বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু

যৌবনে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া, গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন, সেখানে মুসলিম সেবক সংঘ প্রতিষ্ঠা করা এবং কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়ন, মুসলিম লীগের যুবনেতা হিসেবে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তৃণমূল পর্যায়ে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রচেষ্টা সবই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের রাজনীতি কেন্দ্রিক ঘটনা। তবে তিনি গণতন্ত্র ও রাজপথের রাজনীতির সঙ্গে উদারনৈতিক চেতনা পেয়েছেন সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য থেকে। যাঁকে তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের সব জায়গায় ‘শহীদ’ নামে অভিহিত করেছেন। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করা হয়। ১৯৫৩ সালে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে দলটির নামকরণ হয় ‘ছাত্রলীগ’। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পরে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। দলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রগামী করেছিল। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি ইসলাম ও বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের সামগ্রিক মঙ্গল প্রত্যাশায় উজ্জীবিত ছিলেন আমৃত্যু। আবার বাঙালির দোষত্রুটি নিয়ে সমালোচনাও করেছেন নির্মমভাবে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র একটি অংশে তিনি লিখেছেন- ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি।’ পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন ঊর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।’ মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ধর্ম ছিল ইসলাম এবং হযরত মুহম্মদ(দঃ) তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় পয়গম্বর ছিলেন। কিন্তু অন্য সব ধর্মের প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। তিনি ছিলেন প্রকৃত প্রস্তাবে একজন একনিষ্ঠ মানব পূজারি। সব ধর্মই মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত- সেই কল্যাণধর্মের তিনি ছিলেন উপাসক।  একজন মুসলমান হয়েও এই কল্যাণধর্মের উপাসক হওয়া যায়- এতে তাঁর কোনো মানসিক বিরোধ ঘটেনি। কেননা তাঁর মতে, ইসলাম মানব-কল্যাণ চেতনার উজ্জ্বল নক্ষত্র। এ কারণেই একজন যথার্থ বাঙালি এবং একজন মুসলমান হওয়ার পথে কোনদিন তিনি কোনো বিরোধের সম্মুখীন হননি। তিনি যে বাঙালি এজন্য গর্বিত, আবার তিনি যে মুসলমান এজন্যও তাঁর গর্ব কম ছিল না। তবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি পর্বে দলের বিশ্বাস ও নিজের জীবন দর্শনকে একীভূত করে নিয়েছিলেন তিনি। [caption id="attachment_40614" align="alignleft" width="200"]যৌবনে বঙ্গবন্ধু যৌবনে বঙ্গবন্ধু[/caption] বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল শোষণহীন রাষ্ট্র ও
সমাজ গড়ে তোলা। রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের অপব্যবহার ও সমাজে ধর্মের নামে হানাহানির ঘটনা দেখেছিলেন তিনি। ভারতবর্ষের দাঙ্গার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। পাকিস্তানি শাসনামলে ধর্মকে সামনে রেখেই পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিকে শাসন ও শোষণ করেছে। এজন্য সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা করলেও বঙ্গবন্ধু ধর্মান্ধতাকে ঘৃণা করতেন। ধর্মকে মেনে নিয়ে উদারনৈতিক চিন্তাধারায় অভ্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। সব ধর্মের সহাবস্থান এবং বদ্ধ চিন্তার মুক্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতা পূর্ণতা পায়। সারা ভারতজুড়ে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় তাঁর ভূমিকার কথা আছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ৬৩ থেকে ৭৫ পৃষ্ঠায়। প্রথাবদ্ধ, ধর্ম-শাসিত সংস্কারাছন্ন জীবন তিনি পছন্দ করেননি। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার জন্য ধর্মের গণ্ডি ভেঙে প্রগতির পথে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে ছিল তাঁর নীতি আদর্শ। বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রূপটিকে ধরতে চেয়েছেন তিনি তাঁর রাষ্ট্র পরিকল্পনায়, সংবিধান প্রণয়নে। আর এখানেই বঙ্গবন্ধু চিরস্মরণীয় একটি নাম। তিনি লিখেছেন, ‘আমি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অনেক জায়গায় ঘুরেছি।’ বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা থেকে শুরু করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্বদিন পর্যন্ত দেশের গণমানুষের উন্নয়নের কথা বলেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিল তাঁর রাষ্ট্রনীতি। তিনি সবসময় শোষিতের মুক্তি কামনা করেছেন। আজীবন সংগ্রামে যেমন তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি; তেমনি স্বাধীন দেশের সমাজকে সকল অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত করার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচিতেও শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলেন। তিনি দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আওয়ামী লীগের মাথা কেনার মতো ক্ষমতা পুঁজিপতিদের নেই।’ সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে ১৬ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছে।’ এসব মুনাফাখোর কালোবাজারিদের কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি করে দেন তিনি। এসময় তিনি শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্য ধৈর্য ধরে কাজ করার কথাও বারবার উল্লেখ করেন। আত্মজীবনীর বিবরণ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, সাতচল্লিশের দেশভাগের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্নাত হন। তিনি বলেছেন, দেশ ভাগের পর ভাষা-আন্দোলন ও ছয়দফা পর্যন্ত যদি বাংলার রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করো, তাহলে দেখবে অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলার সুপ্ত চেতনার জন্ম সাতচল্লিশের বাংলাভাগের আগেই এবং সেই চেতনারই প্রথম বহিঃপ্রকাশ আটচল্লিশ সালেই অসাম্প্রদায়িক ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আর ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। রাজনীতি করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে নানা সমস্যা ও সংকটময় পথ পরিক্রমা করতে হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।’ একইসঙ্গে তিনি বলে গেছেন অন্যান্য দলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আদর্শের কথা। