জাতিকে মেধাশুন্য করার ভয়ঙ্কর সেই মিশন..

জাতিকে মেধাশুন্য করার ভয়ঙ্কর সেই মিশন..

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে রাজনীতি হিসেবে আখ্যা দেয়াকে কোনভাবেই সমর্থন করতে পারি না। একাত্তরের আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল দীর্ঘদিন যাবত বাঙ্গালীর আপন অস্তিত্ব এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনের চুড়ান্ত রূপ যার পিছনের কারিগরের ভূমিকায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙ্গালী জাতির মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনকে রাজনৈতিক সীলটা মারার পিছনে জামায়াতীদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা কাজ করেছে। তারা সবসময় চেয়েছে আমাদের ইতিহাস বিকৃত করতে। আর এই বিকৃতির পিছনে কারণ একটিই, একাত্তরে নিজেদের কুকর্মের ইতিহাস লুকানোর অপচেষ্টা।

লুকাতে চাইলেই কি আর আপন চেহারা লুকানো যায়? তাদের কুকর্মের সকল ইতিহাস আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে এবং আরো হবে। তারই একটি হলো চুড়ান্ত বিজয়ের দুইদিন পরে রায়ের বাজারে আবিষ্কৃত বধ্যভূমি। সেদিন এই বধ্যভূমিতে পাওয়া পঁচা লাশের সংখ্যা দীর্ঘ নয় মাসে যে পরিমান বাঙ্গালী নিধন করা হয়েছে তার সমষ্টির ক্ষুদ্র একটি অংশমাত্র। তবে ব্যাপারটি শুধুমাত্র সংখ্যার ভিত্তিতে বিবেচনা না করে যদি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয় তবে ব্যাপারটি এমন দাঁড়ায় যে নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা সদ্য জন্ম নেয়া জাতিকে মেধাশুন্য করার পরিকল্পনা করেছিলো এবং তা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছিলো জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংঘের নেতৃস্থানীয় সদস্যরা। তারা তালিকা করে ঘরে ঘরে যেয়ে তুলে নিয়ে হত্যা করেছিলো জাতির সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের।
১৯৭১ সালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়েছিলো আলবদর বাহিনী। এই আলবদর বাহিনী গঠিত হয়েছিলো নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্যে। বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত এই বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে তৈরী করা হয়েছিলো বাঙ্গালী জাতির মেধাবী শিক্ষকদের তালিকা। আর এই তালিকার প্রমাণ পাওয়া যায় বুদ্ধিজীবি নিধন মিশনের প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামান এর ডায়রীতে, যা তার ৩৫০ নম্বর নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করে। তবে বুদ্ধিজীবি নিধন যে শুধুমাত্র ডিসেম্বরেই হয়েছে তা নয়। এই মিশন চলছিলো সারা বছর ধরেই। তার প্রমাণ পাওয়া যায়, ৭১এর সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পাঠানো একটি টেলিগ্রামে।
কুরআনে হাত দিয়ে শপথ নিচ্ছে আলবদরের সদস্যরা
বুদ্ধিজীবি হত্যার এই মিশনে চৌধুরী মইনুদ্দিন ছিল অপারেশন ইন চার্জ এবং আশরাফুজ্জামান ছিলো প্রধান নির্বাহী। আশরাফুজ্জামান এর ডায়রীতে প্রাপ্ত বুদ্ধিজীবির নামের তালিকায় যাদের নাম ছিলো তারা হলেন, মুনীর চৌধুরী, ডঃ আবুল খায়ের, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, রাশেদুল হাসান, ডঃ ফয়জুল মহী এবং ডাক্তার গোলাম মুর্তজা। এদের প্রত্যেককে নিজ হাতে হত্যা করে আশরাফুজ্জামান। এমনটিই জানা যায় পরবর্তীতে ধরা পড়া তার ড্রাইভার মফিজুদ্দিনের জবানবন্দী থেকে। ঠিকানা ভুল থাকার কারণে আশরাফুজ্জামানের ডায়রীতে নাম থাকা সত্তেও বেঁচে গিয়েছিলেন আতিকুল ইসলাম। এই আলবদরের বুদ্ধিজীবি নিধনের মিশনে প্রাণ হারানোদের তালিকায় আরো রয়েছেন, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফা, ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ডঃ আনোয়ার পাশা, ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ডঃ সিরাজুল হক খান, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য প্রমূখ।
বাংলাপিডিয়ার সূত্র অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবিদের সংখ্যাঃ শিক্ষাবিদ – ৯৯১ জন, সাংবাদিক – ১৩, চিকিৎসক – ৪৯, আইনজীবী – ৪২, অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবংত্রিশ লক্ষের তুলনায় এই সংখ্যা নগণ্য হলেও তাৎপর্য বিবেচনায় এই মিশনের লক্ষ্য ছিল দীর্ঘমেয়াদী আর তা ছিল বাঙ্গালী জাতিকে মেধাশুন্য করা।
জাতির জনককে হত্যার পরে আইন করে বন্ধ করে দেয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আবারো শুরু করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং দায়বদ্ধতা এই অপরাধের বিচার করেছে সরকার। বুদ্ধিজীবি হত্যা মামলার বিচারে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী চৌধুরী মইনুদ্দিন বর্তমানে অবস্থান করছে যুক্তরাজ্যে এবং আশরাফুজ্জামান রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে জোড়ালো তৎপরতা প্রয়োজন এই খুনীদ্বয়কে দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দেয়ার।
সূত্রঃ
চৌধুরী মঈনউদ্দিন : ভয়ঙ্কর এক খুনীর কথকতা
৭১-এর দলিল : বুদ্ধিজীবিদের নিধন চলেছিলো সারা বছর ধরেই
লেখকঃ সাইফুর মিশু
মূল লিখা
^উপরে যেতে ক্লিক করুন