বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০০৪ সালে যে ডব্লিউ সিরিজের ২৫০টি পাসপোর্ট খোয়া গেছে সেই সিরিজের খোয়া যাওয়া পাসপোর্টের একটি পাঠানো হয়েছে কানাডায় অবস্থানরত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী নূর চৌধুরীকে। শুধু তাই নয়, ২০০৪ সালে খোয়া যাওয়া ডব্লিউ সিরিজের ২৫০টি পাস পোর্টেরই একটি তাঁর নামে ইস্যু দেখানো হয়েছে ২০০২ সালে। ২০০৪ সালে যে পাসপোর্ট খোয়া গেছে তার ২ বছর আগে ২০০২ সালে সালে তাঁর কাছে পাঠানো হলো কিভাবে? ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে নুর চৌধরী কিভাবে হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্ট এর মাধ্যমে বাংলাদেশে এসে আবার ফেরত যায়। পত্রিকান্তরে জানা যায় শমসের মবিন চৌধরী পররাষ্ট সচিব থাকাকালীন সময়ে তার (১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এর পর নুর চৌধরী সহ আত্মস্বীকৃত খুনিদের ব্যাংকক যাবার ব্যবস্তা করেন শমসের মবিন চৌধরী ) মাধ্যমে নুর চৌধরী পাসপোর্ট পায় এবং দেশে এসে গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনায় শামিল হয়।
গ্রেনেড হামলার পর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি পাল্টা গুলিও চলেনি। শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে একজন পুলিশকে এগিয়ে আসতে অনুমতি দেয়া হয়নি। হামলাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার স্থান ছিল উন্মুক্ত ও পুলিশের প্রতিরোধহীন। হামলাকারীরা পালিয়ে যাওয়ার পর রক্তাক্ত রাজপথে পাঁচ শতাধিক গুরুতর আহত নেতাকর্মীর কান্না ও চিৎকারে ভারী হয়ে যায় পরিবেশ। ঠিক তখনই তাদের উপর নিক্ষেপ করা হয় পুলিশের টিয়ারশেল। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, সেদিন রেড ক্রিসেন্ট, ফায়ার সার্ভিস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, এ্যামবুলেন্স সবকিছু ছিল ঢাকার বাহিরে বা অপ্রত্যাশিত দূরত্বে। পুলিশের টিয়ারসেলে অনেকে আহত হয়, গ্রেনেড হামলায় আহত অনেকে আরো গুরুতর আহত হয়।
উল্লেখ্য, এ বর্বরোচিত হামলায় পুলিশ বা তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাদী হয়ে কোন মামলা করেনি। আলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল মতিঝিল থানায় মামলা করতে গেলে তা জিডি এন্ট্রি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অন্যদিকে, ঘটনার পর কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ভিডিও দেশের নিরাপত্তা ও স্পর্শকাতর উল্লেখ করে তদন্তের নামে জব্দ করে গোয়েন্দা সংস্থা। সকল এভিডেন্স নষ্ট করা হয়, কোন ডগস্কোয়াডও ব্যবহার হয়নি। সকল এভিডেন্স নষ্ট করার পর বিশ্ব জনমতের চাপে এফবিআই আনা হয় যাদের শুধুমাত্র পুলিশের দেয়া তথ্য সরবরাহ করা হয়। ড. কামাল হোসেনসহ গঠিত বিচার-বিভাগীয় তদন্ত কমিটি বিএনপি-জামায়াত-জেএমবি ও ফ্রিডম পার্টির সংশ্লিষ্টতার সূত্র উল্লেখ করে যে রিপোর্ট প্রদান করে তাকে অগ্রাহ্য করা হয়। পরবর্তিতে যুক্তরাষ্ট্র কঠোর নিন্দা ও সমালোচনা করে খালেদা জিয়াকে নতুনভাবে তদন্তের আহবান জানায়। বিএনপির ক্ষমতা ত্যাগের পর ২০০৪ এ দায়িত্বরত ডিজিএফআই -এর মহাপরিচালক বলেন, গ্রেনেড হামলা নিয়ে তদন্ত না করতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে নিষেধ করা হয়।
শুধু তাই নয়, বিচারপতি জয়নাল আবেদিনকে ( জয়নাল আবেদিন জাল সার্টিফিকেট মাধ্যমে বিএনপির প্রথম মেয়াদে চাকরি পায় এবং পরবর্তী কালে ধরা পড়লে চাকরি চলে যায়। বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ) আহবায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এ বলা হয় প্রতিবেশী রাষ্ট এই হামলা চালিয়েছে। রিপোর্ট এ সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হল " তৃতীয় গ্রেনেড ফুটার আগে দিতীয় গ্রেনেড ফুটেছিল " বলে উল্লেখ করা হয়।
