সাহসী ছাত্রজনতা সেদিন তৎকালীন জুলুমবাজ পাকিস্তান সরকারের সামরিক শক্তিকে উপেক্ষা করে প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় নেমে আসে বাংলাভাষাভাষীদের জন্য রাষ্ট্রভাষা বাংলা করা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। বিভিন্ন কারণেই ভাষা আন্দোলন কেবলই বাংলাভাষায় কথা বলবার অধিকার মাত্র ছিল না; এ ছিল আমাদের সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় রক্ষার তাগিদে পদযাত্রা। আর গত এক যুগ ধরে, সারা বিশ্বেই ‘অমর একুশে’র দিনটিকে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এ গৌরব আমাদের অস্তিত্বের আমাদের জাতিগত ঐক্যবদ্ধতার।
ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করে তাকে একটি গণ আন্দোলনে রূপ দিতে যে কতিপয় ছাত্রনেতা প্রধানতম ভূমিকা রেখেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তাদের অন্যতম। প্রবল গণ আন্দোলনের ফলেই তখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাংলাকে শেষ পর্যন্ত অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে এই ফুঁসে ওঠা জন অসন্তোষই স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। বঙ্গবন্ধুর যোগ্যতম নেতৃত্বে বাংলার মানুষ পাকিস্তানি প্রভুত্বের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করে।
ভাষার জন্য আন্দোলনের ইতিহাস
সেই ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়, যেখানে তৎকালীন ‘পূর্ব বাংলা’ (পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমানে বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যবর্তী দূরত্বের পরিমাণ ছিল হাজার মাইলের। দুই ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে তাই সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ব্যবধান ছিল খুব স্পষ্ট। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তান সরকার, যা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছিলো পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা, উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চালায়। বাঙালিদের কাছে যে উর্দুভাষা ছিল পুরোপুরি ভিনদেশি, তারা দেখলো এই ভাষা চাপিয়ে দেয়াটা তাদের ঔপনিবেশিকতা বাস্তবায়নেরই একটি কৌশল মাত্র।
.
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই পাকিস্তান সরকার সকল সরকারি ডাকটিকেট, মুদ্রা এবং দাপ্তরিক ফরমে বাংলা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত রাখে।১৯৪৭ সালের অক্টোবরে, ঢাকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবার দাবীতে ‘স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকশন কমিটি’ গঠিত হয়। ডিসেম্বর ৫, ১৯৪৭, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নেয়।
ফেব্রুয়ারি ২৫, ১৯৪৮, পূর্ব বাংলার সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তানের সাংবিধানিক সংসদে উর্দু ও ইংরেজির পাশে বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়।
একদিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা তাদের ডাকা অবরোধ পালনের জন্য ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে। পরে বিকেলে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়, তারপর সবাই বিশাল এক মিছিলে অংশ নেয় সকলে। সভায় নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক আবুল কাশেম আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন।
ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত সেই সভায় অংশগ্রহণকৃত ছাত্রনেতাদের মাঝে বঙ্গবন্ধুও ছিলেন অন্যতম যেখানে আন্দোলনকে বৃহত্তর রূপ দেবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সরকার কর্তৃক বাংলাভাষার বিরুদ্ধে অপতৎপরতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ আন্দোলনের লক্ষ্যে সর্ব দলীয় কমিটি গঠন করা হয়।
এরপরে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আহবায়িত হরতাল। আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশ এসময় শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও অলি আহাদসহ বেশ কিছু ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে।
ছাত্রনেতাদের গ্রেফতারের ঘটনায় আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে ওঠে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভসহ সভা অনুষ্ঠিত হয় আর সরকারকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয় ছাত্রনেতাদের গ্রেফতারে আন্দোলন কিছুতেই দমে যাবে না।
ফলস্বরূপ, সরকার সকল ছাত্রনেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি করে ১৬ই মার্চ, ১৯৪৮ ছাত্রদের একটি বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাজউদ্দীন আহমেদের ডাইরি থেকে, যিনি নিজেও ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন, “সভার পরে ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ মিছিল খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে যায় যেখানে তাদের দাবী নিয়ে প্রতিনিধিগণ অংশ নিয়েছিলেন, এর নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”।
মার্চ ২১, ১৯৪৮, পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকায় তার অনড় সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে কেবলই উর্দু, উর্দু ছাড়া অন্য কোনো ভাষা নয়’।
সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ জনতা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যায়।
জানুয়ারি ২৬, ১৯৫২, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণার সাথে সাথে ঢাকায় বিক্ষোভের ঢল নামে যা পরে ‘সর্ব দলীয় রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন কমিটি’র রূপ পায়। আর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন জনতার সাগরে রূপ নেয়, বিশেষ করে তরুণ ছাত্র জনতা যারা তাদের দাবী জানাতে উন্মুখ হয়েছিলেন। এর আগেরদিনই সেখানে ১৪৪ ধারা জারি হয়, যেখানে ঢাকা নগরে কোনো জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়, যদিও ছাত্রদের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার উস্কানি বা দাঙ্গার আভাস ছিল না।
সেদিন সকালে, জনতার ঢল ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, কেবল সংখ্যায় নয় তাদের তেজদীপ্ত ভাবমূর্তীতে স্পষ্ট জানিয়ে দিতে থাকেন একটি বড় বিক্ষোভে তারা অংশ নেবেন। সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গাজীউল হকের নেতৃত্বে জরুরি অবস্থায় করণীয় বিষয়ে ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেয়।
পরে, ছাত্ররা দশটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে, পুলিশের প্রতিরোধ ভেঙ্গে প্রাদেশিক আইনসভার উদ্দেশ্যে পদযাত্রার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু মিছিল শুরু হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মিছিলে অংশগ্রহনকারী ছাত্রদের উপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ কিন্তু থামাতে পারেনি মাতৃভাষার জন্য স্লোগান। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগানের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। শুরু হয় সাধারণ মানুষের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ। দুপুর তিনটার দিকে শুরু হয় গোলাগুলি। শাসকগোষ্ঠীর পেটুয়াবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র আবুল বরকত, গফরগাঁও থেকে ঢাকায় আত্মীয়কে দেখতে আসা আব্দুল জব্বার, মানিকগঞ্জের কলেজছাত্র রফিকউদ্দিন আহমেদ ও কোন এক অফিসের পিয়ন আব্দুস সালাম। ২১শে ফেব্রুয়ারির কিছুদিন পরে আহতাবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন সালাম। নিহতদের লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেনি শাসকগোষ্ঠী, বরং পরদিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি, রাতের অন্ধকারে অজ্ঞাতস্থানে পুঁতে ফেলে। আর এই ২১শে ফেব্রুয়ারির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ১৯৬৯ সালে আমরা স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি এবং ১৯৭১ সালে বহুল প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই ত্যাগেরই স্বীকৃতিস্বরূপ, এক যুগেরও বেশি সময় আগে, ইউনেস্কো সাধারণ সম্মেলনের ৩০তম সভাইয় সদস্যদেশগুলো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।