গর্ভবতী ও প্রসূতি মহিলাদের পুষ্টি
প্রাপ্ত বয়ষ্ক মহিলার অপুষ্টিতে ভোগার পরিণতি:
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়
- কর্মক্ষমতা কমে যায়
- শারীরিক গঠন ছোট হওয়ার কারণে সন্তান প্রসবে জটিলতা ও বিপদ দেখা দেয়
- প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী জটিলতা এবং রক্তক্ষরণের ফলে মায়ের মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়
- গর্ভবতী মহিলা অপুষ্টিতে ভুগলে কম ওজন নিয়ে সন্তান জন্মানোর এবং নবজাতকের মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়
গর্ভকালীন সেবা:
- গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন ৩ বেলা খাবারের সাথে নিয়মিত কমপক্ষে এক মুঠ বেশি খাবার খেতে হবে
- মাছ, মাংস, ডিম , দুধ, কলিজা, ঘন ডাল, গাঢ় সবুজ শাক-সব্জি ও মৌসুমী দেশী ফল খেতে হবে। রান্নায় যথেষ্ট পরিমান তেল ব্যবহার করতে হবে
- গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হবার সাথে সাথে প্রতিদিন রাতের খাবারের পরপরই ১টি করে আয়রণ ফলিক এসিড ট্যবলেট খেতে হবে
- গর্ভাবস্থায় ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার খেতে হবে
- গর্ভাবস্থায় ৩ মাসের পর থেকে প্রতিদিন (সকালে এবং দুপুরে) ২ টি করে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ভরা পেটে খেতে হবে
- গর্ভাবস্থায় যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্রাম (দুপুরে খাবারের পর ২ ঘন্টা এবং রাতে ৮ ঘন্টা) নিতে হবে
- গর্ভবতী মহিলাকে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তিতে রাখতে হবে, এতে গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক হবে
- ভারী কাজ (যেমন: টিউবওয়েল চাপা, ধান ভানা, ভারী জিনিষ তোলা, অতিরিক্ত/ভারী কাপড় ধোয়া) থেকে বিরত থাকতে হবে এবং কষ্টকর পরিশ্রম বর্জন করতে হবে
- আয়োডিন যুক্ত লবন খেতে হবে
- প্রথম ৩ মাসের পর প্রয়োজনে ১ টি কৃমিনাশক ট্যাবলেট খেতে হবে
- পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে
গর্ভকালীন যত্ন:
গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার গর্ভকালীন স্বাস্থ্য
পরীক্ষা করতে হবে (মায়ের ওজন, রক্তস্বল্পতা, রক্তচাপ, গর্ভে শিশুর অবস্থান
পরীক্ষা করা)
- ১ম স্বাস্থ্য পরীক্ষা = ১৬ সপ্তাহে (৪মাস)
- ২য় স্বাস্থ্য পরীক্ষা = ২৪-২৮ সপ্তাহে (৬-৭ মাস)
- ৩য় স্বাস্থ্য পরীক্ষা = ৩২ সপ্তাহে (৮মাস)
- ৪র্থ স্বাস্থ্য পরীক্ষা = ৩৬ সপ্তাহে (৯মাস)
- রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা
টিটেনাস টিকার ৫টি ডোজ সম্পন্ন করা (প্রথম টিকা
নেবার ২৮ দিন পরে দ্বিতীয় টিকা, ৬ মাস পরে তৃতীয় টিকা, ১ বছর পরে ৪র্থ
টিকা এবং তার ১ বছর পরে ৫ম টিকা)। টিটি টিকার কর্মসূচীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত
হলে ৫ টি টিকা সম্পন্ন করা উচিত। যদি ৫ টি টিকা নিয়ে থাকেন তাহলে আর নিতে
