বিজ্ঞানের কল্যাণে প্রতিদিন অনেক অসাধ্য সাধিত
হচ্ছে। প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকার পরিবর্তে আরামে ও আয়াসে কাটছে
মানুষের জীবন। কায়িক পরিশ্রমের স্থান দখল করছে মানুষ নির্মিত যন্ত্র। এরই
পরো ফল ডায়াবেটিস। আগের দিনে মানুষের কায়িক পরিশ্রম ছিল; সে জন্য
ডায়াবেটিসের কথা শুনা যায়নি। শুধু তাই নহে, বিশ্বের ক্রমবর্ধমান বিপুল
জনগোষ্ঠির খাদ্য চাহিদা মিটাতে ব্যবহৃত হচ্ছে রাসায়নিক ও জৈবিক প্রযুক্তি।
অনেক চিন্তাবিদ মানুষের ডায়াবেটিস সহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগ ব্যাধির সাথে এ
ধরনের প্রযুক্তির অপব্যবহার এর সম্পর্ক রয়েছে মর্মে চিন্তা শুরু করেছেন।
সুতরাং মানব সৃষ্ট প্রযু্ক্তির যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা অনেক বড় বড় রোগের কারণ নির্ণয়
করেছেন এবং তদানুসারে ঔষুধও আবিষ্কার করেছেন। ম্যালেরিয়া, কলেরা, গুটি
বসন্ত, যক্ষ্মা ইত্যাদি ভয়াবহ রোগগুলোর কারণ আবিষ্কৃত হওয়ায় এ অসুখগুলো
নিয়ে মানুষ আর চিন্তিত নয়। ‘হলে যক্ষ্মা, নাই রক্ষা' -এ প্রবচন আজ মানুষ
বিষ্মৃত প্রায়। কিন্তু প্রাণান্তকর চেষ্টা ও শত গবেষণা সত্বেও ডায়াবেটিসের
প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা বলছেন যে কোন
অজানা কারণে প্যানক্রিয়াসের বেটা সেল (ইবঃধ ঈবষষ) ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। এর ফলে
ইনসুলিন তৈরিতে প্যানক্রিয়াস সম্পূর্ণ অথবা আংশিক অম হয়ে পড়ে। ইনসুলিনের
অভাবের কারণে রক্তের গ্লুকোজ আমাদের শরীরের বিপাক ক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে
না। এর ফলে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
কাদের ডায়াবেটিস হতে পারে ?
কি কি অবস্থায় ডায়াবেটিস প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ?
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থেকে কি ধরনের বিপদ হতে পারে ?
কিভাবে বুঝবেন আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে ?
ডায়াবেটিস কি সারানো যায়?
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা :
ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ সারানো বা নিরাময় করা যায় না।
তবে এ রোগ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব এবং এই বিষয়ে ডাক্তার রোগীকে
সাহায্য করতে পারেন।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চারটি নিয়ম মানতে হয়ঃ
ক) নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ
খ) সাধ্যমত কায়িত পরিশ্রম ও ব্যায়াম
গ) ঔষধ
ঘ) শিক্ষা
প্রতিটি পর্যায়ে শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে।
ক) নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ -ডায়াবেটিস হলে
খাদ্যের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয়। খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা
ডায়াবেটিস হওয়ার আগে যে রকম থাকে পরেও একই থাকে। পুষ্টির চাহিদার কোন
তারতম্য হয় না। খাদ্যের নিয়ম মেনে চলার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে:ডায়াবেটিস
নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্বাস্থ্য ভাল রাখা। ডায়াবেটিস এর জন্য খাদ্যাভাসের
পরিবর্তন জরুরী যা বিশেষ ভাবে পালনীয়-
- ডায়াবেটিক রোগীদের খাদ্যাভাস এমনভাবে গড়ে তোলা দরকার যাতে শরীরের ওজন কাম্য সীমার উপরে বা নীচে না যায়।
- খাদ্য তালিকায় ভাত, রুটি ইত্যাদির পরিমান কমিয়ে পরিবর্তে শাকসব্জী বাড়িয়ে দিতে হবে; আঁশযুক্ত সাক শবজী প্রচুর পরিমানে খাওয়া যাবে।
- মিষ্টি জাতীয় খাবার (কেক, পেস্তি, জ্যাম, জেলি, মিষ্টি, ঘনীভূত দুধ, মিষ্টি বিস্কুট, সফট ড্রিক, চায়ে চিনি ইত্যাদি) খাওয়া যাবেনা।
- নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খেতে হবে। ঘি, মাখন, চর্বি, মাংস ইত্যাদি কম খেতে হবে।