২০০৫ সালের অক্টোবরে র্যা বের হাতে আটক মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু ও ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান সালা উদ্দিন টুকুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনকে ডিজিএফআইয়ের কার্যালয়ে আনা হয়। সেটি ছিল ২০০৬ সালের অক্টোবর। ডিজিএফআইয়ের সেফ হোমে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন এবং লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোর্য়াদার মাওলানা তাজউদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিছুক্ষণ পরই লে. কর্নেল ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের মোবাইলে ফোন আসে। ফোনে আলাপ শেষে তারা পরস্পর বলাবলি করেন, মাওলানা তাজউদ্দিনকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিয়েছেন। এর দুই দিন পর মাওলানা তাজউদ্দিনের ছবি দিয়ে ‘বাদল’ নামে একটি পাসপোর্ট ও বাংলাদেশ বিমানে করাচির টিকেট এবং বোর্ডিং কার্ড তার হাতে দেন লে. কর্নেল সাইফুল জেয়ারদার। সেই সঙ্গে লে. কমান্ডার মিজানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাজউদ্দিনকে বিমানে তুলে দেয়ার জন্য। পাটিয়ে দেয়া হয় কুলাঙ্গারদের দেশে (পাকিস্তান)।
নোয়াখালীর একটি গ্রাম থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে ধরে এনে সিআইডি সাজানো জবানবন্দি আদায় করে। জজ মিয়াকে দিয়ে বলানো সেই ‘আষাঢ়ে গল্প’টি ২০০৫ সালে থেকে আজ ও দেশের মানুষের কাছে " জজ মিয়া " নাটক হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় জজ মিয়াকে রাজ সাক্ষী করা হবে বলে জবান বন্দী নিতে চাইলে জজ মিয়া অস্বিকার করে। জজ মিয়াকে তার মা ও বোনকে ক্রস ফায়ারের ভয় দেখানো হয় এবং বলা হয় জবান বন্দী দিলে মা ও বোনকে দেখা শোনা করবে, বোনের বিয়ের তারা দিয়ে দেবে। সেই অনুযায়ী ৬ মাস পর্যন্ত খরচের জন্য টাকাও দেয়। জজ মিয়া বাধ্য হয় জবান বন্দী দিতে। ফৌজদারি কার্যবিধির বিধান ভেঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের রুমে ওইদিন মুন্সী আতিক সহ অন্যান্য সিআইডি অফিসারগণ উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনাকে ই-মেইলে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে, ২০০৫ সালের ২৫ আগস্ট শৈবাল সাহা পার্থ নামের এক যুবককে ধরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পার্থ যেহেতু ভারতে লেখাপড়া করেছেন, তাই তাঁকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার চর হিসেবে প্রমাণের জন্যও তখন অসামরিক একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হয়। হাইকোর্টের নির্দেশে জামিন পেয়ে সাত মাস পর কারাগার থেকে মুক্তি পান পার্থ। পার্থ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে টানা পাঁচ দিন চোখ বেঁধে ব্যাপক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ধানমন্ডি থানায় সোপর্দ করা হয়। জানা গেছে, ওই পাঁচ দিন পার্থ গোয়েন্দা সংস্থার হেফাজতে ছিলেন। ২১শে আগস্ট মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টায় ওই সংস্থার তখনকার শীর্ষ কর্তারাও জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সেফটি-পিনসহ ঘটনাস্থল থেকে দুটি এবং পার্শ্ববর্তী এক ভবনের টয়লেট থেকে একটি গ্রেনেড উদ্ধার হয়। এভিডেন্স হিসেবে না রেখে সেগুলো ব্লাস্ট করা হয়। আরজেস-৮৪ গ্রেনেড অস্ট্রিয়ার তৈরি, দক্ষিণ এশিয়ায় এর একমাত্র বৈধ আমদানি কারক দেশ পাকিস্তান। পাকিস্তানের সাথে সংশ্লিষ্টতা কাদের? পাকিস্তান আর্মির আমদানিকৃত গ্রেনেড কাদের সরবরাহ করা হয়?