হবেনা। যদি সে ১ম ডোজ নেয়া থাকে তাকে ২য় ডোজ দিতে হবে, যদি ২য় ডোজ নেয়া
থাকে তাকে ৩য় ডোজ দিতে হবে (২য় ডোজ নেয়ার অন্তত ৬ মাস পর), যদি সে ৩য় ডোজ
নেয়া থাকে তাকে ৪র্থ ডোজ দিতে হবে (৩য় ডোজ নেয়ার কমপক্ষে ১ বছর পর), যদি সে
৪র্থ ডোজ নেয়া থাকে তাকে ৫ম ডোজ দিতে হবে (৪র্থ ডোজ নেয়ার কমপক্ষে ১ বছর
পর)
যদি আপনি কোন টিটি টিকা না দিয়ে থাকেন তাহলে টিকা
শুরু করতে হবে এবং গর্ভাবস্থায় ৫ মাস পর ২ টি টিটি টিকা নিতে হবে, সিডিউল
অনুযায়ী বাকি টিকাগুলো নিতে হবে।
দীর্ঘস্থায়ী ইমিউনিটির জন্য ৫ টি টিটি টিকার নির্ধারিত সময়সূচী:
১ম ডোজ (TT1): ১৫ বছর বয়সে অথবা প্রসব পূর্ববর্তী প্রথম ভিজিটে
২য় ডোজ (TT2): ১ম ডোজ নেয়ার অন্তত: ১ মাস (৪ সপ্তাহ) পর
৩য় ডোজ (TT3): ২য় ডোজ নেয়ার অন্তত: ৬ মাস পর
৪র্থ ডোজ (TT4): ৩য় ডোজ নেয়ার কমপক্ষে ১ বছর পর
৫ম ডোজ (TT5): ৪র্থ ডোজ নেয়ার কমপক্ষে ১ বছর পর
- ম্যালেরিয়া এবং ফাইলেরিয়া রোগ প্রতিরোধের জন্য মশারী (সম্ভব হলে ওষুধ যুক্ত) ব্যবহার করা
গর্ভকালীন সময়ে ওজন নেয়ার গুরুত্ব:
- গর্ভবতী মহিলার পুষ্টির অবস্থা নির্ণয় ও এ ব্যাপারে সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য
- গর্ভবতী মহিলার ওজন বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য
- একাট সুস্থ ও স্বাভাবিক ওজনের শিশুর জন্ম নিশ্চিত করার জন্য
- গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতা কমানোর জন্য
- মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর জন্য
গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি না হওয়ার কারণসমূহ:
- শিশু ও কিশোরী বয়সে দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টিতে এবং রক্তস্বল্পতায় ভোগা
- কিশোরী বা অল্প বয়সে গর্ভধারণ করা
- ঘন ঘন সন্তান ধারণ করা
- গর্ভাবস্থায় কম খাদ্য গ্রহণ ও সুষম খাদ্য গ্রহণ না করা
- গর্ভকালীন সময়ে রক্ত স্বল্পতায় ভোগা
- বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ও কৃমিতে আক্রান্ত হওয়া
- শারীরিক পরিশ্রম বেশি করা ও মানসিক উদ্বেগ থাকা
- খাদ্য সংক্রান্ত কুসংস্কার ও পরিবারে অসম খাদ্য বন্টন
প্রসূতীকালীন পরিচর্যা ও প্রসূতি মায়ের পুষ্টি:
প্রসবোত্তর সেবা নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের একটি
অপরিহার্য অংশ। প্রসবের পর থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়কে ”প্রসবোত্তর কাল”
বলা হয়। এ সময় মায়ের বিশেষ সেবা প্রয়োজন। কারণ এই সময় শিশুকে মায়ের দুধ
খাওয়ানোর জন্য মায়ের শরীরের ক্ষয় হয়। শিশুর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সকল
পুষ্টি উপাদান মায়ের দুধে বিদ্যমান; যা শিশু মায়ের কাছ থেকে পেয়ে থাকে।
এজন্য এ অবস্থায় মায়ের শরীর সুস্থ রাখার জন্য সব ধরনের পুষ্টি উপাদান
সমৃদ্ধ খাবার এবং বাড়তি যত্নের প্রয়োজন।
