- প্রকাশ করা হয়েছে মঙ্গলবার, 26 নভেম্বর 2013 11:05
বিশ্বের কোনো দেশে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিরবিচ্ছিন্ন এবং স্থিরভাবে চলে না। বাংলাদেশের অর্থনীতিও এর বাইরে নয়। দুইশ বছরের ইংরেজ শাসন ও সাতাশ বছরের পাকিস্তানি শোষণের জাঁতাকল থেকে তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। সদ্য স্বাধীন দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড শক্ত করতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা তখনো দেশের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আসীন ছিলো এবং নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে সচেষ্ট হয়েছিলো। স্বাধীনতা লাভের পাঁচ বছরের মাথায় দেশে সামরিক সরকারের উত্থান ঘটে এবং অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। স্বাধীনতার তিন যুগ পরে বঙ্গবন্ধুতনয়া, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা দেশের হাল ধরেন এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে উদ্যোগী হন।
২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকে এখন পর্যন্ত অর্থনীতিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের অর্জন অনেক। বিরোধীদলের ধ্বংসাত্মক কর্মসুচীর ফলে বিভিন্ন সময়ে দেশের অর্থনীতি সংকটের মুখে পড়েছিল। কিন্তু দক্ষ ও সুচিন্তিত পদক্ষেপ এবং সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনার বাস্তবায়নের ফলেই এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।
বর্তমানে দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০০৮ সালে ৬৩০ ডলার থেকে ১ হাজার ৪৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, ৫ কোটিরও বেশি মানুষ মধ্যবিত্তে উন্নীত হয়েছে এবং দারিদ্র্যের হার ২৬ শতাংশে নেমে এসেছে যেখানে ২০০৫ সালে ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। সাড়ে চার বছরে ২২ লক্ষ ৫০ হাজার ২০০ শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থান লাভ করেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৭ হাজার ৩০৪জন মহিলা শ্রমিককে বিদেশে কর্মসংস্থান করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আবার শ্রমিক রপ্তানি শুরু হবে। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ বছর ৯ মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৫৮৩৯৮.২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (সুত্রঃ বাংলাদেশ ব্যাংক) এবং রেমিট্যান্স অর্জনকারী দেশের মধ্যে বিশ্বে সপ্তম স্থান দখল করেছে। জনশক্তি রপ্তানির গন্তব্য দেশ ১০০ থেকে ১৫৫ তে উন্নীত হয়েছে।
পৃথিবীর যে কোন দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হলো রিজার্ভ।বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে ১ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের এই স্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর মধ্যে ভারত প্রথম ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে পাকিস্তান। এ পরিমাণ রিজার্ভ বাংলাদেশের সাড়ে পাঁচ মাসের আমদানি মূল্য পরিশোধের জন্য যথেষ্ট।বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা (৯ জানুয়ারি, ২০০৯) নেয়ার সময়ে ৫৩৫ কোটি ডলার রিজার্ভ নিয়ে যাত্রা করে। এর পর ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৭৪৭ কোটি ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে রিজার্ভ দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৭ কোটি ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ হাজার ৯১ কোটি,২০১১-১২ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৬ কোটি ডলার এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে রিজার্ভ গিয়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৩১ কোটি ডলারে।
২০১২-১৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ২ হাজার ৭০৩ কোটি ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এই আয় ছিল ১ হাজার ৪৮০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে ৭২৮ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতের ৭৬২ কোটি ৭৯ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। রাজস্ব আয় বেড়েছে দ্বিগুন, মূল্যস্ফীতি ১৩ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে।
৮লক্ষ ৭৮ হাজার ৪০১টি এসএমই উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে ১লক্ষ ৩৯হাজার ৫১৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ৫ হাজার ৯৭ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে ৩৯ হাজার ২১৩ নারী এসএমই উদ্যোক্তাকে।
সর্বস্তরের মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে নতুন তিনটি অনিবাসী বাংলাদেশী ব্যাংক ও ৬টি বানিজ্যিক ব্যাংককে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ৩৭ টি ব্যাংকে পুরোপুরি ও ৪টি ব্যাংকে আংশিক অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
গ্রামাঞ্চল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও দৈনন্দিন জীবনের সুবিধার্থে ১ হাজার ২১৮টি নতুন ব্যাংক শাখা খোলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
প্রথমবারের মতো সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
টানা কয়েক বছর কৃষিখাতে বাম্পার ফলন হওয়ায় কমছে আমদানি ব্যয়। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট ৩ হাজার ৩৯৬ কোটি ৯০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। আর ২০১১-১২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৩ হাজার ৫৫১ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের পণ্য।
পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির মুল চালিকাশক্তি। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগ অর্জিত হয় এই খাত থেকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে বর্তমানে দেশে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ পোশাক কারখানা চালু আছে যেখানে ৪০ লক্ষেরও বেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন যাদের ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক।
২০১২-১৩ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে ২১ হাজার ৫১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে বাংলাদেশ যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৭৯.৬৩ শতাংশ। ২০১৩ সালে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাসে ২৪ হাজার ৫২১ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে।
বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে বর্তমান মহাজোট সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ২০১০-২০২১’ গ্রহণ। দু’পর্যায়ে বিভক্ত এই পরিকল্পনার মুল লক্ষ্য দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী সুবিধাবঞ্চিত মানুষের হার ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। ২০১৭ সালের মধ্যে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশে উন্নীত করাও এই পরিকল্পনার অংশ। জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি করতে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। সরকারী তত্ত্বাবধানে, কম খরচে মালয়শিয়া, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানির প্রক্রিয়া চলছে। ১৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিদেশগামী নারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ০২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে।
আজ বিয়াল্লিশ বছর পরে বাংলাদেশ ২০০৭-১০ এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলা করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের কাছে নিজেকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ইকনমিস্ট বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে মন্তব্য করেছে, ‘আউট অফ দ্য বাস্কেট’(নভেম্বর ০৩, ২০১২)। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে উন্নয়ন অর্থনীতির একটি রহস্যময় ধাঁধা হিসাবে উল্লেখ করেছে সাপ্তাহিকটি। লন্ডনভিত্তিক লেগাটম ইন্সটিটিউটের প্রবৃদ্ধি সুচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও দ্রুতগতি সমৃদ্ধির কারণ হিসাবে যে সকল উপাদানের উল্লেখ করেছে তার মধ্যে রয়েছে পরিকল্পিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিতে বৈপ্লবিক সংস্কার ও সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষাখাতের অগ্রগতি, ভাষা ও সংস্কৃতিতে সহঅবস্থানিক উদারমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধর্মীয় সহনশীলতা তথা জঙ্গিবাদ নির্মূলের সাফল্য।