত্তের ভিত্তিতে এই বর্ণনায় সাহায্য করেছেন মাহবুবুর রহমান জালাল ভাই। ]


গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো, কিংবা সুর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।
বোন তার ভাইয়ের অম্লান শার্টে দিচেছ লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম, কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতা।
বর্ষিয়সী জননী, সে শার্ট উঠোনের রৌদ্রে
দিয়েছেন মেলে স্নেহের বিন্যেসে।
ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দূর শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে, এখন সে শার্ট,
শহরের প্রধান সড়কে সড়কে,
কারখানার চিমনির চুড়োয়,
গমগমে অ্যাভিনুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম,
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র জলোচ্ছি্বত প্রতিধ্বনিময় মাঠে
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা, কলুষ আর লজ্জা,
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা (আসাদের শার্ট : শামসুর রাহমান)
আসাদুজ্জামান বেঁচে থাকলে এই বাংলা আরেকজন বিপ্লবী পেতো। সর্বহারার মুক্তির স্বপ্ন দেখা একজন বিপ্লবী। ১৯৬৮ সালে লেখা শহীদ আসাদের যে ডায়েরীটা পাওয়া যায়, তাতে তেমন ইঙ্গিতই ছিলো। এ বিষয়ে একটি পাঠচক্রের নিয়মিত সদস্য ছিলেন আসাদ। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ও মেহনতী মানুষের সত্যিকার মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন তিনি। এইটুকু ইঙ্গিত লেখনীতে মিলে, কর্মে মেলে আরো বেশী। পাকিস্তানে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি কর্মী ও সদস্যদের নিরাপদ সাইনবোর্ড তখন মাওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মহসীন হল শাখার নেতা আসাদ কিষাণ মুক্তি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন আরো আগে থেকেই। নরসিংদীর শিবপুর, হাতিরদিয়া, মনোহরদী অঞ্চলের নিপীড়িত কৃষকদের জাগরণে সফল সংগঠক ছিলেন ইতিহাস বিভাগের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র আসাদ। যদিও ভিন্ন উপাত্তে তাকে এলএলবির ছাত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তার এই রাজনৈতিক পরিচয়টা উপেক্ষিত থেকে যায়। ইতিহাস বইয়ে আসাদ একজন ছাত্র, একজন শহীদ রয়ে যান। স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকলে হয়তো ক্রসফায়ারই হতো তার নিয়তি। একই মৃত্যু আরো রাজকীয় ভঙ্গীতেই বরণ করেছিলেন আসাদ ২০ জানুয়ারির সেদিনটায়।
৪ জানুয়ারি ১১ দফা দাবী ঘোষণা করেছিলো সম্মিলিত ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ (লিফলেটে উল্লেখ সংগ্রামী ছাত্র সমাজ)। ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমদ ও জিএস নাজিম কামরান চৌধুরীসহ এই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের আবদুর রউফ ও খালেদ মোহাম্মদ আলী, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন ও মতিয়া গ্রুপের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমেদ, সামসুদ্দোহা, মোস্তফা জামাল হায়দার ও দীপা দত্ত। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ জানুয়ারী বটতলায় এক মিটিং শেষে ২০ জানুয়ারী সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় হরতাল ডাকেন তারা। গভর্নর মোনেম খানের প্রাদেশিক সরকার জবাবে ১৪৪ ধারা জারী করে যাতে চারজনের বেশী একত্রিত হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়।