প্রসব পরবর্তী যত্ন:প্রত্যেক বার খাবারের সময় প্রসূতি মাকে স্বাভাবিকের তুলনায় কমপক্ষে ২ মুঠ বেশি পরিমানে খাবার খেতে হবে। অতিরিক্ত খাবার শিশুর জন্য মায়ের দুধ তৈরী করতে সহায়তা করে এবং মায়ের নিজের শরীরের ঘাটতি পূরণ করে
- দুগ্ধদানকারী মাকে সব ধরনের পুষ্টি সমৃদ্ধ (আয়রণ, ভিটামিন-এ, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি) খাবার খেতে হবে
- দুগ্ধদানকারী মায়ের কাজে পরিবারের সকল সদস্যদের সহযোগিতা করতে হবে
- গর্ভবতী ও প্রসূতি মহিলাদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে পরিবারের সবার (স্বামী, শাশুড়ী) করণীয়:
- গর্ভকালীন সেবা গ্রহনের জন্য গর্ভবতী মহিলার সাথে সেবা কেন্দ্রে যাওয়া এবং আয়রণ ফলিক এসিড খাওয়ার জন্য গর্ভবতী মহিলাকে মনে করিয়ে দেয়া
- গর্ভবতী মহিলা / দুগ্ধদানকারী মাকে অতিরিক্ত খাবার খেতে উৎসাহিত করা
- ঘরের দৈনন্দিন টুকিটাকি কাজে গর্ভবতী মহিলাকে সাহায্য করে তার কাজের বোঝা কমানো
- হাসপাতালে প্রসব করানোর বিষয়ে গর্ভবতী মহিলাকে উৎসাহিত করা এবং সহযোগীতা করা
- হাসপাতালে প্রসবের জন্য যাতায়াত ব্যবস্থার প্রস্তুতি নেয়া
- জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য গর্ভবতী মহিলাকে উৎসাহিত করা এবং সহযোগীতা করা
- জন্মের সাথে সাথে শিশুকে মায়ের শালদুধ খাওয়ানোর জন্য গর্ভবতী মহিলাকে উৎসাহিত করা এবং সহযোগীতা করা
- মা শিশুকে যথেষ্ট সময় নিয়ে দুধ খাওয়াত পারে তার জন্য দুগ্ধদানকারী মাকে সুযোগ করে দেয়া
একজন গর্ভবতী নারীর যে কোন সময় যে কোন বিপদ দেখা দিতে পারে। পরিবারের সবার গর্ভকালীন ৫ টি বিপদ চিহ্ন সম্পর্কে জেনে রাখতে হবে এবং যে কোন একটি দেখা দেয়া মাত্র তাকে স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
১. রক্ত ক্ষরণ
২. প্রচন্ড জ্বর
৩. তীব্র মাথা ব্যথা এবং চোখে ঝাপসা দেখা
৪. খিচুনী
৫. অনেকক্ষণ ধরে প্রসব বেদনা/ বিলম্বিত প্রসব (১২ ঘন্টার অধিক সময় ধরে থাকলে)
প্রসবকালীন বিপদ লক্ষন:
১. প্রসবের সময় মাথা ব্যতিত অন্য কোন অঙ্গ বের হয়ে আসা
২. বিলম্বিত প্রসব
৩. অতিরিক্ত রক্তক্ষন
৪. খিচুনী
৫. গর্ভফুল বের হতে বিলম্ব হওয়া
গর্ভবতী মহিলার খাদ্য তালিকা:
মায়ের দুধ খাওয়ানো ও শিশু পুষ্টি:
মায়ের দুধ শিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু জন্মের পর পরই শিশুকে শাল দুধ খাওয়ানো বিশেষ প্রয়োজন। শিশুকে ৬ মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের দুধ দিতে হবে এমনকি এক ফোটাঁ পানিও না।
শালদুধ:
শিশু জন্মের পর প্রথম ৩-৫ দিনের মধ্যে মায়ের স্তন থেকে হলুদ রঙের ঘন আঠালো যে দুধ বের হয় তাকে শালদুধ বলে। শালদুধে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ এবং অন্যান্য ভিটামিন থাকে যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শিশুর জন্মের পরপরই (১ ঘন্টার মধ্যে) শিশুকে শালদুধ খাওয়ানো বিশেষ প্রয়োজন।
মায়ের দুধের উপকারিতা:
