আর কত মিথ্যাচার! বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে?

আর কত মিথ্যাচার!


উপরের এই ছবিটা নিশ্চয়ই আপনি দেখেছেন, বক্তব্যটা পড়েছেন। হয়তো বিশ্বাসও করেছেন। কিংবা ইতিহাস সম্পর্কে খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা নেই বলে খানিকটা বিভ্রান্ত। আপনাকে সাহায্য করবো আমি। মাথা ঠাণ্ডা করে এবার পড়তে থাকুন। ধরে নিচ্ছি আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ। অন্তত দুই যোগ দুই পাঁচ বলে কেউ আপনার মাথায় কাঠাল ভেঙ্গে খেয়ে যেতে পারবে না- এটুকু বুদ্ধি আপনার আছে। আপনার মেধা এবং বিবেচনাবোধটুকু এবার একটু খাটান দয়া করে।
এই ছবিতে যে বক্তব্য দিয়ে একটা মিথ্যা দাবিকে প্রতিষ্ঠার অপকৌশল নেওয়া হয়েছে চলুন তার মূলে আঘাত হানি। তালিকার ৭ জন মুক্তিযোদ্ধার দাবি মিথ্যা। কারণ এদের মধ্যে ৬ জন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। লে. কর্ণেল ফারুক যুদ্ধ করার সুযোগ পায়নি। কলকাতায় সে পৌছেছে ১২ ডিসেম্বর, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪ দিন আগে। এবং তার আতাউল গনি ওসমানীর বিশেষ সহকারী হওয়ার সুযোগ জুটেনি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলো নুর। নারীঘটিত এক কেলেঙ্কারিতে তাকে সেনাসদর থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নাম উল্লেখ না করলেও এ ব্যপারে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন নজরুল ইসলাম, একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা বইয়ের ৪৯-৫১ পৃষ্টায় ।

প্রধান সেনাপতির ফাইল বহন করেও যে বীরপ্রতীক হওয়া যায় নুর তার একমাত্র উদাহরণ যা গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ওঠার দাবি রাখে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত ওই দায়িত্বে ছিলেন শেখ কামাল।প্রসঙ্গত এইসব পদবীর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ১৯৭৪ সালে, ওসমানীর খেয়াল খুশী মতো। কিন্তু খন্দকার আবদুর রশীদকে এই তালিকায় কেনো রাখা হলো না বুঝলাম না। সেও তো মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো, সেও সাজাপ্রাপ্ত।

ফারুক রহমান মুক্তিযোদ্ধা না হলেও তার সঙ্গে বাকিদের একটা মিল আছে। তারা সবাই পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। এখন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছে নাকি পাকিস্তান তাদের পাঠিয়েছে যুদ্ধ করার ছলে অন্তর্ঘাত করতে সেটা সময় বলে দেবে। তবে ৩ নভেম্বর দেশ থেকে পালানোর পর তারা পাকিস্তানেই রাজনৈতিক আশ্রয় চাইছিলো। কিন্তু কি কারণে? প্রমাণ? ৫ নভেম্বর ১৯৭৫ ঢাকা মার্কিন দুতাবাস থেকে পাঠানো এই টেলিগ্রাম:
SUBJ: FUTURE PLANS OF MAJORS
WE UNDERSTAND BBC DRAWING ON A REUTERS’ REPORT FROM BANGKOK
THAT MAJOR FAROOK RAHMAN SAYING HE AND OTHER EXILES MAY SEEK
ASYLUM IN EITHER PAKISTAN OR THE UNITED STATES. IF QUERIED,
WE PLAN SAY THAT WE KNOW NOTHING OF THE MATTER.
BOSTER
এবার দেখি বীরউত্তম উপাধী কারা পেয়েছেন। মেজর জলিল ও আবু ওসমান চৌধুরী ছাড়া প্রত্যেক সেক্টর কমান্ডারই এই উপাধী পেয়েছেন। এমনকি গোটা মুক্তিযুদ্ধ কলকাতা সদর দফতরে বসে কাটানো আমাদের সেনাপ্রধান লে.কর্নেল আবদুর রবও বীর বিক্রম। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মুমতাজ, নায়েক আবদুল মান্নান কিংবা সিপাই নুরুল হকের মতো বিক্রম তাদের দেখাতে হয়নি যুদ্ধে।

