জীবন পাবেন আরো ছয়বার: বঙ্গবন্ধুকে কিসিঞ্জার


জীবন পাবেন আরো ছয়বার: বঙ্গবন্ধুকে কিসিঞ্জার১৯৭৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনের ওয়ালডর্ফ টাওয়ারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর হোটেল স্যুইটে এসে সাক্ষাৎ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। বঙ্গবন্ধু তখন প্রধানমন্ত্রী। সেই আলোচনায় ১৯৭০ সালের নির্বাচন, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, খনিজ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পর্কসহ অনেক বিষয় স্থান পায়।
বঙ্গবন্ধু জানান, তিনি পাকিস্তানে যেখানে বন্দি ছিলেন সেই স্থানটির অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। তাপমাত্রা ছিল ১১৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪৭ দশমিক ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। সে সময় পাশে থাকা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ছিলেন। সে কারণে তিনি কিছুটা শীতল আবহাওয়া পেয়েছিলেন।
এরপর বঙ্গবন্ধু কিসিঞ্জারকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল তা প্রহসনমূলক। কিসিঞ্জার জবাব দেন, তাঁকে মুক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ওপর অনেক চাপ সৃষ্টি করেছিল।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘হ্যাঁ। আমি জানি, আপনারা তা করেছিলেন। তারা আমাকে ১৬ ডিসেম্বর রাতে হত্যার চেষ্টা করেছিল। অফিসার-ইন-চার্জ আমাকে বাইরে নিয়ে যান এবং চশমা ব্যারেজের কাছে পাঁচ দিন লুকিয়ে রাখেন। তারা পরিকল্পনা করেছিল এই তথ্য প্রচারের জন্য যে- কারাবন্দিরা বিদ্রোহ করেছে এবং কারাবন্দিরাই আমাকে মেরে ফেলেছে। তারা (পাকিস্তান) আমাকে তিনবার হত্যার চেষ্টা করেছে। ১৯৫৮ সালে যখন মার্শাল ল এসেছিল তখন তারা আমাকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৬৬ সালে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তারা আমাকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৭১ সালে তারা আমাকে গ্রেপ্তার এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হত্যার চেষ্টা করে। আমি বর্ধিত জীবনে আছি।’ এর প্রতিক্রিয়ায় হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, ‘আপনি আরো ছয়বার বাঁচবেন। তাঁরা বলেন, বিড়ালের ৯টি জীবন আছে। তবে আপনার অর্জন বিশাল। আপনি একটি নতুন দেশ সৃষ্টি করেছেন।’
যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের ‘অফিস অব দ্য হিস্টোরিয়ান’-এ উন্মুক্ত কূটনৈতিক নথি থেকে জানা যায় এ দেশের সেই অতীত ইতিহাস।
হত্যা পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, উড়িয়ে দেন বঙ্গবন্ধু : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র সময় সকাল ৮টায় (বাংলাদেশ সময় ১৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টায়) হেনরি কিসিঞ্জার বৈঠক করেছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সেখানে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ তোলেন কিসিঞ্জার। যুক্তরাষ্ট্রের নিকট প্রাচ্যবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলফ্রেড এল আথারটন বলেন, সুপরিকল্পিত অভ্যুত্থান হয়েছে। কিসিঞ্জার জানতে চান, ‘এর অর্থ কী? মুজিবুর জীবিত না মৃত?’
আথারটন জবাব দেন, ‘মুজিবুর মৃত। তাঁর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন বিশেষ করে পরিবার, ভাগ্নে, ভাইও।’
এ পর্যায়ে কিসিঞ্জার বলেন, ‘আইএনআরের (ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ ব্যুরো) কাছ থেকে আমি ভালো পরামর্শ পেয়েছিলাম।
এরপর আইএনআর ব্যুরোর সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম জে হিল্যান্ড বলেন, ‘আমি আপনাকে যখন বলেছিলাম তখনো তিনি (মুজিব) নিহত হননি।’
কিসিঞ্জার জানতে চান, ‘সত্যিই? এর কিছু সময় পরই কি ওরা তাঁকে (মুজিব) হত্যা করেছিল?’
আথারটন জবাব দেন, ‘আপাতত এমনটি আমরা জানি। আমি বলব না যে আমরা সব তথ্য পেয়েছি। তবে ইঙ্গিত আছে যে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আর তারা সাধারণভাবে তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে, ভেতরে ঢোকে এবং তাঁকে হত্যা করে। আপাতত আমরা এটিই জানি।’
কিসিঞ্জার প্রশ্ন করেন, ‘আমরা কি গত বছর এটি তাঁকে (মুজিব) বলিনি?’
আথারটন উত্তর দেন, ‘মার্চে আমাদের কাছে অনেক ইঙ্গিত ছিল...।’
কিসিঞ্জার আবার জানতে চান, ‘আমরা কি তাঁকে এটি বলিনি?’
আথারটন বলেন, ‘আমরা তাঁকে সে সময় বলেছি।’
কিসিঞ্জার প্রশ্ন করেন, ‘কারা এটা ঘটাতে যাচ্ছে, আমরা কি তাঁকে মোটামুটি বলিনি?’
আথারটন বলেন, মুজিবকে নাম জানানো হয়েছিল কি না তা তাঁকে যাচাই করে দেখতে হবে।
হিল্যান্ড জানান, এ বিষয়ে তাঁদের কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। আথারটন বলেন, এ বিষয়ে জানানোর পর মুজিব হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে এ রকম কিছু কেউ করবে না।
এরপর কিসিঞ্জার মন্তব্য করেন, তিনি (মুজিব) বিশ্বের অন্যতম বোকা লোক ছিলেন।
ওই বৈঠকে অভ্যুত্থান ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতি ও তাদের পরিচয়, নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার সম্ভাবনা, ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়। আথারটন বলেছেন, ‘পাকিস্তানিরা গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের দিকে কিছু অগ্রগতি থাকতে পারে।’ এরপর কিসিঞ্জার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলার জন্য বৈঠকে উপস্থিত অন্যদের কাছে কিছু সময় চান।
অভ্যুত্থানের পরিণতি নিয়ে অনিশ্চিত দূতাবাস : ১৬ আগস্ট ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস অভ্যুত্থান-পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পরিস্থিতি তুলে ধরে। এতে বলা হয়, অভ্যুত্থান শুরু হয় ১৫ আগস্ট ভোর সোয়া ৫টায়। প্রথম ২৪ ঘণ্টার ঘটনাপ্রবাহ থেকে আশ্বাস মিলছে যে একে চ্যালেঞ্জ করা হবে না। শপথ নেওয়া নতুন সরকারের প্রতি সামরিক তিন বাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলস, রক্ষী বাহিনী, পুলিশপ্রধান অনুগত আছেন। দূতাবাসের বার্তায় বলা হয়, ‘মুজিবের পতনে জনগণ জয়ধ্বনি না দিলেও শান্তভাবে বিষয়টি গ্রহণ করেছে। আর সম্ভবত কিছুটা স্বস্তিও পেয়েছে।’
বার্তায় আরো বলা হয়, মুজিব ও বাঙালি পরস্পর থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। কারণ মুজিব তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। অভ্যুত্থান ত্বরান্বিত হওয়ার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে জুনের শুরুর দিক থেকে ক্ষমতার ওপর মুজিবের আধিপত্য ও তাঁর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে চিহ্নিত করা হয়।
ভারতের স্বাধীনতা দিবসকে (১৫ আগস্ট) মুজিব হত্যার জন্য বেছে নেওয়াকে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ‘কাকতালীয়’ বলে মন্তব্য করে। খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে নতুন সরকার পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে না বলেও দূতাবাস জানায়। মোশতাককে উদ্ধৃত করে তারবার্তায় বলা হয়, নতুন সরকার যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মতো দেশের সঙ্গে জোরালো ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে চায়। দূতাবাসের মন্তব্য ছিল, নতুন সরকারের এ উদ্যোগে বিদেশের সঙ্গে সম্পর্কে আরো ভারসাম্য আসবে এবং সোভিয়েতের প্রভাব কিছুটা কমবে।
অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের সম্পর্কে দূতাবাস ওয়াশিংটনকে জানায়, ‘অভ্যুত্থান পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে আমাদের বাঙালি গাদ্দাফি খোঁজার কোনো কারণ নেই। উপরন্তু তারা প্রবীণ, সেবাধর্মী ও মধ্যম শ্রেণির। তারা শেখ মুজিবের হুমকিতে পড়েছিল। পাকিস্তান আমল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে যে ধরনের বাহিনী দেখা গেছে, তার চেয়ে আরো উদার প্রমাণ হতে পারে এ বাহিনী।’
বার্তার শেষাংশে বলা হয়েছে, রক্তপাতের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে উৎখাত সফল হলেও অনেক কাজ বাকি। বাঙালি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এখন এমন কেউ নেই যিনি শেখ মুজিবের স্থানে দীর্ঘ মেয়াদে নেতৃত্ব দিতে পারেন। বেসামরিক সরকারের পতন ঘটলে দেশ বাঁচাতে সামরিক বাহিনীর উত্থান দেখা যেতে পারে।
^উপরে যেতে ক্লিক করুন