মায়ের দুধের উপকারিতা অনেক। সেগুলো হচ্ছে
শিশুর উপকারিতা-
- শাল দুধ শিশুর জন্য অত্যন্ত পুষ্টিকর
- মায়ের দুধে এন্টিবডি থাকে যা শাল দুধে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। এই এন্টিবডি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শিশুর অসুখ কম হয় যেমন- ডায়রিয়া, কান পাকা, সর্দি-কাশি, চুলকানি, নিউমোনিয়া, সেপসিস ইত্যাদি হবার সম্ভাবনা কমে যায়, এছাড়াও এতে প্রচুর ভিটামিন-এ থাকে
- পরিমাণে কম হলেও এই শাল দুধ প্রথম তিন দিনের জন্য যথেষ্ট
- জন্মের পর পরই শিশুকে মায়ের বুকে দিলে সে দুধ চুষে খেতে শিখে এবং এতে মায়ের দুধও তাড়াতাড়ি নামে
- শাল দুধ শিশুর প্রথম কালো পায়খানা বের হতে সাহায্য করে
- শিশুর শরীরে যতটুকু পানির দরকার তা মায়ের দুধে বিদ্যমান
- শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ালে মা ও শিশুর বন্ধন দৃঢ় হয়
- মায়ের দুধ সবসময়ই নিরাপদ। এটি বাসি হওয়া বা সংক্রমিত হবার কোন সম্ভাবনা নাই। সবসময় সঠিক তাপমাত্রায় থাকে এবং এই দুধ তৈরী করার প্রয়োজন হয়না
- মায়ের দুধ শিশুর চোয়াল এবং দাঁত ও মাড়ি গঠনে সহায়তা করে
- মায়ের দুধ দেয়ার সময় মায়ের শরীরের সাথে লেগে থাকার কারণে শিশু মায়ের উষ্ণতা পায়, যা শিশুর জন্য খুব প্রয়োজন
- শিশুর অসুস্থতার সময় দিনে-রাতে ঘন ঘন মায়ের দুধ দিলে শিশু তাড়াতাড়ি অসুখ থেকে সেরে উঠবে এবং অপুষ্টি থেকে রক্ষা পাবে
জন্মের পর পরই শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ালে:-
- মায়ের জরায়ু দ্রুত সংকুচিত হয় এবং তাড়াতাড়ি আগের অবস্থায় ফিরে যায়
- গর্ভফুল তাড়াতাড়ি বের হয় এবং রক্তপাত কম হয় (সেজন্য সিজারিয়ান সেকশনের পরও শিশুকে দুধ দেয়ার জন্য মাকে সাহায্য করতে হবে)
- মায়ের দুধ বেশী বেশী করে তৈরী হয়
- মা মানসিক তৃপ্তি পান
- কৃত্রিম দুধ, দুধ তৈরির সরঞ্জামাদি ক্রয় এবং জ্বালানি-পানির খরচ বেঁচে যায়
- শিশু কম অসুস্থ হয় তাই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় ও খরচ বাঁচে
- পরিবারের অর্থ সাশ্রয় হবে এবং সর্বোপরি মায়ের তথা পরিবারের দুশ্চিন্তা কমে
জন্ম থেকে পূর্ণ ৬ মাস পযর্ন্ত কোন শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের দুধ দেয়া, বাইরের কোন খাবার বা এমন কি এক ফোঁটা পানিও না দেয়া, শিশুর পুষ্টি রক্ষার জন্য এসময় শুধুমাত্র মায়ের দুধই যথেষ্ট।
মায়ের দুধ দেয়ার সময় সঠিক পজিশন ও এ্যাটাচমেন্ট এবং মায়ের দুধ গেলে বের করা:
সঠিক পজিশন (অবস্থান) এর ৪টি মূল বার্তা:
শিশুকে সঠিকভাবে দুধ খাওয়ানোর জন্য, তাকে সঠিকভাবে মায়ের বুকে লাগাতে হবে, নাহলে শিশু ঠিকমত দুধ পাবে না, এজন্য যা করতে হবে-
- শিশুর মাথা ও শরীর একই লাইনে থাকবে
- শিশুর শরীর মায়ের সাথে নিবিড়ভাবে লাগানো থাকবে
- মা শিশুর সমস্ত শরীর ভালোভাবে ধরে থাকবে
- শিশু যখন স্তনের দিকে এগোবে তখন তার নাক বোঁটা বরাবর থাকবে।