যেমন জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর অপচেষ্টা হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন উনি কোথায় ছিলেন? জেড ফোর্সের অধিনায়ক অন্তত একটা পাকিস্তানী কোম্পানিকে সারেন্ডার করাতে পেরেছিলেন? কেনো তিনি রামগড়ে ফোর্সের হেডকোয়ার্টারে নুরুন্নবীর সঙ্গে বসে রাম খাচ্ছিলেন? পাকিস্তানের পরাজয়ের দুঃখে? 
ভদ্রতা করি কিন্তু ওদের মতো নোঙরামি কি আমরা পারি না? যেমন ধরি খালেদা জিয়া! মুক্তিযুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছেন প্রতিটি অফিসারের স্ত্রীদের বন্দী করেছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ২৬ মার্চেই অনেকে গ্রেফতার হন, যাদের স্বামীকে পাকিস্তানীরা হত্যা করেছিলো তাদের এপ্রিলেই ছেড়ে দেওয়া হয়। অথচ খালেদা গ্রেফতারই হন জুন মাসে আর মুক্তি পান কিংবা নেন ১৭ ডিসেম্বর। তাকে নিতে জিয়া লোক পাঠালেও তিনি যাননি। তাহলে কি তিনি মুক্তি নিতেই চাননি? নাহলে একদিন দেরী কেনো করবেন। ক্যান্টনমেন্ট তো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রনে, তিনি আসতে না চাইলে তারা তো জোর করতে পারেন না। নীচের সারণিটা দেখলেই বুঝবেন কিভাবে কি:

শেখ মুজিব তাকে নিজের মেয়ের মতো ঘরে রেখেছেন। শেখ রেহানা ঘর ছেড়ে দিয়েছেন তাকে, বড় বোনের মতো দেখেছেন। শেখ মুজিবের নির্দেশে জিয়া তাকে ঘরে নিয়েছেন, বিনিময়ে উপসেনাপ্রধান হিসেবে পদটাও নিশ্চিত করেছেন। এ বিষয়ে এমনকি এক বিদেশীর থিসিসেও উল্লেখ রয়েছে: (Curriculum as Destiny:
Forging National Identity in India, Pakistan, and Bangladesh; by
Yvette Claire Rosser, 2003, page: 168)। আজ উনি বিশেষ জন্মদিন পালন করেন তার রক্ষাকর্তার মৃত্যুদিবসে। কৃতজ্ঞতা আর কাকে বলে!
যে কয়জনই সেনা অফিসার ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হয়েছেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই খেতাব পেয়েছেন। এই সেনা অফিসাররা জেড ফোর্স, কে ফোর্স বা এস ফোর্সে ঢোকার আগে সেক্টরগুলাতে সাব-সেক্টর কমান্ড করেছেন। তাই তারা র‌্যাংক অনুযায়ী সিরিয়ালি পেয়েছেন বীর বিক্রম বা বীর প্রতীক বা অন্য খেতাব।

তারা কি নিখাদ দেশপ্রেম থেকে মুক্তিযুদ্ধে এসেছেন? নাকি পাকিস্তানে থাকলে বাঙালী হিসেবে মরতে হবে এই ভয়ে? ধরে নিচ্ছি প্রথমটাই সত্যি? এই মুক্তিযুদ্ধ কি তারা ফ্রি করেছেন? না পয়সা পেয়েছেন যুদ্ধের জন্য? কথাটার মধ্যে কোনো বিতর্কিত অর্থ খুজে না বের করে বরং সত্যটা জানি। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকার একটি সার্বভৌম সরকারের কাঠামো মেনেই এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন, সেনাবাহিনীসহ প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার জন্য তাই সরকারের তরফে পারিশ্রমিক বরাদ্দ ছিলো। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন। প্রধান সেনাপতি ওসমানীর এক নির্দেশনাও এই বেতনভাতা সম্পর্কে তথ্যাদি মেলে যা তাদের নিতে হতো জ্যাকপট সেক্টর কমান্ডার অর্থাৎ ভারতীয়দের মারফতে।