যা হোক, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে ধানের শিষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনও করতে দেয়া হয়নি। নিজ এলাকা নেত্রকোনা-৪ এ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিশেবে কারাগার থেকে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বাবর বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯ ডিসেম্বর ২০০৯ পত্রিকায় খবর আসলো, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে গোয়েন্দাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ জবান বন্দী দিতে যাচ্ছেন বাবর। দেশবাসী অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো বাবরের জবানবন্দী জানার জন্য। কিন্তু ঘটলো এক আজব ঘটনা। যে বিএনপি বাবরকে নির্বাচনই করতে দেয়নি সেই বিএনপি সেদিনই (১৯ ডিসেম্বর ২০০৯) তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিলো! শুধু তাই নয়, জেলখানায় বাবরের কাছে তড়িঘড়ি করে পাঠানো হলো বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার সংক্রান্ত চিঠি। উল্লেখ্য, এরপর বাবর জবান বন্দী দেননি। জানতে ইচ্ছে করে কী এমন কথা বলতে যাচ্ছিলেন বাবর যে তার মুখ বন্ধ করার জন্য বিএনপিকে তড়িঘড়ি করে বহিষ্কারাদেশ তুলে নিতে হয়েছিলো?
অত্যন্ত ন্যাক্কারজনকভাবে তারা এ ঘটনাকে অন্তর্দলীয় কোন্দল বলে অপপ্রচারের চেষ্টা করেছিল।আওয়ামী লীগের কোন উপদল এত শক্তিশালী যে বিএনপি জোট সরকারের সকল প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করেছিল? চরম শত্রুরাও স্বীকার করবে আলীগে শেখ হাসিনার অবস্থান ইউনিক ও এবসল্যুট। সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর একটি দৃষ্টান্ত নেই যে তার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। ১/১১-এর সময়ও নয়। তিনি এইট পাশ খালেদা জিয়া নন যে মইন-ফখরুদ্দিনের ধমকে মান্নান-হাফিজরা খালেদার অপসারণ চাইবে আর তিনি দেশ ত্যাগে রাজি হবেন। কিংবা সাকা চৌধুরী ১০% বলে মা-ছেলের সমালোচনা করবে, মাহমুদুর রহমানরা ঠাট্টা তামাশা করবে। বরং এই হামলা জঙ্গী হুজি, তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতা ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার যোগসাজশে সংঘটিত হয়, যার মধ্যে ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ডিরেক্টোরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলিজেন্স (এন এস আই)ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর।
গ্রেনেড হামলার লোক-দেখানো তদন্ত ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের নাটক - অর্থাৎ এ হামলায় বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয় অনুধাবন করে ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ জানিয়ে ১৮ জন মার্কিন কংগ্রেসম্যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে চিঠি লেখেন। চিঠিতে হামলার এভিডেন্স নষ্টের অভিযোগ এনে তদন্তের সমালোচনা করে এবং দুই বছরে কার্যকর কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলা হয় - শেখ হাসিনাসহ আ.লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করাই সুপরিকল্পিত এ হামলার মূল লক্ষ্য ছিল। আরও বলা হয়, এ হামলায় জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতার সূত্র থাকলে ও এ বিষয়ে সরকার নীরব। " হামলাকারীরা ভারতে আছে তাই ধরা যাবে না " - লুৎফুজ্জামান বাবরের সাম্প্রতিক এই মন্তব্য দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক নয়। সবশেষে বলা হয়: যুক্তরাষ্ট্র আপনাকে কার্যকর তদন্ত পরিচালনায় আন্তরিকভাবে নতুন উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানাচ্ছে। ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয় দলের পক্ষ থেকে চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেনঃ Joseph Crowley, Charles Gonzalez, Alcee Hastings, Frank Pallone, Diane E. Watson, Eliot L. Engel, Robert Wexler, G.K.Butterfield, Corinne Brown, Janice D. Schakowsky, Michael Capuano, Barney Frank, Brian Higgins, Sherrod Brown, Debbie Wasserman Schultz, Kendrick B. Meek, Anthony D. Weiner এবং A.l. Green. বর্তমান সময়ে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের ব্যনারে তথাকথিত সুশীল ও বিএনপির নেতারা কি উপরোক্ত প্রধ্নগুলোর জবাব দিতে পারবেন?
লেখকঃ মোহাম্মদ হেলাল মিয়া, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য
সম্পাদনায়ঃ খোরশেদ আলম, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সমসাময়িক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক, উপ-সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রেস