১৮৮২
সালের ২ নম্বর ট্রাস্ট আইনকে বাংলায় অছি আইন বলা হয়। কিন্তু অছি আইন নয়,
ট্রাস্ট আইন হিসেবেই এ আইনটি ব্যাপক পরিচিত। আইনটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে,
'যেহেতু প্রাইভেট ট্রাস্ট ও ট্রাস্ট সম্পর্কিত আইনের সংজ্ঞায়ন ও সংশোধন
সমীচীন ও প্রয়োজনীয়, সেহেতু এতদ্বারা ট্রাস্ট অ্যাকট প্রণীত হয়।' আইনটি
১৮৮২ সালের ১ মার্চে বলবৎ হয়।আজ পর্যন্ত
কারো পক্ষে ট্রাস্টের সন্তোষজনক সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন আইনশাস্ত্রবিদ ট্রাস্টের সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণের চেষ্টা চালিয়েছেন। অধ্যাপক মেইটল্যান্ড ট্রাস্টের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, 'যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি তাঁর ওপর অর্পিত অধিকার অপর কোনো ব্যক্তির পক্ষে ব্যবহার অথবা বিশেষ উদ্দেশ্যে বা কার্য সম্পাদনের জন্য ব্যবহার করতে বাধ্য থাকবেন, তাঁর ক্ষেত্রে সম্পর্কযুক্ত অধিকার ট্রাস্ট হিসেবে গণ্য হবে।' আইনবিজ্ঞানী কিটনের মতে, 'ট্রাস্টের উৎপত্তি তখনই ঘটে, যখন ট্রাস্টি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোনো স্থাবর, অস্থাবর বা ব্যক্তির উপভোগের জন্য, যাদের মধ্যে সে নিজেও একজন হতে পারে অথবা বৈধ কোনো কার্য সম্পাদনের জন্য রক্ষণাবেক্ষণের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে।' আন্ডার হিলের মতে, অছি হলো 'একটি ন্যায়সংগত বাধ্যবাধকতা যা মানুষের সুবিধার্থে কোনো ব্যক্তিকে তাঁর নিয়ন্ত্রিত সম্পত্তির সংস্পর্শে আসতে বাধ্য করে।'সাধারণ অর্থে ট্রাস্ট হলো এক ব্যক্তি তাঁর অধিকার ও কর্তব্য অপর কোনো ব্যক্তির কাছে দায়বদ্ধ রাখাকে বোঝায়। ১৮৮২ সালের ট্রাস্ট আইনের ৩ ধারায় ট্রাস্টের ব্যাখ্যা হলো, 'ট্রাস্ট হলো সম্পত্তির মালিকানার সঙ্গে সংযুক্ত দায়িত্ব, যা অন্যের বা অন্যের ও মালিকের উপকারার্থে মালিকের ওপর অর্পিত ও মালিক কর্তৃক গৃহীত অথবা তৎকর্তৃক ঘোষিত ও গৃহীত আস্থা থেকে উদ্ভূত'।একেবারে সহজ ভাষায় ট্রাস্ট হলো একজনের সম্পত্তি অপরের উপকারার্থে অন্যের হাতে সমর্পণ করা। একটি উদাহরণের মাধ্যমে ট্রাস্টকে বোঝানো যেতে পারে। যেমন_করিম তার সম্পত্তি রহিমের কল্যাণে শফিকের কাছে অর্পণ করল। হয়ে গেল ট্রাস্ট সৃষ্টি। যে ট্রাস্ট করে তাকে বলা হয় ট্রাস্ট কর্তা। যে ট্রাস্ট গ্রহণ করে বা যার বরাবরে ট্রাস্ট করা হয় তাকে বলা হয় ট্রাস্টি। যার উপকারার্থে ট্রাস্ট করা হয় তাকে বলা হয় লাভভোগী। যে সম্পত্তি নিয়ে ট্রাস্ট করা হয় তাকে বলা হয় ট্রাস্ট সম্পত্তি। যে দলিলের মাধ্যমে ট্রাস্ট সৃষ্টি করা হয় তাকে বলা হয় ট্রাস্ট দলিল।ট্রাস্ট আইনের ইতিহাস : প্রথমে ট্রাস্ট ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রচলিত থাকলেও পরে ধর্মনিরপেক্ষ ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হয়। বিশ্বাসই একমাত্র ট্রাস্টের সৃষ্টি। একজনের স্বত্বভোগের জন্য অপরের অনুকূলে সম্পত্তি অর্পণকে ট্রাস্ট বলা হয়। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের রাজত্বকালে রোমান ক্যাথলিক পাদ্রিরা চার্চের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে ভূসম্পত্তির অধিকারী হতে পারতেন না। জনগণের দান ছিল তাঁদের ভরণ-পোষণের একমাত্র উৎস। যেসব জনগণ চার্চের পাদ্রিদের সম্পত্তি দান করতে ইচ্ছুক হতো; তারা সেই সম্পত্তি 'বরো' (ইড়ৎড়ঁময) নামে এক সমপ্রদায়কে অর্পণ করত। পাদ্রিরা এই সম্পত্তির ওপর স্বত্বভোগ করতেন। চার্চের পাদ্রি বা ধর্মযাজকরা এই সম্পত্তির আয় থেকে নিজেদের ভরণ-পোষণের কাজ চালাতেন। উলি্লখিত পদ্ধতিতে ধর্ম-যাজকদের ভরণ-পোষণের নিমিত্তে সম্পত্তি অর্পণ বর্তমান যুগের ট্রাস্টেরই অনুরূপ। এবার বলা যায় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের রাজত্বকালেই ট্রাস্টের উৎপত্তি হয়ে বর্তমানে এসেছে।ইকুইটি বা ন্যায়পরতা আদালত প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে 'কমন-ল' অনুসারে বিচারকার্য পরিচালিত ও সম্পাদিত হতো। 'কমন-ল' আদালতের বিচারকরা প্রচলিত আইন অনুসারে বিচারকার্য সমাধা করতেন বলে বিচার হয়ে উঠেছে আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ। ইংল্যান্ডের প্রচলিত সাধারণ প্রথা ও রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করেই 'কমন-ল' গড়ে উঠেছিল। যে কারণে বিচারকার্য পরিচালনার সময় বিচারকরা সব রকমের বিচার নিষ্পত্তির জন্য সুস্পষ্ট বিধান 'কমন-ল'-এর মধ্যে খুঁজে পেতেন না। যার জন্য সেসব বিষয়ে 'কমন-ল' কোর্টেরবিচারকরা কোনো সুষ্ঠু প্রতিকার দিতে সক্ষম হতেন না। প্রতিকারের আশায় জনগণ রাজার কাছে যেত এবং রাজার আদেশে চ্যান্সারি বিভাগ বিচার-বিবেচনা ও ন্যায়-নীতিবোধের আলোকে এগুলোর বিচার সম্পাদন করতেন। এভাবে বিচারকার্যে চ্যান্সারি বিভাগ ইকুইটি বা ন্যায়পরতার প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে ১৮৭৩ এবং ১৮৭৫ সালে জুডিকেচার অ্যাক্ট (ঔঁফরপধঃঁৎব অপঃ) পাস করা হয়। যার মাধ্যমে ইকুইটি এবং পূর্বে প্রচলিত 'কমন-ল'-এর মিলন ঘটানো হয়। এভাবে উভয় আইনের সংমিশ্রণে নতুন আইনের আধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়। উলি্লখিত অ্যাক্ট দুটির মাধ্যমে ইকুইটি কোর্ট ও 'কমন-ল' কোর্টের পৃথক এখতিয়ার বিলোপ করে সে স্থলে হাইকোর্ট অব জাস্টিস ( ঐরময পড়ঁৎঃ ড়ভ ঔঁংঃরপব) স্থাপন করা হয়। এর অধীনে চ্যান্সারি কোর্ট, কিংস বেঞ্চ, প্রবেট ও এডমিরালটি বিভাগ স্থাপিত হয়। এরূপ প্রত্যেক কোর্টকেই ইকুইটি এবং 'কমন-ল' প্রয়োগের এখতিয়ার দেওয়া হয়।এ দেশে ট্রাস্ট আইনের প্রচলন : চতুর্দশ শতাব্দীতে ট্রাস্টের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ব্রিটিশ ভারতে বিভিন্ন নামে ও বিভিন্নভাবে ট্রাস্টের প্রচলন ছিল। ১৮৮২ সালের আগেও ব্রিটিশ ভারতে দণ্ডবিধি, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, দেওয়ানি কার্যবিধি, তামাদি আইনে ট্রাস্টের অবস্থান পাওয়া যায়। এই আইনগুলোর ও ব্রিটিশ ট্রাস্ট আইনের সংমিশ্রণে ১৮৮২ সালে এ উপমহাদেশে ট্রাস্ট আইন প্রণয়ন করা হয়। পরে বাংলাদেশেও ১৮৮২ সালের ট্রাস্ট আইন বলবৎ রাখা হয়।