সরকারী সেবায় আইসিটি: অল্পের মাঝেই ঢের বেশি


সম্প্রতি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিসকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবার উদ্যোগের জন্য পুরস্কৃত হয়েছে। তথ্য সমাজের বিশ্ব সম্মেলন (WSIS) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের প্রকল্প ‘অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন(A2I)’ কে চিহ্নিত করেছে সরকারি সেবাকে সকল পর্যায়ের জনগণের কাছে সহজলভ্য করার উপায় হিসেবে।

যেহেতু বাংলাদেশে এখন ১১৪মিলিয়ন মোবাইল ব্যবহারকারি আছে এবং ৩৩.৪৩মিলিয়ন ইন্টারনেট ব্যবহারকারি আছে, সরকার তাই একেই পাবলিক সার্ভিসকে স্বল্পায়াসে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করার কাজ করতে পারছে।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মানুষ আগে অনেক দূর ভ্রমণ করতো কেবলই কিছু ইউটিলিটি বিল দিতে বা কোনো দরখাস্তের ফরম সংগ্রহের জন্য। দৃশ্যটা এখন বদলে গেছে। পাঁচ বছর ধরে অবিরাম সংগ্রাম করার পর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন ইতোমধ্যেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং অন্যান্য সামাজিক সেবাকে নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, কয়েক বছর আগে যা চিন্তারও বাইরে ছিল।
শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
আমাদের শিক্ষা খাতের দৃশ্যপট শনৈ শনৈ পাল্টে যাচ্ছে ইন্টারনেট এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির জাদুর ছোঁয়ায়। শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণকে আরো উপভোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক করতে, ২২,৫০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবং ১৭০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপিত হয়েছে। আর একটি লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে দেশের প্রতিটি স্কুলে ২০১৬ সালের মধ্যে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করার।
কেবল শিক্ষার্থীদেরকেই নয়, শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতেও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। ১০০০ শিক্ষককে ‘মাস্টার ট্রেইনার’ হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে যারা আরো প্রায় ২০,০০০ শিক্ষককে প্রশিক্ষিত করেছেন। শিক্ষকদের জন্য একটি পোর্টাল চালু করা হয়েছে যেখানে তারা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল বিষয়বস্তু খুঁজে নিতে পারবেন।
সরকার পাঠ্যবইকে ই-বুক হিসেবে পাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সরকারী ইবুকের সাইটে প্রায় ৩০০ পাঠ্যবই এবং ১০০টি সহায়ক লেখা ডাউনলোড করা যাবে।
পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলগুলো মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে ২০০৯ থেকেই। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলগুলো সহজেই মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া যায়। ৫৩০ লাখ ব্যবহারকারি তাদের মোবাইলে নিজেদের ফলাফল পেয়েছে।
সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং মেডিক্যাল কলেজগুলোতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়েছে। ৫ বছর আগেও শিক্ষার্থীদেরকে সশরীরে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি ফরম সংগ্রহ এবং জমা দিতে হতো। তাদের অধিকাংশই দালালদের কাছে গিয়ে প্রায় দ্বিগুণ ফি দিতে বাধ্য হতো। এখন, সেই দীর্ঘসূত্রী প্রক্রিয়াটি মাত্র ৩টি মেসেজেই সম্ভব। প্রায় ৩০ লাখ ছাত্র ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ পর্যন্ত ভর্তির আবেদন করেছে।

স্বাস্থ্য সেবায় তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি
একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, যার জনসংখ্যা প্রায় ১৫.৪৭কোটি, তার স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি কমিয়ে আনতে মোবাইল ফোনের ব্যবহারকে বাড়ানো একটি সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সরকার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা চালু করেছে, নাগরিকরা যেকোনো পাবলিক স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে কল করতে পারে এবং একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক তাদেরকে তাৎক্ষণিক সেবা দিয়ে থাকেন। এখন, ৪৮২টি সরকারি হাসপাতালে একটি করে কল ফোন দেয়া হয়েছে এই সেবাটি চালু রাখার প্রয়োজনে।
টেলিমেডিসিন হচ্ছে এমনই সুবিধা যাতে রোগিকে কোনো হাসপাতাল বা বিশেষজ্ঞের কাছে সশরীরে যেত হয় না। একই সুবিধা তারা পেতে পারেন তাদের UISC বা কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়েই। জনগণ সেখানে গিয়ে তাদের সেবাটি পেতে পারে স্কাইপ যোগাযোগের মাধ্যমেই। প্রাথমিকভাবে, এই সেবাটি ৮টি হাসপাতাল এবং ৩০টি UISC তে পাওয়া যাচ্ছে।
কৃষিখাতে তথ্যপ্রযুক্তি
কৃষির প্রসার এবং সঠিক ও প্রয়োজনীয় তথ্য কৃষককে সময় মতো পৌঁছে দেয়া বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের জন্য একটি প্রধান নিয়ামক। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কৃষি বিষয়ক তথ্য এই ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ১২০০০ দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ এজেন্টদেরকে। এই এজেন্টরা কৃষকদেরকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করছেন। সরকার কৃষকদেরকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করার জন্য একটি ওয়েবসাইট (http://ais.gov.bd/) চালু করেছে।
অনলাইনে সার সুপারিশ নির্দেশিকা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের একটি উদ্যোগ, কৃষকদের মাটি অনুযায়ী সঠিক সারটি ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকে। ভুল সারের ব্যবহার ফলন হ্রাস করে যা আমাদের সর্বমোট ফসল উৎপাদনে কুপ্রভাব পড়ে। প্রায় ২০০টিরও বেশি UISC থেকে কৃষকরা গত কয়েক বছর ধরে পরামর্শ নিয়ে ফসলের বাম্পার ফলন পাচ্ছেন।
চিনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে, সময়মতো আখের উৎপাদন একজন কৃষকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেরিতে উৎপাদন হলে দামে কম পাওয়া যায় এবং তা মানেও খারাপ হয়, ফলে চিনির উৎপাদনও কম হয় এবং মান কম থাকে। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ই-পার্জি ব্যবস্থাপনা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেছেন, যা কৃষকদের আখ সরবরাহের সঠিক সময় জানতে সাহায্য করে। এই উদ্যোগের ফলে আখের ফলন ১৩% বেড়েছে। এই সেবাটি সকল চিনিকলেই আছে এবং ২০০,০০০ এরও বেশি কৃষককে সহায়তা দিচ্ছে।
সরকারি সেবার অবকাঠামো
সরকারী সেবাগুলো পেতে যে ঝক্কি হয়ে থাকে তার অবলুপ্তি ঘটাতে প্রতিটি ইউনিয়নে (স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন পর্যায়) ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র (UISC) স্থাপিত হয়েছে। প্রায় ৩২ লাখ মানুষ ৪৫৪৭টি ইউনিয়নে বিবিধ সেবা লাভ করছে। এই সেবাগুলোর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে জন্মনিবন্ধন, সম্ভাব্য প্রবাসী জনবলের অনলাইন নিবন্ধন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা, জীবন বীমা, টেলি-মেডিসিন স্বাস্থ্যসেবা। এই কেন্দ্রগুলোতে ছাত্র, যুবক, নারী এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে UISC কে জেলা পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে এবং নাম দেয়া হয়েছে জেলা ই-সেবাকেন্দ্র (DESC)। ২০১১ থেকে, দেশের ৬৪টি জেলাতেই DESC স্থাপন করা হয়েছে। ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে, শহর ও গ্রামে সরকারি সেবাগুলোর কেন্দ্রবিন্দু ছিলো জেলা কমিশনার (ডিসি) অফিসগুলো। ডিসি অফিসগুলো সচরাচর রাজস্ব, সরকারি আদেশ ও নিরাপত্তা, লাইসেন্স এবং সনদপত্র, জমি অধিগ্রহণ, শুমারী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, সমাজকল্যান, পেনশন, শিক্ষা এবং পাবলিক পরীক্ষা, জনগণের অভিযোগ ও জিজ্ঞাসা ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণ ও তদারকীর সেবা দিয়ে থাকে। ডিজাটালায়নের ফলে ডিসি অফিসগুলো আরো দ্রুত কাজ করতে পারছে। ২০১১ সাল থেকে, ৩৮৯,৪২৩ গুলো জমি রেকর্ড জনগণকে সেবা দেয়া হয়েছে, ৭৫৮,১৫৩টি আবেদনের বিপরীতে, যা অ্যানালগ পদ্ধতির যুগ হলে আরো ৩-৪ বছর বেশি লেগে যেতো। DESC গুলো মাত্র ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে সেবা দিয়ে থাকে, ২০১১ সালের আগে যেগুলো ২ থেকে ৩ সপ্তাহের কাজ ছিলো।
তথ্য ও ইউটিলিটি সেবা
ইউটিলিটি বিল প্রদান নাগরিকদের জন্য, বিশিষত, নগরবাসীর জন্য বেশ ঝামেলাপূর্ণ কাজ। তাদেরকে আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ, পানি এবং গ্যাস বিল দিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। কিন্তু, মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের কারণে সেটা এখন ইতিহাসের ব্যাপার মাত্র। ২০১০ সাল থেকে, জনগণ তাদের মোবাইল ব্যবহার করে বাড়িতে বসেই বিল দিয়ে দিচ্ছেন। ফেব্রুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত, ৫.৬ লক্ষ পানির বিল, ১৩.৩ লক্ষ গ্যাস বিল এবং ২১২ লক্ষ বিদ্যুৎ বিল মোবাইল এবং অনলাইন সেবার মাধ্যমে প্রদত্ত হয়েছে।
টাকাপয়সা স্থানান্তর আগে বেশ ঝক্কিপূর্ণ এবং অনিরাপদ ছিল, যার নিরসনকল্পে সরকার চালু করেছে ইলেকট্রনিক মানি স্থানান্তর সিস্টেম (EMTS)। সেবাটি বাংলাদেশ ডাকবিভাগ চালু করেছে এটুআই(A2I) এর সাথে একত্রে। এখন গ্রাহকগণ ২০মিনিটের মধ্যে টাকা প্রেরণ ও গ্রহণ করতে পারে দেশের ২৭৫০ পোস্ট ও সাব পোস্ট অফিসগুলো থেকে।
বাংলাদেশে আগে পুলিশি সেবা পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। কিন্তু সম্প্রতি, পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশ পুলিশ অনলাইন সেবা চালু করেছে। প্রাথমিকভাবে জনগণ তাদের অগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোতে সাধারণ ডাইরি (জিডি) করতে পারবে সেখানে।
প্রতি বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্র এবং শ্রমিক উন্নততর সুযোগের জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু মাইগ্রেশনের প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট জটিল এবং সবার জন্য বেশ হেনস্থার ব্যাপার ছিল। তবে সরকার মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (MRP) এবং ভিসা (MRV) প্রবর্তনের মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন করে চলেছে। এই উদ্যোগের ফলে সময়, খরচ এবং জালিয়াতির পরিমাণ নাটকীয়ভাবে কমছে।
বাংলাদেশ, তার জন্মের পর থেকে, সম্ভাব্য সকল ধরনের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু ২০০৯ সালে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ “ডিজিটাল বাংলাদেশ” ধারনাটি নিয়ে আসার পর দেশের জনগণ নতুন সম্ভাবনার ঊষা যেনো দেখতে পেয়েছে। সফলভাবে তাদের শাসনকাল শেষ করার পর, জনগণ তাদেরকে পরপর দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত করেছে, যা ইতিহাসে প্রথমবারের ঘটনা। উপরে বর্ণিত অর্জনগুলো কেবলই একটি বিপ্লবের ছিটেফোটা। আরো অনেক কাজ করার সুযোগ রয়ে গেছে। সরকারি প্রতিটি প্রক্রিয়া রাতারাতি পরিবর্তন করে ফেলা সম্ভব নয়। কিন্তু, আমাদের বিশ্বাস ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আমরা ২০২১ সালের আগেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ অর্জন করতে পারবো।
^উপরে যেতে ক্লিক করুন