- যথা সময়ে ঘুমাতে হবে এবং সকল ধরণের দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত থাকতে হবে।
- ধূমপান, মদ পান এবং হোটেলের খাবার পরিপূর্ণভাবে পরিহার করতে হবে।
খ) ব্যায়াম- রোগ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে
ব্যায়াম বা শরীর চর্চার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্যায়াম করলে শরীর
সুস্থ্য থাকে, ইনসুলিনের কার্যকারিতা ও নি:সরনের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রতিদিন
অন্তত: ৪৫ মিনিট হাঁটলে শরীর যথেষ্ঠ সুস্থ্য থাকবে। শারীরিক অসুবিধা থাকলে
সাধ্যমত কায়িক পরিশ্রম করতে হবে।
গ) ঔষধ- সকল ডায়াবেটিক রোগীকেই খাদ্য,
ব্যায়াম ও শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বয়স্ক রোগীদের
ক্ষেত্রে, এই দুইটি যথাযথভাবে পালন করতে পারলে রোগ নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু
টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ইনসুলিন ইনজেকশনের দরকার হয়। টাইপ-২
ডায়বেটিস রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসক শর্করা কমাবার জন্য খাবার বড়ি দিতে পারেন।
ঘ) শিক্ষা- ডায়াবেটিস আজীবনের রোগ। সঠিক
ব্যবস্থা নিলে এই রোগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ব্যবস্থাগুলি
রোগীকেই নিজ দায়িত্বে মেনে চলতে হবে এবং রোগীর পরিবারের নিকট সদস্যদের
সহযোগিতা এ ব্যাপারে অনেক সাহায্য করতে পারে। তাই এ রোগের সুচিকিৎসার জন্য
ডায়াবেটিস সর্ম্পকে রোগীর যেমন শিক্ষা প্রয়োজন, তেমনি রোগীর নিকট
আত্মীয়দেরও এই রোগ সর্ম্পকে কিছু জ্ঞান থাকা দরকার।
পথ্য ও বাড়তি সতর্কতা
- আঁশবহুল খাবার (ডাল, শাক, সবজি, টক ফল ইত্যাদি) বেশী খেতে হবে
- উদ্ভিদ তেল, অর্থাৎ সয়াবিন তেল, সরিষার তেল ইত্যাদি এবং সব ধরনের মাছ খাওয়া অভ্যাস করতে হবে
- ওজন স্বাভাবিক রাখতে হবে।
- চিনি-মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া বাদ দিতে হবে
- চাল, আটা দিয়ে তৈরী খাবার, মিষ্টি ফল ইত্যাদি কিছুটা হিসেব করে খেতে হবে।
- ঘি, মাখন, চর্বি, ডালডা, মাংস ইত্যাদি কম খেতে হবে।
- অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হলে অর্থাৎ অসুস্থ্য অবস্থায় বিশেষ খাদ্য-ব্যবস্থা জেনে নিতে হবে।
ডায়াবেটিস রোগের জরুরী অবস্থা
ক) রক্তে শকর্রার স্বল্পতা
(হাইপোগ্লাইসেমিয়া)-রক্তে শর্করার পরিমাণ কমানোর জন্য ট্যাবলেট বা ইনসুলিন
দেয়া হয়। ট্যাবলেট খাওয়ার বা ইনসুলিন নেয়ার ফলে যদি শর্করার পরিমাণ খুব কমে
তাহলে শরীরে প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
প্রতিক্রিয়ার লক্ষণগুলি নিম্নরূপ:
- অসুস্থ্য বোধ করা
- খুব বেশী খিদে পাওয়া
- বুক ধড়ফড় করা
- বেশী ঘাম হওয়া
- শরীর কাঁপতে থাকা
- শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা
- অস্বাভাবিক আচরণ করা
- অজ্ঞান হয়ে
- কেন এবং কখন এই সব লক্ষণ দেখা দেয়
- ঔষধের (ট্যাবলেট বা ইনসুলিন) পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় বেশী হলে
- ইনসুলিন ও সিরিঞ্জ একই মাপের না হলে
- বরাদ্দের চেয়ে খাবার খুব কম খেলে বা খেতে ভুলে গেলে
- ইনসুলিন নেয়ার পর খুব দেরী করে খাবার খেলে
- হঠাৎ বেশী ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রম করলে
- বমি বা পাতলা পায়খানার জন্য শর্করা অন্ত্রনালী হতে শোষণ না হলে
রক্তে শর্করার অভাব হলে কি করা উচিৎ
প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়া মাত্র রোগীকে চা-চামচের ৪
থেকে ৮ চামচ গ্লুকোজ বা চিনি এক গ্লাস পানিতে গুলে খাইয়ে দিতে হবে বা ।
রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে মুখে কিছু খাওয়ার চেষ্টা না করে গ্লুকোজ ইনজেকশন দিতে
হবে বা তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।