সম্প্রতি মেজর আবু ওসমান চৌধুরী আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছেন চুয়াডাঙা থেকে বিভিন্ন ট্রেজারি থেকে নেওয়া মোট ৪ কোটি ৭০ লাখের কিছু বেশী নগদ টাকা এবং ২৮ কেজি সোনা নিয়ে মুজিব নগর সরকারে জমা দেন তিনি। এ থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। পারিশ্রমিকের অংকটা ভারতীয় দলিলপত্রে এরকম: কমান্ডিং অফিসার ৫০০ রুপি, অফিসার ৪০০ রুপি, অফিসার ক্যাডেট ১০০ রুপি, জেসিও ১৫০ রুপি।

এবার দেখা যাক মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের জন্য খেতাবে প্রাথমিক প্রজ্ঞাপনে কাদের নাম ছিলো। শুধুমাত্র মুন্সী আবদুর রউফ মনোনীত হয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবের জন্য। বীরউত্তমের জন্য মাত্র তিনজন। শহীদ ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ এবং শহীদ ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানের সঙ্গে ৪ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর (বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা) কমান্ডার খাজা নাজিমউদ্দিন। সব বদলে গেলো। বাড়তি ৬ বীরশ্রেষ্ঠের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কোনো কথা নেই, কিন্তু সালাহউদ্দিন মমতাজ ও ঘোষণা দিয়েও জগৎজ্যোতির বীরশ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি না পাওয়াটা এদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের প্রতি তাচ্ছিল্যযুক্ত অপমান।

দ্বিতীয় গেজেটে সম্ভব হলে সেনাবাহিনীর সবাইকেই খেতাব দিয়ে দিতেন ওসমানী। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে এই খেতাবের জন্য যে মানদন্ড ঠিক করেছিলেন তা নিজেই মানেননি ওসমানী।

কেন মেজর ডালিম মুজিব হত্যার পর রেডিওতে বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা দিয়েছিলো? কেনো ভুট্টো সেটা শুনে খুশীতে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে ৫০ হাজার টন চাল, প্রচুর কাপড় সহ দুটো জাহাজ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন? ১৫ আগস্ট রাতে পাকিস্তান সরকারের পাঠানো আনুষ্ঠানিক বিবৃতিটি সেদেশের পত্রিকাগুলোয় পৌছে, তাতে শেখ মুজিবের হত্যায় শোকও প্রকাশ করা হয়। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানের বিভক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাতে উল্লিখিত উপহারের ঘোষনা দেওয়া হয় এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আহবান জানানো হয়। বিবৃতিতে ভুট্টোর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়:
As a first and spontaneous gesture to the fraternal people of Bangladesh, I have decided to immediately dispatch to Bangladesh as a gift from the people of Pakistan 50,000 tons of rice, 10 million yards of long cloth and five million yards of bleached mull. This is only a modest contribution of our people to our brothers in Bangladesh in their hour of need. We are prepared to make a greater contribution within our greater capacity for the well being of the people of Bangladesh with whom we have shared common nationhood and destiny. Let the world know that we stand together in weal and woe. We respectfully urge the state members of the Islamic conference to accord recognition to the new government of the Islamic Republic of Bangladesh and we appeal to all countries of the third world to do likewise. This appeal stems from our anguished awareness of how our country has dismembered by an international conspiracy culminating in aggression. I grieve that Sheikh Mujibur Rahman and members of his family have met a tragic end.

এখন কেনো এই মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা যাদের প্রাথমিক প্রজ্ঞাপনে নামই ছিলো না মুজিবকে হত্যার পর পাকিস্তানেই ফিরতে চাইলেন?



কেনো যুক্তরাষ্ট্রের ডিলিটেড গোপন তারবার্তার শিরোনামে লেখা থাকে ফারুক-রশীদ দুই পাকিস্তানকে এক করতে চাইছিলেন?
এখন এই পাকিস্তানের দালাল তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কারা মায়া কান্না কাঁদছে? এদের রাজনৈতিক পরিচয় কি? যে পেইজ থেকে এই ছবিটা পেয়েছেন তারা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি? নাকি মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অপমান করতে চাইছে। এইসব ছদ্মবেশী পাকিস্তানী ও পাকিস্তানপন্থীদের এইসব অপপ্রচারে আর কত কান দিবেন? আপনার বিবেক কি বলে? আপনার বিবেচনা কি বলে? আপনার প্রজ্ঞা কি বলে?
^উপরে যেতে ক্লিক করুন