ট্রাস্ট গঠন : সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ও উত্তরাধিকার আইনের সঙ্গে ট্রাস্ট আইনের সামঞ্জস্য রাখা হয়েছে। ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী একটি ট্রাস্ট গঠনে তিন পক্ষের প্রয়োজন। ট্রাস্ট কর্তা, ট্রাস্টি এবং লাভভোগকারী বা স্বত্বভোগী। ট্রাস্ট সৃষ্টিতে তিনটি নিশ্চয়তার প্রয়োজন।যেমন :১। বক্তব্যের নিশ্চয়তা : ট্রাস্ট গঠন করতে হলে ট্রাস্ট কর্তার বক্তব্য পরিষ্কার থাকতে হবে। সুস্পষ্ট ভাষায় ট্রাস্ট দলিল লিখতে হবে। যেন ট্রাস্ট কর্তার বক্তব্য পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। ট্রাস্ট সৃষ্টিকারীর বক্তব্যের ওপর ট্রাস্টের বৈধতা বহুলাংশে নির্ভর করে।২। বিষয়বস্তুর নিশ্চয়তা : ট্রাস্টের বিষয়বস্তুর অস্তিত্ব অবশ্যই থাকতে হবে। সহজ কথায় যে বিষয় নিয়ে ট্রাস্ট করা হবে বিষয়টির অস্তিত্ব বাস্তবে থাকতে হবে। সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৬ ধারা মোতাবেক বাংলাদেশে যেসব সম্পত্তি হস্তান্তরযোগ্য কেবল সেসব সম্পত্তিই ট্রাস্টের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। ট্রাস্টের সম্পত্তি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে। সম্পত্তিতে লাভভোগীর স্বার্থ নির্দিষ্ট করে দিতে হবে।৩। উদ্দেশ্যের নিশ্চয়তা : যে উদ্দেশ্যে ট্রাস্ট সৃষ্টি করা হয়, সে উদ্দেশ্য অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে এবং সুনির্দিষ্টভাবে ট্রাস্ট দলিলে উল্লেখ করতে হবে। ট্রাস্টকৃত সম্পত্তির কে বা কারা লাভভোগী হবে এবং কতটুকু হবে তা উল্লেখ করতে হবে। যে ট্রাস্টের উদ্দেশ্য আইন মোতাবেক হতে হবে। বেআইনি কোনো কর্মের উদ্দেশ্যে ট্রাস্ট করা যাবে না।ট্রাস্ট সৃষ্টি : যদিও ট্রাস্ট সৃষ্টির কোনো নির্দিষ্ট ছক নেই তবুও নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে ট্রাস্ট সৃষ্টি করা যায়।* উইল বা আজীবন স্থায়ী দলিলের মাধ্যমে।* ট্রাস্ট সৃষ্টিকারী কর্তৃক সুস্পষ্ট ভাষায় ট্রাস্টের উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু লাভভোগীদের কথা ঘোষণার মাধ্যমে।* ট্রাস্টদাতার স্বাক্ষরযুক্ত লিখিত দলিলের মাধ্যমে।* স্থাবর সম্পত্তি সম্পর্কিত ট্রাস্ট অবশ্যই লিখিত এবং রেজিস্ট্রিকৃত হবে।* অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ট্রাস্টির অনুকূলে ট্রাস্ট দলিলের বিষয়বস্তু হস্তান্তর করতে হবে।* স্থাবর সম্পত্তি সম্পর্কিত ট্রাস্টের ক্ষেত্রে ট্রাস্টির বরাবরে ট্রাস্ট দলিল ও তার মালিকানা হস্তান্তর করতে হবে।* উইলের মাধ্যমে ট্রাস্ট গঠন করতে হলে তা অবশ্যই দলিলে উল্লেখ করতে হবে।* অস্থাবর সম্পত্তির মৌখিক ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাস্ট সৃষ্টি করা যায়।ট্রাস্টের ব্যবহার আমাদের দেশে ব্যাপক হারে হয় না বলেই ট্রাস্ট সম্পর্কে অনেকের ধারণা খুব কম। কেউ তার সম্পত্তি নিরাপদ হেফাজতের জন্য ট্রাস্ট করতে চাইলে বা মৃত্যুর পরও যেন তার সম্পত্তি হেফাজতে থাকে সেজন্য ট্রাস্ট করতে পারেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই ট্রাস্ট করতে পারেন।লেখক : রফিকুর রহমান পাটওয়ারীঅবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ
কারো পক্ষে ট্রাস্টের সন্তোষজনক সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন আইনশাস্ত্রবিদ ট্রাস্টের সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণের চেষ্টা চালিয়েছেন। অধ্যাপক মেইটল্যান্ড ট্রাস্টের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, 'যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি তাঁর ওপর অর্পিত অধিকার অপর কোনো ব্যক্তির পক্ষে ব্যবহার অথবা বিশেষ উদ্দেশ্যে বা কার্য সম্পাদনের জন্য ব্যবহার করতে বাধ্য থাকবেন, তাঁর ক্ষেত্রে সম্পর্কযুক্ত অধিকার ট্রাস্ট হিসেবে গণ্য হবে।' আইনবিজ্ঞানী কিটনের মতে, 'ট্রাস্টের উৎপত্তি তখনই ঘটে, যখন ট্রাস্টি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোনো স্থাবর, অস্থাবর বা ব্যক্তির উপভোগের জন্য, যাদের মধ্যে সে নিজেও একজন হতে পারে অথবা বৈধ কোনো কার্য সম্পাদনের জন্য রক্ষণাবেক্ষণের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে।' আন্ডার হিলের মতে, অছি হলো 'একটি ন্যায়সংগত বাধ্যবাধকতা যা মানুষের সুবিধার্থে কোনো ব্যক্তিকে তাঁর নিয়ন্ত্রিত সম্পত্তির সংস্পর্শে আসতে বাধ্য করে।'সাধারণ অর্থে ট্রাস্ট হলো এক ব্যক্তি তাঁর অধিকার ও কর্তব্য অপর কোনো ব্যক্তির কাছে দায়বদ্ধ রাখাকে বোঝায়। ১৮৮২ সালের ট্রাস্ট আইনের ৩ ধারায় ট্রাস্টের ব্যাখ্যা হলো, 'ট্রাস্ট হলো সম্পত্তির মালিকানার সঙ্গে সংযুক্ত দায়িত্ব, যা অন্যের বা অন্যের ও মালিকের উপকারার্থে মালিকের ওপর অর্পিত ও মালিক কর্তৃক গৃহীত অথবা তৎকর্তৃক ঘোষিত ও গৃহীত আস্থা থেকে উদ্ভূত'।একেবারে সহজ ভাষায় ট্রাস্ট হলো একজনের সম্পত্তি অপরের উপকারার্থে অন্যের হাতে সমর্পণ করা। একটি উদাহরণের মাধ্যমে ট্রাস্টকে বোঝানো যেতে পারে। যেমন_করিম তার সম্পত্তি রহিমের কল্যাণে শফিকের কাছে অর্পণ করল। হয়ে গেল ট্রাস্ট সৃষ্টি। যে ট্রাস্ট করে তাকে বলা হয় ট্রাস্ট কর্তা। যে ট্রাস্ট গ্রহণ করে বা যার বরাবরে ট্রাস্ট করা হয় তাকে বলা হয় ট্রাস্টি। যার উপকারার্থে ট্রাস্ট করা হয় তাকে বলা হয় লাভভোগী। যে সম্পত্তি নিয়ে ট্রাস্ট করা হয় তাকে বলা হয় ট্রাস্ট সম্পত্তি। যে দলিলের মাধ্যমে ট্রাস্ট সৃষ্টি করা হয় তাকে বলা হয় ট্রাস্ট দলিল।ট্রাস্ট আইনের ইতিহাস : প্রথমে ট্রাস্ট ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রচলিত থাকলেও পরে ধর্মনিরপেক্ষ ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হয়। বিশ্বাসই একমাত্র ট্রাস্টের সৃষ্টি। একজনের স্বত্বভোগের জন্য অপরের অনুকূলে সম্পত্তি অর্পণকে ট্রাস্ট বলা হয়। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের রাজত্বকালে রোমান ক্যাথলিক পাদ্রিরা চার্চের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে ভূসম্পত্তির অধিকারী হতে পারতেন না। জনগণের দান ছিল তাঁদের ভরণ-পোষণের একমাত্র উৎস। যেসব জনগণ চার্চের পাদ্রিদের সম্পত্তি দান করতে ইচ্ছুক হতো; তারা সেই সম্পত্তি 'বরো' (ইড়ৎড়ঁময) নামে এক সমপ্রদায়কে অর্পণ করত। পাদ্রিরা এই সম্পত্তির ওপর স্বত্বভোগ করতেন। চার্চের পাদ্রি বা ধর্মযাজকরা এই সম্পত্তির আয় থেকে নিজেদের ভরণ-পোষণের কাজ চালাতেন। উলি্লখিত পদ্ধতিতে ধর্ম-যাজকদের ভরণ-পোষণের নিমিত্তে সম্পত্তি অর্পণ বর্তমান যুগের ট্রাস্টেরই অনুরূপ। এবার বলা যায় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের রাজত্বকালেই ট্রাস্টের উৎপত্তি হয়ে বর্তমানে এসেছে।ইকুইটি বা ন্যায়পরতা আদালত প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে 'কমন-ল' অনুসারে বিচারকার্য পরিচালিত ও সম্পাদিত হতো। 'কমন-ল' আদালতের বিচারকরা প্রচলিত আইন অনুসারে বিচারকার্য সমাধা করতেন বলে বিচার হয়ে উঠেছে আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ। ইংল্যান্ডের প্রচলিত সাধারণ প্রথা ও রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করেই 'কমন-ল' গড়ে উঠেছিল। যে কারণে বিচারকার্য পরিচালনার সময় বিচারকরা সব রকমের বিচার নিষ্পত্তির জন্য সুস্পষ্ট বিধান 'কমন-ল'-এর মধ্যে খুঁজে পেতেন না। যার জন্য সেসব বিষয়ে 'কমন-ল' কোর্টেরবিচারকরা কোনো সুষ্ঠু প্রতিকার দিতে সক্ষম হতেন না। প্রতিকারের আশায় জনগণ রাজার কাছে যেত এবং রাজার আদেশে চ্যান্সারি বিভাগ বিচার-বিবেচনা ও ন্যায়-নীতিবোধের আলোকে এগুলোর বিচার সম্পাদন করতেন। এভাবে বিচারকার্যে চ্যান্সারি বিভাগ ইকুইটি বা ন্যায়পরতার প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে ১৮৭৩ এবং ১৮৭৫ সালে জুডিকেচার অ্যাক্ট (ঔঁফরপধঃঁৎব অপঃ) পাস করা হয়। যার মাধ্যমে ইকুইটি এবং পূর্বে প্রচলিত 'কমন-ল'-এর মিলন ঘটানো হয়। এভাবে উভয় আইনের সংমিশ্রণে নতুন আইনের আধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়। উলি্লখিত অ্যাক্ট দুটির মাধ্যমে ইকুইটি কোর্ট ও 'কমন-ল' কোর্টের পৃথক এখতিয়ার বিলোপ করে সে স্থলে হাইকোর্ট অব জাস্টিস ( ঐরময পড়ঁৎঃ ড়ভ ঔঁংঃরপব) স্থাপন করা হয়। এর অধীনে চ্যান্সারি কোর্ট, কিংস বেঞ্চ, প্রবেট ও এডমিরালটি বিভাগ স্থাপিত হয়। এরূপ প্রত্যেক কোর্টকেই ইকুইটি এবং 'কমন-ল' প্রয়োগের এখতিয়ার দেওয়া হয়।এ দেশে ট্রাস্ট আইনের প্রচলন : চতুর্দশ শতাব্দীতে ট্রাস্টের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ব্রিটিশ ভারতে বিভিন্ন নামে ও বিভিন্নভাবে ট্রাস্টের প্রচলন ছিল। ১৮৮২ সালের আগেও ব্রিটিশ ভারতে দণ্ডবিধি, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, দেওয়ানি কার্যবিধি, তামাদি আইনে ট্রাস্টের অবস্থান পাওয়া যায়। এই আইনগুলোর ও ব্রিটিশ ট্রাস্ট আইনের সংমিশ্রণে ১৮৮২ সালে এ উপমহাদেশে ট্রাস্ট আইন প্রণয়ন করা হয়। পরে বাংলাদেশেও ১৮৮২ সালের ট্রাস্ট আইন বলবৎ রাখা হয়।ট্রাস্ট গঠন : সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ও উত্তরাধিকার আইনের সঙ্গে ট্রাস্ট আইনের সামঞ্জস্য রাখা হয়েছে। ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী একটি ট্রাস্ট গঠনে তিন পক্ষের প্রয়োজন। ট্রাস্ট কর্তা, ট্রাস্টি এবং লাভভোগকারী বা স্বত্বভোগী। ট্রাস্ট সৃষ্টিতে তিনটি নিশ্চয়তার প্রয়োজন।যেমন :১। বক্তব্যের নিশ্চয়তা : ট্রাস্ট গঠন করতে হলে ট্রাস্ট কর্তার বক্তব্য পরিষ্কার থাকতে হবে। সুস্পষ্ট ভাষায় ট্রাস্ট দলিল লিখতে হবে। যেন ট্রাস্ট কর্তার বক্তব্য পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। ট্রাস্ট সৃষ্টিকারীর বক্তব্যের ওপর ট্রাস্টের বৈধতা বহুলাংশে নির্ভর করে।২। বিষয়বস্তুর নিশ্চয়তা : ট্রাস্টের বিষয়বস্তুর অস্তিত্ব অবশ্যই থাকতে হবে। সহজ কথায় যে বিষয় নিয়ে ট্রাস্ট করা হবে বিষয়টির অস্তিত্ব বাস্তবে থাকতে হবে। সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৬ ধারা মোতাবেক বাংলাদেশে যেসব সম্পত্তি হস্তান্তরযোগ্য কেবল সেসব সম্পত্তিই ট্রাস্টের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। ট্রাস্টের সম্পত্তি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে। সম্পত্তিতে লাভভোগীর স্বার্থ নির্দিষ্ট করে দিতে হবে।৩। উদ্দেশ্যের নিশ্চয়তা : যে উদ্দেশ্যে ট্রাস্ট সৃষ্টি করা হয়, সে উদ্দেশ্য অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে এবং সুনির্দিষ্টভাবে ট্রাস্ট দলিলে উল্লেখ করতে হবে। ট্রাস্টকৃত সম্পত্তির কে বা কারা লাভভোগী হবে এবং কতটুকু হবে তা উল্লেখ করতে হবে। যে ট্রাস্টের উদ্দেশ্য আইন মোতাবেক হতে হবে। বেআইনি কোনো কর্মের উদ্দেশ্যে ট্রাস্ট করা যাবে না।ট্রাস্ট সৃষ্টি : যদিও ট্রাস্ট সৃষ্টির কোনো নির্দিষ্ট ছক নেই তবুও নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে ট্রাস্ট সৃষ্টি করা যায়।* উইল বা আজীবন স্থায়ী দলিলের মাধ্যমে।* ট্রাস্ট সৃষ্টিকারী কর্তৃক সুস্পষ্ট ভাষায় ট্রাস্টের উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু লাভভোগীদের কথা ঘোষণার মাধ্যমে।* ট্রাস্টদাতার স্বাক্ষরযুক্ত লিখিত দলিলের মাধ্যমে।* স্থাবর সম্পত্তি সম্পর্কিত ট্রাস্ট অবশ্যই লিখিত এবং রেজিস্ট্রিকৃত হবে।* অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ট্রাস্টির অনুকূলে ট্রাস্ট দলিলের বিষয়বস্তু হস্তান্তর করতে হবে।* স্থাবর সম্পত্তি সম্পর্কিত ট্রাস্টের ক্ষেত্রে ট্রাস্টির বরাবরে ট্রাস্ট দলিল ও তার মালিকানা হস্তান্তর করতে হবে।* উইলের মাধ্যমে ট্রাস্ট গঠন করতে হলে তা অবশ্যই দলিলে উল্লেখ করতে হবে।* অস্থাবর সম্পত্তির মৌখিক ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাস্ট সৃষ্টি করা যায়।ট্রাস্টের ব্যবহার আমাদের দেশে ব্যাপক হারে হয় না বলেই ট্রাস্ট সম্পর্কে অনেকের ধারণা খুব কম। কেউ তার সম্পত্তি নিরাপদ হেফাজতের জন্য ট্রাস্ট করতে চাইলে বা মৃত্যুর পরও যেন তার সম্পত্তি হেফাজতে থাকে সেজন্য ট্রাস্ট করতে পারেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই ট্রাস্ট করতে পারেন।লেখক : রফিকুর রহমান পাটওয়ারীঅবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