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর আচরণের সমালোচনা করার সময় কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছাত্রদের কর্মকাণ্ডকেও তিনি একটি মন্তব্যে স্পষ্ট করেছেন। ‘দুই চারজন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছাত্র ছিল যারা সরকারকে পছন্দ করত না। কিন্তু তারা এমন সমস্ত আদর্শ প্রচার করতে চেষ্টা করত যা তখনকার সাধারণ ছাত্র ও জনসাধারণ শুনলে ক্ষেপে যেত।’ এতৎসত্ত্বেও জনগণের পক্ষে কথা বলেছেন তিনি সাহসের সঙ্গে; পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন দৃঢ় চিত্তে। ২. বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘বঙ্গবন্ধু’ একটি প্রভাব বিস্তারি শব্দ। স্বাধীনতার আগে ভাষা-আন্দোলন এবং পরবর্তী সময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের এমন কোনো বিষয় নেই যার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল না। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান ছিলেন। তিনি মানুষের চৈতন্যে প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং মানুষ তাঁর সম্পর্কে কিছু না কিছু বলে আত্মতৃপ্তি অর্জন করেছে। ভারতীয় সাহিত্যে মাহাত্মা গান্ধী যেমন মানুষের কাছে লেখার উৎস ও প্রেরণায় পরিণত হয়েছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধু অনেক লেখককে কেবল নয় দেশের শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুতে উন্মোচিত হয়েছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে কবির চেতনা-মননে অব্যক্ত বেদনার নির্ঝর নিঃসরণ হয়েছে। আবার বাংলা শিল্প-সাহিত্যে তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দুঃখ বাংলাদেশের সাহিত্যে ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ নাম দিয়ে একটি সময়-পর্ব এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। অথচ ভারতীয় সাহিত্যে ‘গান্ধী-যুগ’ বলে একটি কালপর্ব নির্দিষ্ট হয়েছে। বিশেষত ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সাহিত্যের দু’যুগের বেশি সময় ‘গান্ধী-যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত। কেন এই চিহ্নিতকরণ? কারণ এই মহামানবের জীবন ও কর্মের ব্যাপক প্রভাব। ভারতের এমন কোনো ভাষা-সাহিত্য-শিল্পকর্ম নেই যেখানে গান্ধীজি নেই। সেই তুলনায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্যে অপ্রতুল হলেও এই স্বাধীনতার মহানায়কের জীবন ও কর্ম আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের চেতনায় নাড়া দিয়েছে। বিশেষত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পটভূমি বিপুল সংখ্যক কবি-সাহিত্যিককে আন্দোলিত করেছে। মহানায়কের কথা, কাজ, শখ, বাগ্মীতা, বক্তব্য, তাঁর শারীরিক অঙ্গভঙ্গি সবকিছুরই দ্বারা আলোড়িত হয়েছেন সৃজনশীল ব্যক্তিরা। বাগ্মীতায় জনগণকে মুগ্ধ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। সেজন্য সামাজিক মানুষের হৃদয়ে প্রবেশে তাঁর কষ্ট করতে হয়নি। জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহজ-সরল মাধ্যম ব্যবহার করেছিলেন বঙ্গবন্ধু; তাতে মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। গান্ধীর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে প্রভাব জনগণের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল, চেতনাকে করেছিল পরিশুদ্ধ, ধারণা দিয়েছিল পাল্টে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাহিত্য-চলচ্চিত্র-কবিতার মুখ্য উপাদান। ১৯৮২ সালে নির্মিত Richard Attenborough- এর ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্রটি পৃথিবীব্যাপি মানুষকে আন্দোলিত করেছিল। ইংরেজিতে লেখা মুলক রাজ আনন্দ্, রাজা রাও, আর কে নারায়ণের উপন্যাস পড়ে এ ছবির নির্মাতা গল্পের উপকরণ সাজিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এধরনের ছবি বাংলাদেশে এখনো তৈরি হয়নি। তবে গান্ধী যেমন ভারতের ভাষা-সাহিত্যকে নতুন উদ্দীপনায় মুখরিত করেছিলেন তেমনি বাংলা সাহিত্যকে বঙ্গবন্ধু তাঁর চিন্তা ও জীবনযাপন দিয়ে সচকিত করে তুলেছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনা গল্পের প্রয়োজনে পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস ঘটনাকেন্দ্রিক হলেও বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত পরিস্থিতি, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, মানুষের জন্য ত্যাগের মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। গ্রাম বাংলার সহজ-সরল মানুষের কাছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে তাঁর মৃত্যু ছিল হাহাকারের; সেই অবস্থা তুলে ধরেছেন সাহিত্যিকরা। যদিও কোনো গল্প-উপন্যাসে ‘মুজিববাদে’র অনুপুঙ্খ রূপায়ণ নেই তবু একটি ‘আদর্শ বাঙালি রাজনৈতিক’ জীবনকে কেন্দ্র করে প্রভূত আখ্যান গড়ে উঠেছে। নাগরিক মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে লোকায়ত মানসে মুজিব চিরন্তন হয়ে ওঠার কাহিনীও তৈরি হয়েছে। এই মহানায়ক জীবনকে গড়ে নিয়েছিলেন বাঙালি ঐতিহ্যের পরিপূরক করে। আর শ্রমজীবী মানুষের প্রাণের নেতা হওয়ার জন্য তাঁকে হাসিমুখে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। সাধারণ জনতার কাছে তাঁর পৌঁছে যাওয়া এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর চেতনা ছড়িয়ে পড়েছিল যাত্রায়, পালায়, কীর্তনে। গান্ধীজি ভারতবর্ষকে ‘সীতা মা’তে পরিণত করেছিলেন আর ব্রিটিশ শাসককে করেছিলেন রাবণের প্রতীক। রামায়ণের ধারণা ঢুকিয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে করেছিলেন প্রসারিত কেবল ধর্মভাবকে কাজে লাগিয়ে। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনতার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মানুষের অধিকারের কথা বলে। এজন্যই জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে তাঁর জীবন, আদর্শ, মতবাদকে কেন্দ্র করে অজস্র কবিতা লেখা হয়েছে। চিত্রকলা ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর অভিব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা সামনে কোনো বিকল্প দেখতে পাননি। এ কারণে তাঁরা ১৯৭৭ সালের পর সরাসরি বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে। এঁদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রও ধরেছেন কোনো কোনো লেখক। আর সেসময় থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেছেন সংগোপনে। তারই পরিণতিতে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই সাহিত্যে নতুন চিন্তার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছে। ধনী থেকে গরিব, জ্ঞানী থেকে নিরক্ষর তাঁকে কেন্দ্র করে রচিত ও পরিবেশিত গানের মুগ্ধ শ্রোতা এখনো। যে জনতা নয় মাসের যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছে ১৫ আগস্টের পরে সেই দেশবাসীর প্রতি তাঁর অকৃত্রিম দরদ টের পেয়েছিলেন