কোন আমলে ছাত্রদের ১৪৪ ধারায় বশ করা গেছে! সেদিনও যায়নি। সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হতে শুরু করেন ছাত্ররা। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকেও এসেছেন তারা। একটি সংক্ষিপ্ত ছাত্রসভা শেষে বেলা বারোটার দিকে জরুরী আইন ভাঙ্গেন ছাত্ররা। ১০ হাজার ছাত্র গগন বিদারী শ্লোগানে ধেয়ে যান ব্যারিকেডের দিকে। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় তখন সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ইপিআরের ঘেরাওয়ে। শুরু হয় সংঘাত আর তা ঘণ্টাব্যাপী চলতে থাকে। টিয়ারগ্যাস ও লাঠিচার্জের মধ্যেই ছাত্ররা কখনও পিছু হটছিলেন, কখনও এগোচ্ছিলেন। ঘণ্টাখানেক পর পুরানো কলাভবন এলাকা ছাড়িয়ে চাঁন খাঁর পুলের সামনে একটি ছত্রভঙ্গ মিছিল ফের প্রাণের ছোঁয়া পেলো। বজ্রদীপ্ত শ্লোগান দিয়ে এর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আসাদ। উদ্দেশ্য এই পকেটটি দিয়ে মিছিল রাজপথে নিয়ে যাওয়া। বেলা দুটোর দিকে একটি পুলিশ জিপ মিছিলের সামনে এসে পড়ে। একজন ইন্সপেক্টর (নাম জানা যায়নি) খুব কাছ থেকে (পত্রিকায় আন্দাজ ১০ ফুটের কথা বলা হয়েছে) গুলি করেন আসাদকে। বুকে বুলেট নিয়ে লুটিয়ে পড়েন তিনি। গুলি হয় পরপর, আহত হন আরো কয়েকজন। ক্ষিপ্ত ছাত্ররাও পিছিয়ে থাকে না। তাদের ছোড়া ইটে মাথা ফেটে যায় ইন্সপেক্টরের। পুলিশ জিপটি দ্রুত সরে যায়। চমকপ্রদ একটি ঘটনা না বলে পারছি না। পরদিন মহসীন হল থেকে এক শোকসভা শেষে ছাত্রদের মিছিল বের হয় আর তাতে সমর্থন জানায় মোনেম খান সমর্থিত এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্ট) নেতারা। তবে হল সংসদের সভাপতি মেশাররফ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল ঘটনার জন্য দায়ী করেন ইপিআর বাহিনীকে। তারা ঘটনার প্রেক্ষিতে ডাকা সংগ্রামী ছাত্র সমাজের হরতালে পূর্ণ সমর্থনও জানায়।
এদিকে আসাদকে নিয়ে ছাত্ররা ছোটেন মেডিকেলের দিকে। এর মধ্যে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে রটে গেছে গুলিবর্ষনের খবর। জরুরী বিভাগে পৌঁছানোর আগেই মারা যান আসাদ। এরপর শুরু হয় আসাদের লাশ নিয়ে এক নোংরা খেলা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ময়নাতদন্তের ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তাতে সায় দেয়। একইসঙ্গে ঘিরে রাখে ময়নাতদন্ত কক্ষসহ গোটা মেডিকেল ক্যাম্পাস (তখন ছিলো পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল কলেজ)। সন্ধ্যায় লাশ নিয়ে মিছিলের উদ্যোগ নেয় ছাত্ররা। একইসময় মেডিকেলে আর্মড পুলিশ ও ইপিআর ঢুকে পড়ে। তাদের নেতৃত্বে ঢাকার ডিসি ও পুলিশের আইজি। আসাদের লাশ ট্রাক থেকে নামিয়ে মেডিকেলের একটি ওয়ার্ডে লুকিয়ে ফেলেন ছাত্ররা। অন্যদিকে পুলিশ গোটা এলাকা ঘিরে ফেলে লাশের খোঁজে। আইজির বক্তব্য আসাদের ভাই ছাত্রদের কাছ থেকে তার ভাইয়ের লাশ উদ্ধারের জন্য পুলিশের সাহায্য চেয়েছেন।
ঘটনাটা ঘটে যখন মঞ্চে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আগমন ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স কমিটির (ডাক) নেতাদের। নুরুল আমিনের আহ্বানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ডাক সদস্যরা গণতন্ত্র পুনরূদ্ধারের জন্য আন্দোলনে নেমেছিলেন (যাদের অনেকেই পরে ইয়াহিয়ার দোসর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন) এবং আওয়ামী লীগও এদের সঙ্গী ছিলো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে ডাক নেতারা আসাদের লাশ দাবী করলে, তারা একটি মুচলেকা দাবী করেন। কর্তৃপক্ষ লাশের নিরাপত্তার দাবি করে নিশ্চয়তা চান যে লাশ আসাদের আত্মীয়দের হাতে সমর্পণ করা হবে। এই সময় ছাত্ররা সাফ জানিয়ে দেন ডাক নেতাদের তারা বিশ্বাস করেন না। আসাদের ভাই এসময় পুলিশকে ফোন করেন বলে জানা যায়।
লাশ আসাদের ভাই নিয়ে যান। ছাত্ররা তার আগে শার্ট নিয়েই বের করে মিছিল। এই মিছিল ঠেকানোর সাহস আর জান্তার হয়নি। কারণ এতে সামিল এবার জঙ্গী জনতাও। আইউবের নাম মুছে যায় মুহূর্তেই। আইউব গেট, আইউব এভিনিউর নাম বদলে হয়ে যায় আসাদ গেট, আসাদ এভিনিউ। পরদিন থেকে আবারও শুরু হয়ে যায় উত্তাল আন্দোলন, যাতে তাপ জোগায় আসাদের রক্তমাখা শার্ট।
শেষ কথা : আমি জানি না, আসাদের হত্যাকাণ্ডটি কতখানি পরিকল্পিত। জানি না এর নেপথ্যের ষড়যন্ত্রটুকু। তবে যতদিন না জানছি, তার আগ পর্যন্ত তার শার্টেই দেখে যাবো স্বাধীন বাংলার পতাকা।
ছবি: আসাদের শার্ট নিয়ে ছাত্রদের মিছিল, নিউইয়ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত খবর (নিউজ ক্লিপ দুটোয় আসাদের দুটো ছবি আলাদা সংযোজিত)।
^উপরে যেতে ক্লিক করুন