সকলে। অসহায়, দুখী, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে তাঁকে সাধারণ মানুষের মতোই জীবন-যাপন করতে হয়েছিল। মূলত বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, তাঁর অতি সাধারণ জীবন-যাপন তাঁকে লেখকদের কাছে ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করে। তিনি যদিও আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন কিন্তু বৃহত্তর অর্থে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। তাঁর সম্পর্কে কিংবদন্তির প্রয়োজন ছিল না যদিও তাঁকে কেন্দ্র করে স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে নানান রহস্যময় ঘটনার প্রসঙ্গ। রাজা রাও, মুলক রাজ আনন্দ্ এবং আর কে নারায়ণের গল্প-উপন্যাসে গান্ধীকে যেমন কাহিনী বর্ণনায় নানা ঘটনা ও চরিত্রের বিচিত্র প্রকাশে তুলে ধরা হয়েছে। তেমনি বাংলা গল্প-উপন্যাস-কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে- বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শতাব্দী লালিত মূঢ়তা থেকে মুক্তির মন্ত্র। তাঁর আন্দোলন ছিল হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, দেশের গুপ্ত কমিউনিস্ট সর্বহারাদের বিরুদ্ধে নয়। বরং সর্বহারারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিসেনাদের হত্যা করেছিল তার চিত্র রয়েছে অনেক গল্পে। সাধারণ মানুষকে অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে রক্ষার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করা ও ভালোবাসায় সকলকে কাছে টানা ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশিষ্টতা। অপরাধ ও অপরাধীকে প্রশ্রয় না দেওয়া, সৎ ও নীতিপরায়ণ থাকা এবং ভণ্ডামি না করা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দেওয়া, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা না করা তাঁর সমগ্র জীবনের মুখ্য আদর্শ।  বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে বঙ্গবন্ধুর সেই চেতনা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্রই। মূলত তাঁর চেতনার প্রভাব শতাব্দী থেকে শতাব্দী প্রসারিত হয়েছে এবং আগামীতে তা বহাল থাকবে। [caption id="attachment_40616" align="aligncenter" width="534"]৭ মার্চের সেই জ্বালাময়ী ভাষণ ৭ মার্চের সেই জ্বালাময়ী ভাষণ[/caption] ৩. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির অনেক মাধ্যমে ধৃত হয়েছেন। সংগীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ম্যুরাল, মুদ্রণ শিল্পের নানা আধার যথা ডাকটিকেট, পয়সা ও টাকায় মুদ্রিত তিনি। সংগীতে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে একাত্তরের অনেক আগেই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের জয়ের ঘটনা স্মরণ করে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘সেই সময়ে কতকগুলি গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরি হয় ঢাকায়। একটি ছাত্রের বাড়ি ঢাকায়। সে পড়ে শান্তিনিকেতনে। তাকে পাঠাই বই কিনে আনতে। সে বই নিয়ে আসে। উপরন্তু আনে কয়েকটি রেকর্ড। আমাকে বাজিয়ে শোনায়, কিন্তু হাতছাড়া করে না। রেকর্ড শুনে আমি চমকে উঠি। পাকিস্তান সরকার বার করতে দিচ্ছে অমন সব রেকর্ড। তাতে শেখ মুজিবের বজ্রকণ্ঠ। কণ্ঠে বিদ্রোহের সুর। পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা। সে কী উন্মাদনাভরা গান। গেয়েছে তরুণ-তরুণীরা। আবার যেন সেই ১৯০৫ সালের স্বদেশি আমল ফিরে এসেছে। লোকে পাকিস্তানের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্য পাগল। যে বাংলাদেশ তাদের একান্ত আপনার।’ অন্নদাশঙ্কর রায় জানতেন না তারও আগে ১৯৫৪ সালে সুনামগঞ্জে বালুর মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় মুজিবের উপস্থিতিতে আবদুল করিম(পরবর্তীতে বাউল সম্রাট) গণসংগীত পরিবেশন করেন এভাবে- জয় জয় বল এগিয়ে চল হাতে লও সবুজ নিশান জাগরে মজুর কিষাণ পূর্ণচন্দ্রে উজ্জ্বল ধরা চৌদিকে নক্ষত্রঘেরা জনগণের নয়নতারা জনাব মুজিবুর রহমান। সাইদুর রহমান বয়াতি ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের সময় রচনা করেছেন এ গান- ৬ দফা কায়েম করিবে শেখ মুজিবের দাবি তাই দেখিয়া ইয়াহিয়ায় চালায় উল্টা চাবি বাঙালিদের বাঁচাইতে কান্দে মুজিবের প্রাণ বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পাকিস্তানিরা পাকিস্তানে যাও নইলে বাঁচিবেনা তোমার প্রাণ। আবার তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময়ও গান রচনা করেন ‘আওয়ামী লীগে নেতা হল শেখ মুজিবর’ শিরোনামে। এসময় আবদুল জব্বার বয়াতিও ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’ বলে গীত রচনা করেছেন। তবে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় একটি গানের কথায় বঙ্গবন্ধু ছড়িয়ে পড়েন সারা দেশে। গানটি হলো- মুজিব বাইয়া যাও রে নির্যাতিত দ্যাশের মাঝে জনগণের নাও (ওরে মুজিব)॥ মুজিব রে- ছলে-কলে চব্বিশ বছর রক্ত খাইলো চুষি জাতিরে বাঁচাইতে যাইয়া তুমি হইলা  দোষী. . .। আব্দুল লতিফের কথা ও সুর, মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে জাকির হোসেন ফকিরের স্বরলিপিতে গ্রামোফোন রেকর্ডে ধারণ করা হয় এ গানটি। সুরে ছন্দে বঙ্গবন্ধু মহিমান্বিত হন এখানে। ১৯৭১ সালে আবদুল লতিফ রচনা করেন আরো কয়েকটি গান। একটি ছিল ‘ঘরে ঘরে লক্ষ মুজিবর’। কারাবন্দি ও ফাঁসির ভয় দেখিয়ে অধিকারের লড়াই থামিয়ে রাখা যাবে না। বরং এক মুজিবকে ফাঁসি দিলে, বন্দি করলে লক্ষ মুজিব এগিয়ে আসবে। কারণ এ জাতি রক্ত দিতে শিখেছে। এই গানে বঙ্গবন্ধুকে জাদুকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। ১৯৭০ সালে লোকসংগীত শিল্পী অনিল দে বেশ কয়েকটি গান রচনা করেন। এসব গানে বঙ্গবন্ধু পূর্ণাঙ্গরূপে উঠে এসেছেন। যেমন- দেশের প্রেমিক শেখ মুজিবর ভাই তাঁর মতো আর দরদীয়া এ ধরাতে নাই সোনার নৌকায় পাল তুলিয়া শেখ মুজিবর যায় মনের আশা সফল করি ভোট দিয়ে তাঁর নায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রেরণাদীপ্ত গানে বঙ্গবন্ধু বিশিষ্টতায় ভাস্বর একটি শব্দ। সিকান্দার আবু জাফর, হরলাল রায়, গোবিন্দ হালদার, সলিল চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আপেল মাহমুদ, আবুবকর সিদ্দিক, নয়ীম গওহর, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, সৈয়দ শামসুল হুদা প্রমুখ গায়ক ও গীতিকার সুরকার যেসব সংগীতে উদ্দীপনা জাগিয়েছিলেন তাতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একটি প্রধান পাত্র। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের গায়ক-গায়িকার যৌথ প্রচেষ্টায় সেই সময় স্বাধীনতা অর্জনের প্রেরণা জাগ্রত ছিল। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের রচনায় শিল্পী ও সুরকার ছিলেন অংশুমান রায় এই জনপ্রিয় গানটির - শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রণি বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ ॥ সমগ্র বাংলার সকল মানুষের ভেতর মুজিবের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে এই ভাবনা দৃঢ়মূল হয় যে, একজন লোকান্তরিত মুজিব অনেক বেশি জীবন্ত, একজন জীবন্ত মুজিবের চেয়ে। অবশ্য এই গানটি রচিত হয় ১৯৭১ সালে। ২৫ মার্চে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবের অবর্তমানে জন্ম হয় লক্ষ মুজিবের, যারা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশকে ভালোবাসে মুজিবের ভালোবাসার মতো করে। এ সময়ের লক্ষ মুজিব স্বপ্ন দেখে রূপসী বাংলার, স্বপ্ন দেখে জয় বাংলার। প্রতিক্রিয়াশীলদের বিপত্তি সত্ত্বেও পূর্ব আকাশে দিনমণির স্বপ্ন দেখে এই লক্ষ মুজিব। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় অন্য একটি গানের অংশ এরকম- আমরা সবাই বাঙ্গালী এই বাংলার কথা বলতে গিয়ে বিশ্বটাকে কাঁপিয়ে দিলো কার সে কণ্ঠস্বর মুজিবর, মুজিবর, মুজিবর। [caption id="attachment_40621" align="alignleft" width="230"]পোস্টারে বঙ্গবন্ধু পোস্টারে বঙ্গবন্ধু[/caption] অন্যদিকে শ্যামল গুপ্তের কথায় এবং বাপ্পী লাহিড়ীর সুরে মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের গাওয়া একটি গান- সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম- মুজিবর, মুজিবর, মুজিবর। সাড়ে সাত কোটি প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম- জয় বাংলা, জয় মুজিবর, জয় বাংলা, জয় মুজিবর। মুক্তিযুদ্ধের সময় শারীরিকভাবে অনুপস্থিত বঙ্গবন্ধু এভাবেই জীবিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। আবুবকর সিদ্দিকের ‘আজ যুদ্ধ’, হরলাল রায়ের ‘দুর্গ বানাও ঘরে ঘরে’, শহিদুল ইসলামের ‘জগৎবাসী একবার আসিয়া’, মো. মোশাদ আলীর ‘সত্য এ যে ঘটনা’, হাফিজুর রহমানের ‘আমার নেতা শেখ মুজিব’, মো. মোশাররফ আলীর ‘ইয়াহিয়া জঙ্গি সরকার’, মোমতাজ আলী খানের ‘ইয়াহিয়ার গৃহবাস’, নূর মোহাম্মদ খানের ‘তোরা জাগরে জাগ’ প্রভৃতি গানে বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে ইয়াহিয়া ‘খল’ আর বঙ্গবন্ধু ‘মহানায়ক’। কয়েকটি অংশ স্মরণীয়- ক) তাই এই যুদ্ধ- বাংলার সুকান্ত সূর্য সেন মুজিবের বাঁচবার জন্যে যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ খ) শেখ মুজিবর বাংলার বন্ধু বাঙালিদের আশার সিন্ধু মুক্ত করবেন এ দেশ তিনি দিয়ে শেষ রক্তবিন্দু। গ) হাইলার বন্ধু শেখ মুজিব, জাইলার বন্ধু শেখ মুজিব, কুলির বন্ধু শেখ মুজিব, ঢুলির বন্ধু শেখ মুজিব, আহা এমন বন্ধুর তুলনা আর নাই। ঘ) ইয়াহিয়ার গৃহবাস ভুট্টার ক্ষেতে করছে সর্বনাশ ইয়াহিয়া এখন ভুট্টা খাইয়া করছে এখন হায় হুতাশ॥ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত ও অন্য বহুবিধভাবে গীত হতো আরো কিছু গান। রজ্জব আলী দেওয়ান, রেজাউল করিম চৌধুরী, আজিজ-উল-ইসলাম, মো সিরাজুল ইসলাম, আবদুল গনি বোখারী, এস. এম. হেদায়েত প্রমুখের গানে একদিকে একাত্তরে মুক্তিকামী মানুষের আকাক্সক্ষা প্রকাশ পেয়েছে অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা ব্যক্ত হয়েছে। যেমন- ক) কোটি কোটি জনতার বিপ্লবী চেতনায় হে মহান নেতা জাতির পিতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব। খ) জন্ম তোমার ধন্য হোল শেখ মুজিবর ভাই তোমার নামের জারি সারি গাই যে সর্বদাই॥ ওরে ও. . . গ) মাঝিমাল্লা বৈঠা মার সমানে সমান বাহুর বলে ধরে তোলো সংগ্রামী নিশান জোরে চালাও আরো জোরে কিসের ঝড়-তুফান ‘মুজিব’ নামে যাবে নৌকা চলিয়া উজান হেইয়ারে হেইয়া হেইয়া হো॥ বঙ্গবন্ধু গীতিকারদের কাছে আরাধ্য বীর। সেই বীরের বন্দনা এজন্য মুখ্য হয়ে উঠেছে গানের কথা ও সুরে। ১৯৬৯ সালের ৩০ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত সংবর্ধনার জবাবে রবীন্দ্রনাথের বাণী দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,/ আমি তোমাদেরই লোক।’ প্রকৃতপক্ষেই তিনি আমাদের আপনজন ছিলেন। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে তাঁর সরব উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ প্রকাশিত মোস্তফা জামান আব্বাসী সম্পাদিত ‘স্বাধীনতা দিনের গান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ৭৮টি গান। পাকিস্তানিদের আক্রমণের মুখেও নিজেকে রক্ষা করে গীতিকার-গায়করা রাতদিন যে পরিশ্রম করেছিলেন সে সবই তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে। স্বাধীনতার বন্দনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্তোত্র একটি অন্যতম অনুষঙ্গ এসব শিল্প প্রচেষ্টায়। মূলত শতাধিকেরও বেশি গানে বঙ্গবন্ধু উদ্ভাসিত হয়েছেন। গানের মধ্য দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলার স্বাধীনতা এনেছেন মুজিবর, তিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির নাম, পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন দেশের ইতিহাস মুজিব, তিনি আছেন প্রত্যেকের ঘরে ঘরে, দেশ ও দশের নেতা শেখ মুজিবকে বজ্রকণ্ঠের জন্য মানুষ এখনো মনে রেখেছে, একাত্তরে পাকিস্তানের কারাগার ভেঙে বঙ্গবন্ধুকে আনতে চেয়েছেন কেউ কেউ। গীতিকাররা মুজিবের নামেই শপথ নিয়েছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে কেঁদে ভাসিয়েছেন বুকে। তারপর বিজয় নিশান উড়িয়েছেন যদিও বলেছেন, পাশে নেই আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ৪. উদীচী প্রযোজিত ও মাহমুদ সেলিম রচিত ‘ইতিহাস কথা কও’-এ বঙ্গবন্ধু উন্মোচিত হয়েছেন এবং নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নাটক শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটের উপস্থাপনায় বঙ্গবন্ধুকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। এছাড়া শামসুদ্দিন আহমেদ রচনা করেছেন ‘বাংলাদেশের শেখ মুজিব’ নামে একটি দীর্ঘ শ্রুতিনাটক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এখনো নতুন নতুন গান রচিত ও ক্যাসেটবদ্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি আবৃত্তির ক্যাসেটও।’ তবে ১৫ আগস্টের পরে ক্যাসেটের মাধ্যমে গান-কবিতার সম্মিলনে প্রতিবাদী শিল্পচর্চা শুরু হয়েছিল। ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা’ এ ধারার একটি ক্যাসেট বের করা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। এটি গ্রন্থনা করেছিলেন কবি কামাল চৌধুরী, ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সাজেদ আকবর এবং সংগীত পরিচালনায় ছিলেন লিয়াকত আলী আখন্দ। ঢাকার ‘প্রত্যয় সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন’ বের করেছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দশটি গানের একটি অ্যালবাম(ক্যাসেট)। ‘ধ্রুবতারা তুমি দেখাও নিশানা’ নামের গানগুলোর কথা ও সুর ড. এস. কে. চৌধুরীর। গীতিকার ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামের রচনায় ২০১০ সালে ১২টি গান নিয়ে বের হয়েছে ‘বাঙ্গালী জাতির সেরা গর্ব’ শীর্ষক ক্যাসেট। এ ধরনের আরো অনেক অ্যালবামের গানে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে। [caption id="attachment_40617" align="aligncenter" width="546"]বাবা-মায়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বাবা-মায়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু[/caption] ৫. বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য ছবি আঁকা হয়েছে। শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের রঙ-তুলির আঁচড়ে বঙ্গবন্ধুকে আমরা নতুন করে উপলব্ধি করতে শিখেছি। সাম্প্রতিককালে বিমূর্ত চিত্রকলার অন্যতম শিল্পী নাজমা আক্তার অনেকগুলো মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে রঙ-রেখায় শিল্পিত করে তুলেছেন। পোস্টার তৈরি হয়েছে ষাটের দশক থেকে। নতুনতর মর্যাদায় মহান নেতাকে মুক্তিযুদ্ধের পোস্টারে শিল্পীরা তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত গ্রন্থের প্রচ্ছদে জাতির পিতার সরব উপস্থিতি ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে। গ্রন্থের প্রচ্ছদ ও পোস্টার শিল্পীরা হলেন- কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, বীরেন সোম, সমর মজুমদার, সৈয়দ ইকবাল ও ধ্রুব এষ প্রমুখ। শিল্পীরা সৃজনশীল মাধ্যমে জাতির পিতার সৌম্যময় দৈহিক অবয়ব ও মুখের অভিব্যক্তিতে নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। জাতির জনকের বিভিন্ন সময়ের আলোচনা ও বক্তৃতা থেকে ১৬টি কথার সঙ্গে ১৬ জন শিল্পীর আঁকা ছবি আছে শুভেচ্ছা পত্র-১ সিরিজে। এই শিল্পীরা হলেন- কাইয়ুম চৌধুরী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, বীরেন সোম, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ ইকবাল, ফরিদা জামান, সামসুদ্দোহা শেখ আফজাল, কনকচাঁপা চাকমা, রব্বানী শামীম, শাহজাহান আহমেদ বিকাশ, আবদুল মোমেন মিল্টন, এস কে মেহেদী কামাল, সোহাগ পারভেজ। শাহাবুদ্দিন আহমেদ অঙ্কিত বঙ্গবন্ধুর দীপ্ত তেজে দাঁড়িয়ে থাকা তেলরঙের ছবিটি অনন্য সাধারণ। শাহাবুদ্দিন থেকে শুরু করে কাইয়ুম চৌধুরী, বীরেন সোম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, সৈয়দ ইকবালের ছবিতে চশমাহীন বঙ্গবন্ধুর মুখ-অবয়ব চিত্রিত হয়েছে। এর মধ্যে সৈয়দ ইকবাল বঙ্গবন্ধুর তাকিয়ে থাকার পাশে কবুতর ও বাংলাদেশের পতাকা স্থাপন করায় ‘আমি বিশ্বাস করি না ক্ষমতা বন্দুকের নলে। আমি বিশ্বাস করি, ক্ষমতা বাংলার জনগণের কাছে’- এই ভাষণের অনিবার্যতাকে প্রকাশ করেছে। কনকচাঁপার চিত্রকর্মে বঙ্গবন্ধু ভিন্ন মাত্রায় উদ্ভাসিত। তিনি জাতির পিতার তর্জনি উঁচিয়ে ভাষণের ভঙ্গিটি ঠিক রেখে পুরো কম্পোজিশনে আরো অনেককিছু প্রদর্শন করেছেন। এখানে মুক্তিযুদ্ধ ও জনতার রেখাগুলো তাৎপর্য নিয়ে অঙ্কিত। একইভাবে জাতির জনকের বিভিন্ন সময়ের আলোচনা ও বক্তৃতা থেকে ১৬টি কথার সঙ্গে ১৪ জন শিল্পীর আঁকা ছবি আছে শুভেচ্ছা পত্র-২ সিরিজে। এই শিল্পীরা হলেন- কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, বীরেন সোম, রব্বানী শামীম, শাহজাহান আহমেদ বিকাশ, রবিউল ইসলাম, আবদুল মোমেন মিল্টন, এস কে মেহেদী কামাল, মাতুরাম চৌধুরী, মো. মাঈনউদ্দীন, সুমন বৈদ্য, রাসেল কান্তি দাস, অমিত নন্দী। কাইয়ুম চৌধুরী স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কথার সঙ্গে মিল রেখে তাঁর প্রতিকৃতি আঁকতে গিয়ে প্রাজ্ঞ পরিণত চেহারার চিত্র উপহার দিয়েছেন। শিশুদের মাঝে বঙ্গবন্ধুকে দেখিয়েছেন হাশেম খান। শান্তির কপোত উড়ানো বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছেন রফিকুন নবী। বীরেন সোম অঙ্কিত তর্জনি উঁচানো বঙ্গবন্ধুর ছবিটি ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এভাবে প্রত্যেক শিল্পী অন্তর্গত তাগিদ থেকে চিত্রগুলো অঙ্কন করেছেন। ‘বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের প্রতীক’ শীর্ষক চিত্রকলা প্রদর্শনী হয় শিল্পকলা একাডেমীতে ২০১২ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত। ১৩ দিনব্যাপি এই প্রদর্শনীতে পোর্ট্রেট শিল্পী শাহজাহান আহমেদ বিকাশের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকগুলো চিত্র প্রদর্শিত হয়। পেপার এবং ক্যানভাসে ৪০টি শিল্পকর্মে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপস্থাপনা ছিল তাৎপর্যবহ। ছবিগুলোতে বঙ্গবন্ধুর মুখাবয়বের দৃঢ়তা এবং সাহসী অভিব্যক্তি চিত্রিত হয়েছে। শিল্পী বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টির গভীরতা ও চিন্তার গাম্ভীর্যকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কিছু ছবি আছে যাতে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন মুহূর্তের স্মরণীয় প্রকাশভঙ্গি ও বিরল চাহনি অঙ্কিত হয়েছে। কিছু স্কেচে কিছুটা বাস্তববাদ ও অনুপুঙ্খ মুখাবয়ব চিত্রিত হয়েছে। মূলত শিল্পী বঙ্গবন্ধু চরিত্রের বহুমাত্রিকতাকে ধরতে চেয়েছেন বহুকৌণিক প্রকাশভঙ্গিতে। ঢাকা আর্ট সেন্টারে ‘জাগো অন্তর মম’ শিরোনাম দিয়ে ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট থেকে ২১ আগস্ট প্রদর্শিত হয়েছে ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধু চিত্রকলা। দেশের বিখ্যাত এবং নতুন শিল্পীর ছবি প্রদর্শনীতে স্থান পায়। বীরেন সোম, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, রণজিৎ দাস, খালিদ মাহমুদ, নাইমা হক, মাসুদা খানম প্রমুখ চিত্রশিল্পীর ছবি এখানে ছিল। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানো হয়; যিনি তাঁর জীবদ্দশায় কিংবদন্তি ছিলেন। এসব শিল্পীরা বিশ্বাস করেন তিনি বেঁচে আছেন মানুষের অন্তরে, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একীভূত সত্তা। শিল্পীরা তাঁর ছবি এঁকে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন। তাঁরা নিজের অস্তিত্বে বঙ্গবন্ধুকে উপলব্ধি করেছেন। প্রদর্শনীতে বঙ্গবন্ধুকে জনগণের নেতা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। একইসঙ্গে দেখানো হয়েছে তিনি শ্রমজীবী এবং বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছেন। বিভিন্ন শিল্পী তাঁকে বিচিত্রভাবে অঙ্কন করেছেন। কেউ কেই তাঁর ধ্যানমগ্ন, চিন্তাশীল মুখম-ল, কেউ বা তাঁর চোখের জ্যোতি ধরতে চেয়েছেন ক্যানভাসে। তাছাড়া জাতির পিতার নির্ভীক মুহূর্তগুলো ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। তেল রঙ, এ্যাক্রিলিক, প্যাস্টেল, মিক্সড মিডিয়া, জলরঙ প্রভৃতি মাধ্যম ও আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন শিল্পীরা। এখানে মনে রাখা দরকার অধিকাংশ শিল্পীদের চিত্রকলার মূল প্রেরণা বা অবলম্বন ছিল বঙ্গবন্ধুর আলোকচিত্রসমূহ। বিভিন্ন বয়সের, বিচিত্র মাধ্যমের কাজ ও একটি বিষয়ে আলোকপাত ছিল এই প্রদর্শনীর মূল বৈশিষ্ট্য। প্রদর্শনীতে ঠাঁই পাওয়া আহমেদ শামসুদ্দোহার চিত্রে বঙ্গবন্ধুর জনতার উদ্দেশ্যে পরিচিত অভিবাদনের ভঙ্গি আছে। ক্যানভাসের ফোকাল পয়েন্টে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু। শেখ আফজালের চিত্রে মহান নেতাকে দেখা যাচ্ছে একজন ক্ষুদে বালকের সঙ্গে কথা বলতে। মোহাম্মদ ইকবালের কালো, ধূসর আর পরিচিত আলোছায়ায় নেতার চিন্তান্বিত অবয়ব ধরা পড়েছে। অন্য একটি চিত্রে জাতির পিতা পাইপ মুখে ধোয়া উড়ছে, লাল এবং কালো রঙ ব্যবহৃত হয়েছে এখানে। বঙ্গবন্ধুর চোখকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন এই শিল্পী। আনিসুর রহমানের চিত্রে স্পেস একটা প্রধান বিষয়। তাঁর চিত্রকলায় লাল এবং কালোর ব্যঞ্জনায় চিত্রের বুননে স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি হয়েছে। নাজিব মোহাম্মদের ক্যানভাসের মাঝখানে বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র মানচিত্র ও হিজিবিজি কালির আঁচড় লক্ষণীয়। এভাবে অজস্র চিত্রে বঙ্গবন্ধু এখন মহিমান্বিত একটি নাম। ৬. ম্যুরাল ও ভাস্কর্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু এখন জনগণের কাছে পরিচিত একটি চেতনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জাতির পিতার প্রতিকৃতি ধ্বংস করা হয়েছিল, নষ্ট করা হয়েছিল তাঁর যাবতীয় নিদর্শন। সেসবের পুনর্স্থাপন আবার শুরু হয়েছে। যেমন, ১৯ এপ্রিল ২০১১ সালে মহাজোট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল বিল্ডিং-এ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন লনে তৈরি করা হয়েছে আরেকটি ম্যুরাল। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শনে যান এবং কৃষিতে ডিগ্রিধারীদের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেন। এখানে ম্যুরালের মূল অবয়বে একটি প্রতিকৃতি এবং নিচে কবিতার চরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ২০১২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি ম্যুরাল। বাংলাদেশ জাতীয় স্টেডিয়ামে স্থাপিত ম্যুরালটি নির্মাণ করেছে জাতীয় স্পোর্টস কাউন্সিল। ২০১২ সালের ১৪ জুলাই বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে দৃষ্টিনন্দন আরেকটি ম্যুরাল উন্মোচিত হয়েছে। সিটি মেয়রের উদ্যোগে দশ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ম্যুরালটি সে অঞ্চলের জনগণের ভালোবাসার নিদর্শন। এভাবে বঙ্গবন্ধু তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছেন। সোনারগাঁও জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। ৩৫ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জ ধাতু নির্মিত ভাস্কর্যটি ৭ মার্চের ভাষণের প্রেরণা থেকে উপস্থাপিত। যা সাধারণ মানুষকে এখনো প্রদীপ্ত করে। ১৩ ফেব্রুয়ারি(২০১২) এটি উদ্বোধন করা হয়। ২০১২ সালের ১৪ জুলাই পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুরূপ একটি ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। শামীম সিকদারের ডিজাইনে এটি নির্মিত। বঙ্গবন্ধু স্মরণে ২০০৬ সালের ৭ আগস্ট উদ্বোধন করা হয় ঢাকার গুলিস্তান ক্রসিং-এ স্থাপিত ‘বঙ্গবন্ধু স্কোয়ার মনুমেন্ট’। ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু সেতুর দুই পাড়ে স্থাপিত হয়েছে জাতির পিতার বিশাল প্রতিকৃতি। ভৈরবের কমলপুর বাস স্ট্যান্ডে ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপিত হয়েছে। শামীম সিকদার জগন্নাথ হল, উদয়ন স্কুল ও এস এম হলের কোল ঘেঁষে অনেকগুলো ভাস্কর্য স্থাপন করেছেন। তার মধ্যে জাতির পিতার অবয়ব সুউচ্চ। তাঁর মাথার ওপর দেশের পতাকা উড়ছে। শিখা চিরন্তনে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে স্বাধীনতা চত্বরে রয়েছে পোড়ামাটির ম্যুরাল; মুক্তিযুদ্ধের চিত্রণের ভেতর বঙ্গবন্ধুর নান্দনিক প্রতিকৃতি রয়েছে এখানে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মাণাধীন স্বাধীনতা স্তম্ভের পাশেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিবৃত করা হয়েছে ম্যুরালের মাধ্যমে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি স্বমহিমায় স্থান পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু সংগ্রহশালায় বঙ্গবন্ধুর দুটি ম্যুরাল ও একটি স্থাপত্য রয়েছে।  আর বত্রিশ নম্বর ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ কিংবা টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধি ক্ষেত্রের ম্যুরাল বহুল প্রচারিত, দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম। এছাড়া ঐতিহাসিক মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে ভাষণদানরত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। [caption id="attachment_40618" align="aligncenter" width="750"]ডাক টিকিটে বঙ্গবন্ধু ডাক টিকিটে বঙ্গবন্ধু[/caption] ৭. আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘পলাশি থেকে ধানমন্ডি’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত একমাত্র মঞ্চ নাটক। এটি প্রথম অভিনীত হয় ২০০৪ সালে লন্ডনে। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে নাটক লেখার পরিকল্পনা ছিল তাঁর অনেক আগে থেকেই। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর লন্ডনের ‘বাংলার ডাক’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় ‘মুজিব হত্যার নেপথ্যে’ নামে একটি ধারাবাহিক নিবন্ধ লেখেন। পরে এটি ‘ইতিহাসের রক্তপলাশ : ১৫ আগস্ট পঁচাত্তর’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই বইটির কাহিনী নিয়ে নাটক ‘পলাশি থেকে ধানমণ্ডির সৃষ্টি। তিনি লিখেছেন, ‘পলাশির যুদ্ধ ও সিরাজউদ্দৌল্লাকে হত্যার ঘটনা নিয়ে নাটক লেখা হয়েছিল ঘটনার পৌনে দু’শ বছর পর। আমি বঙ্গবন্ধু-হত্যা নিয়ে এই নাটক লিখেছি ঘটনার মাত্র ঊনত্রিশ বছর পর। এই কাহিনীর অনেক চরিত্র এখনো বেঁচে আছেন। ফলে আমাকে অনেক সতর্কতার সঙ্গে ঘটনা-বিন্যাস ঘটনাতে হয়েছে। যতদূর সম্ভব আমি বাস্তব সত্যের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি। এ জন্যে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা(কারণ আমি বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছাকাছি ছিলাম), নিজের সংগৃহীত তথ্য, নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য এবং বঙ্গবন্ধু-হত্যা মামলার যে রায় প্রকাশিত হয়েছে তার উপর নির্ভর করেছি। ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো চরিত্রকে উজ্জ্বল বা মসিমলিন করার চেষ্টা করিনি। সেদিক থেকে এটিকে একটি ডকুড্রামা বলা চলে। তবে সম্মিলিত পাঠকদের আমি সতর্ক করে নিচ্ছি যে, এটি বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ জীবন-ভিত্তিক নাটক নয়। এটি তার মর্মান্তিক হত্যা সম্পর্কিত নাটক। ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর বিশাল ও সম্পূর্ণ জীবন-ভিত্তিক নাটক রচনার ইচ্ছা আমার আছে।’ ১৭৫৭ সালের জুন মাসের পলাশি-ট্রাজেডির মতোই বিয়োগান্ত নাটক অভিনীত হয়েছে ১৯৭৫ সালের আগস্টে স্বাধীন বাংলাদেশে। সিরাজের পরিণতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণ সাদৃশ্যপূর্ণ। ঘটনা ও চরিত্রের মিলও অনিবার্য। খোন্দকার মোশতাক আহমদের চরিত্রের সঙ্গে মীর জাফরের চরিত্রের এবং ঢাকায় নিযুক্ত তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টারের সঙ্গে সিরাজের দরবারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি রবার্ট ক্লাইভের চরিত্রেরও মিল রয়েছে। পলাশির যুদ্ধের পর তখনকার বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা যেমন স্বাধীনতা হারিয়েছিল তেমনি ধানমন্ডি হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। এজন্যই এই নাটকের নাম ‘পলাশি থেকে ধানমন্ডি’ যথার্থ। নাটকটি পনেরটি দৃশ্যে রচিত। প্রথম দৃশ্যে সিরাজ ও বঙ্গবন্ধুর কথোপকথনের বিন্যাস রয়েছে। সিরাজ বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন, বাংলাদেশে পলাশির বিশ্বাসঘাতকতার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।(পৃ ২০) যুগে যুগে বিভিন্ন বেশে ভ-, শয়তান, প্রতারকরা পৃথিবীতে জন্ম নেয় তারাই বিচিত্র দেশে অভিন্ন ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম দৃশ্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এভাবে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা একই সমান্তরালে বিন্যস্ত করেছেন। পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় দৃশ্য থেকে অন্যান্য দৃশ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে খোন্দকার মোশতাক গ্যংদের কর্ম তৎপরতা এবং বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবন ও তাঁর পাশে বেগম মুজিব-শেখ হাসিনাসহ কিছু চরিত্রের উদ্ভাসন লক্ষ করা যায়। অপরদিকে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে বীরাঙ্গনা কুলসুম ও সৈনিক জাহান চরিত্রের নির্মম মৃত্যু ঘটনা নাট্যকাহিনীর জটিল আবর্ত হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। দৃশ্যের পর দৃশ্য উন্মোচনে জিয়াউর রহমানসহ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধীদের চিনতে যেমন সুবিধা হয় তেমনি জাতির পিতা কেন্দ্রিক ঘটনাগুলো মানবিক হয়ে উঠেছে। সংসারের ছোট ছোট বিষয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের নানা প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে এ নাটকে; যেখানে প্রেম-স্নেহ-মমতা ও মঙ্গল কামনায় উজ্জীবিত একদল শ্রেষ্ঠ মানুষের কথাও শুনতে পাই আমরা। তবে দেশি-বিদেশি রাষ্ট্রের আগ্রহ ও ষড়যন্ত্রের জটিল আবর্তে জিয়া, ফারুক আর মোশতাকের প্রতি ঘৃণা জাগ্রত হয় আমাদের। তাদের আচরণ দেখে ও তাদের সংলাপ শুনে নিষ্ঠুর মানুষদের চিত্র আমরা স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখি। তেমনি কয়েকটি দৃশ্যে সাধারণ মানুষ(সপ্তম দৃশ্য) এবং অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী কিংবা অপপ্রচারে বিশ্বাসী ধর্মাশ্রিত ইমামদের চরিত্রও(নবম দৃশ্য) জীবন্ত করে তুলেছেন নাট্যকার। অন্যদিকে কর্নেল তাহের অনুকম্পা পেয়েছেন নাট্যকারের। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিঃস্বার্থভাবেই ভালোবাসতেন। আবার বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনের কথোপকথন থেকে দেশের প্রশাসনের মধ্যে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা বিরোধী পক্ষের অবস্থানও পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। একটি অংশ- [caption id="attachment_40623" align="aligncenter" width="322"]মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য[/caption] তাজউদ্দিন: এবারের যুদ্ধ অনেক বেশি কঠিন লীডার। একাত্তরের যুদ্ধ ছিলো একটা বিদেশি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এবারের যুদ্ধ একসঙ্গে অনেক শত্রুর বিরুদ্ধে। এই শত্রুরা আপনার প্রশাসনের মধ্যেও ঘাঁটি গেড়েছে। বঙ্গবন্ধু: আমি কি তা বুঝি না? সরকারি আমলা, পুলিশ- এমনকি সেনাবাহিনীর মধ্যেও এরা ঢুকে গেছে। তা না হলে দেশময় সন্ত্রাস চলছে, পুলিশ তাদের ধরতে পারে না? দুর্ভিক্ষে মৃতপ্রায় মানুষের জন্য বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে খাদ্য, বস্ত্র, ওষধ আনি, সেগুলো গরীব দুঃখীকে না দিয়ে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়?(পৃ ১৩১) এই পরিস্থিতি উত্তরণে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত জানান বঙ্গবন্ধু কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়ার আগেই তাঁকে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়। মূলত ১৭৫৭ সালের পলাশি চক্রান্তের খলনায়করাই ১৯৭৫ সালে পুনর্জন্ম গ্রহণ করে বাংলাদেশের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছিল তারই নাট্যরূপ দৃশ্যায়ন করেছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী তাঁর ‘পলাশি থেকে ধানমন্ডি’তে। বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাস্তব চরিত্রের মুখে যে সংলাপ নির্মাণ করেছেন তাতেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রয়েছে। এমনকি মোশতাক ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের কথায় তুলে ধরেছেন ইতিহাসের পারম্পর্যকে। তাহের ঠাকুরের দু’টি সংলাপ- ক) (আত্মগতভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে) ইতিহাসের কি বিচিত্র পুনরাবৃত্তি। ইতিহাসে পড়েছি, দু’শ বছর আগে এই আগামাসি লেনের একটি বাড়িতে গোপন বৈঠক সিরাজউদ্দৌল্লা বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। আজ সেই একই এলাকায় আমরা এক হয়েছি আরেক ষড়যন্ত্রের খেলায়।(পৃ ৩৫) খ) (আবার আত্মগতভাবে) ইতিহাস বলে, দু’শ বছর আগে লর্ড ক্লাইভ নারীবেশে পাল্কিতে চেপে মুর্শিদাবাদের মীর জাফরের গোপন বৈঠকে যেতেন। আজ আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বোস্টার এসেছেন আমাদের বৈঠকে একই নারী বেশে।(পৃ ৩৬) চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধুকে সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরার প্রয়াস একেবারে সাম্প্রতিক। যদিও মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে তাঁর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ‘পলাশি থেকে ধানমন্ডি’ মঞ্চ নাটকটি চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে। কাহিনী, সংলাপ ও পরিচালনা করেছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। পলাশির প্রান্তরে পরাজয়ের পর নবাব সিরাজদ্দৌলার নির্মম মৃত্যু হয়েছিল তাঁর স্বদেশীয় কিছু লোভী ও ষড়যন্ত্রকারী কাছের মানুষের দ্বারা। ইংরেজ ব্যবসায়ীদের মদদ তো ছিলই তার পিছনে। নবাবের মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসন নিয়ে শুরু হয় আরো অনেক ষড়যন্ত্র, হত্যা আর ক্যু। সিরাজের মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। চলচ্চিত্রকার বিষয়টিকে সেভাবেই উপস্থাপন করেছেন। ‘চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়েছে। যেখানে জাতির পিতার জীবনের প্রধান প্রধান ঘটনা ও কর্ম তুলে ধরা হয়েছে। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে সিদ্ধান্ত জানা যায় হলিউডে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইংরেজিতে চলচ্চিত্র নির্মিত হবে। ‘গান্ধী’ ছবির অনুরূপ একটি ছবি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে সাব-টাইটেলে বাংলাসহ হিন্দি, ফরাসি, স্প্যানিশ, রুশ, চীনা, কোরিয়ান, হিব্রু, আরবি থাকবে। বঙ্গবন্ধুর জীবন, রাজনীতি, হত্যাকা- ও বিচার সবই এখানে তুলে ধরা হবে। বিভিন্ন সূত্র থেকে চলচ্চিত্রের গল্প সংগ্রহ শেষ পর্যায়ে; ৭০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে নির্মাণাধীন চলচ্চিত্রটির। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এটির মূল উদ্যোক্তা। বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে শুরু হবে এর কাহিনী। আন্তর্জাতিক এই চলচ্চিত্রের নাম হবে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’(রাজনীতির কবি)। ৮০টির মতো চরিত্রের সমাবেশ ঘটবে এখানে। এ ছবি তথ্যবহুল এবং সামগ্রিক বিন্যাসে অনন্য হবে। ভারতের হায়দ্রাবাদে ইনডোর এবং গোপালগঞ্জে আউটডোর সুটিং হবে বলে জানা গেছে। পূর্বে আলোচিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মঞ্চ নাটক ও চলচ্চিত্রের মতো আরো কিছু মঞ্চ নাটকে বঙ্গবন্ধু উন্মোচিত হয়েছেন, যাত্রাতেও। তবে সংখ্যায় কম। সৈয়দ শামসুল হকের ‘গণনায়ক’(১৯৭৬) এর মধ্যে অন্যতম। এই নাটকে তিনি উইলিয়াম শেকসপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’-এর ট্রাজিক ঘটনার অন্তর্নিহিত সত্যের সংবাদ দেওয়ার জন্যই বঙ্গদেশীয় পটভূমি ব্যবহার করেছেন।৩৪ নাটকে রাষ্ট্রপতি ওসমানকে খুনের যে পরিপ্রেক্ষিত নির্মিত হয়েছে তা বঙ্গবন্ধুর ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মমতাজউদদীন আহমদের ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ (এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম) ১৯৭১ সালের রচনা এবং বঙ্গবন্ধুর কথা সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও সেই আন্দোলনের শিরায় আন্দোলিত। ৮. মুদ্রণ শিল্পের মধ্যে ডাকটিকেটে বঙ্গবন্ধু চিত্রিত হয়েছেন বহুবর্ণিলরূপে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর ব্রিটেনের সাবেক পোস্টমাস্টার জেনারেল ও মন্ত্রী জন স্টোনহাউজ সেখানে সফরকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ও অন্যান্য মন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় বাংলাদেশ সরকারের ডাকটিকেট প্রকাশের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়। ২৬ জুলাই ১৯৭১ কলকাতা ও লন্ডনের বাংলাদেশ মিশনের উদ্যোগে ডাকটিকেট প্রকাশের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেওয়া হয়। ২৯ জুলাই কলকাতা ও লন্ডন থেকে একসঙ্গে ৮টি ডাকটিকেট প্রকাশিত হয়। ১০ পয়সা থেকে শুরু করে ১০ রুপি মূল্যমানের টিকেট বাজারে ছাড়া হয়। ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রথম সিরিজের ৮টি ডাকটিকেটের মধ্যে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করা হয়। ডিজাইন করেন বিমান মল্লিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিসহ ৫টাকা মূল্যমানের ডাকটিকেটটি ছিল আকর্ষণীয়। টিকেটের ওপরের অংশে ‘বাংলা দেশ’ শব্দটি বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা ছিল। এ দুয়ের মাঝখানে ‘পোস্টেজ রেভিনিউ’ শব্দ এবং ডানে ৫রুপি অঙ্কিত। নিচের অংশে সোনালি জমিনের ওপর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধুর সাদা-কালো ছবি, ছবির বামদিকে সাদা কালিতে ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখা ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ পোস্টকার্ড ছাপানো হয়। মুদ্রিত হয় ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে। হালকা হলুদে সবুজ পোস্টকার্ডের আকার ছিল ৮৮x১৪০ এম. এম। একই সময় জাতির পিতার ছবিসহ বিমান ডাকের ২০, ৩০, ৭৫ ও ৯০ পয়সা মূল্যের ৪টি এ্যারোগ্রাম মুদ্রিত হয়। এগুলোর ডিজাইন করেন শিল্পী কাজী মুস্তাফা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে বিচিত্রভাবে। ১৯৯৬ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে প্রকাশ করা হয় ৪ টাকা মূল্যের বর্ণিল ডাকটিকেট। এটির মূল রঙ ছিল কালো এবং সবুজ সাদা। অলংকরণ করেন মো. মতিউর রহমান। ছাপা হয় দেশের গাজীপুরস্থ সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে। ১৯৯৭ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক দিবসটি উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দানরত অবস্থার ছবিসহ ৪ টাকা মূল্যের ডাকটিকেট বাজারে ছাড়া হয়। আনোয়ার হোসেনের ডিজাইন করা এতে মুজিবকোট পরিহিত এবং ডান হাত ওঠানো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দানের ছবি মুদ্রিত। এটির মাপ ছিল ৪৮x৩২ এম. এম। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে ৪টাকার ডাকটিকেট সাদা সবুজ ও লাল মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাস্যোজ্জ্বল অবয়ব দিয়ে মুদ্রিত হয়। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর তর্জনি উঁচানো লাল-সবুজের পতাকায় শোভিত প্রতিকৃতি নিয়ে ৪টাকা মূল্যের আরো একটি ডাকটিকেট প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধুর চেতনা তৃণমূলে এভাবে ছড়িয়ে যায়। ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবমুক্ত করেন স্মারক ডাকটিকেট। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ৩ টাকা মূল্যের একটি ডাকটিকেট প্রকাশিত হয় সে সময়। লাল-সবুজ ও গোলাপি রঙে আঁকা টিকেটে রয়েছে জাতির পিতার তর্জনি। প্রতিকৃতির পিছনে একাত্তরের মানচিত্রের দৃশ্যপট। এখানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দানরত ও কিছু মানুষের আবছা অবয়ব সমবেত জনতার অংশ হিসেবে চিত্রিত। [caption id="attachment_40599" align="aligncenter" width="708"]শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ-এর অাঁকা সেই মর্মান্তিক দৃশ্য শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ-এর অাঁকা সেই মর্মান্তিক দৃশ্য[/caption] ৯. এভাবে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিস্তৃত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে শিল্পের প্রতিটি মাধ্যমে আন্তরিকতা, সচেতনতা এবং নান্দনিকতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিল্পের মধ্য দিয়ে দেশ ও জনতার প্রতি এই মহামানবের অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ শিল্প-আস্বাদনকারীদেরও তৃপ্ত করেছে। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির দর্শন ছিল ভালোবাসা, মানবপ্রেম- ‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ জাতির পিতার এই ভাবনাকেই শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশিত হতে দেখেছি আমরা।
^উপরে যেতে ক্লিক করুন