একাত্তরের রাজপুত্রেরা…



…আমি ছেলেটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। সদ্য তরুণ। কলেজে পড়ে। হাতের একনলা বন্দুকটির নল মরচেধরা। বুকে আড়াআড়ি বাধা ছেড়া চামড়ার স্ট্রিপ তাতে কিছু আদ্যিকালের কার্টিজ, ফুটবে কিনা সন্দেহ!ছেলেটা যুদ্ধ করতে এসেছে। বললাম, তুমি এই বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করবে! পাকিস্তানীদের মারবে!ছেলেটা আমার চেয়ে অবাক মুখভঙ্গী করে বললো, ক্যানো স্যার, এই বন্দুক দিয়ে আমার দাদা যদি বাঘ শিকার করতে পারেন, আমি মানুষ মারতে পারবো না! (এক মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা)…

ঘটনাটা বললাম সে সময়কার তরুণদের মনোভাবটা বোঝাতে। আজ ফেসবুকে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের ক্যাজুয়ালটির একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিলাম। আর সেই সংখ্যাটা দেখে অনেকে হয়তো বিস্মিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে এত বিশাল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার হাতে যদি মাত্র হাজার চারেক পাকিস্তানী নিহত হয় তাহলে কি যুদ্ধ করেছেন তারা! এই বিস্ময় আসলে এসেছে কনভেনশনাল বা প্রথাগত যুদ্ধ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে যেখানে শুধু স্থলেই না, আকাশ জল এমনকি অন্তরীক্ষেও (স্যাটেলাইট) লড়াই চলে। একদল প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী যেখানে অবস্থান নেয় সেটার সুরক্ষা তারা নিশ্চিত করে দূর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে। থ্রি নট থ্রি নিয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধার কোনো পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ করার কল্পনা খুব একটা বাস্তবসম্মত না। যেখানে তাদের কারও ছোড়া প্রথম গুলিটাই প্রতিপক্ষকে অবস্থান জানিয়ে দেবে এবং নিরাপদ বলয়ে বসে তার দিকে ছোড়া হবে অজস্র তপ্তসীসা। এধরণের আক্রমণে এয়ারসাপোর্ট ও আর্টিলারি ব্যাকাপের পাশাপাশি ভারী অস্ত্র থাকা খুব জরুরী। আফসোস বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সেই বিলাসিতার সুযোগ ছিলো না। প্রতিটি গুলি তারা হিসেব করে খরচ করেছেন, করতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ সেটা প্রতিপক্ষের মৃত্যুই শুধু নয় তার নিজের জীবনেরও রক্ষাকবচ। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কোনো অবাস্তব মিথ তৈরির অপচেষ্টা না করে বরং জানা যাক তাদের সম্পর্কে জানা অজানা কিছু তথ্য।
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানী একবার কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো গণহত্যায় নামা। তারা যদি রাজনৈতিক নেতা বা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেই তাদের অভিযান সীমাবদ্ধ রাখতো তাহলে হয়তো সেনাবাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনীর বাঙালী অফিসার ও সৈন্যরা চুপ থাকতেন। কিন্তু সাধারণ বাঙালীদেরও যখন রেহাই দেওয়া হলো না, শিক্ষক বুদ্ধিজীবিদেরও যখন হত্যা করা হলো, তখন সব শ্রেণীর মানুষই যুদ্ধে নেমে গেলো।’ বাস্তবতা হচ্ছে পাকিস্তানীদের পরিকল্পনাই ছিলো তা। নির্মম গনহত্যার মাধ্যমে বাঙালীদের স্বাধীনতার স্বপ্ন ভুলিয়ে দেওয়া। সেই হত্যার প্রতিরোধ,প্রতিশোধই মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে আগুন ধরিয়ে তাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে সামিল করেছে। ওসমানীর ভাষায়, ‘পাকিস্তানীরাই প্রতিদিন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করছিলো।’
2মুক্তিযুদ্ধের একদম বেসিক ছবিটা তার আগে তুলে ধরা দরকার।মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানের নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই বাংলাদেশ সরকার ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগরে আত্মপ্রকাশ করে। এবং সেই সরকার ১০ এপ্রিল প্রকাশিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে জানান দেয় ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন এবং এই সরকার কার্যকর। এই সরকার কোনো সামরিক সরকার নয়, বরং গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার। এই সরকারের নেতৃত্বে এবং তত্বাবধানে ও নির্দেশনাতেই সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী, পুলিশ, আনসার এবং গণবাহিনীর সদস্যরা সম্মিলিত রূপে মুক্তিবাহিনী হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। সারা বিশ্বজুড়ে এই সরকারই স্বীকৃতি পেয়েছে। এবং পাকিস্তানী কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু এই সরকারের কাঠামোতেই রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
তবে যতো উদ্দীপনা থাক, দেশপ্রেম থাক এবং প্রতিশোধের আগুন যতোই দাউদাউ জ্বলুক বন্দুক চালাতে না জানলে বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করা যায় না। ঠিক মতো বন্দুক ধরে তাদিয়ে গুলি ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করার মিনিমাম প্রশিক্ষণটা জরুরী। হাজার হাজার যুবক প্রতিদিন সীমান্ত পারি দিয়ে ভারতে যাচ্ছিলো সেই প্রশিক্ষণ নিতেই। আর তাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলো ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে বিএসএফই প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য ব্যাপারে সহায়তা দিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী নয়। মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন ৩০ এপ্রিল ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। অন্যদিকে এক সাক্ষাতকারে লে. জেনারেল বি.এন. সরকার জানিয়েছেন ৯ মে ভারতীয় সেনাপ্রধান তাকে ডেকে বলেন যে ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তাদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্রিগেডিয়ার, লে.কর্ণেল এবং মেজর পর্যায়ের কিছু অফিসারকে জরুরী ভিত্তিতে পূর্বফ্রন্টে নিয়ে আসতে হবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড জিওসি-ইন-সির অধীনে আগস্টের শুরুতে মুক্তিবাহিনীর অপারেশনাল ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। তার আগে এই দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল ও. এস কালকাট।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর আমাদের নির্ভরতা ছিলো। কিন্তু তার মানে এই না আমাদের ছেলেরা দলে দলে গিয়ে বলেছে আমাদের বাচাও, পাকিস্তানীরা আমাদের মেরে ফেলছে। বরং তারা গিয়ে বলেছে আমাদের তোমরা অস্ত্র দাও। আমরা আমাদের দেশটাকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত করতে চাই। ভারতীয়রা তাদের অস্ত্র দিয়েছে, কিভাবে সেই অস্ত্র চালাতে হয় শিখিয়ে দিয়েছে। আর শিখিয়েছে যুদ্ধের কিছু বেসিক যা না জানলেই নয়। লি এনফিল্ড, মার্ক থ্রি রাইফেল, ব্রিটিশ কারবাইন আর এলএমজি ও কিছু গ্রেনেড নিয়েই দেশ মুক্তিতে নেমে গিয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধারা।
তারপরও এই যুদ্ধে তুলনামূলক গুরুত্ব ছিলো নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের। কারণ তারা ছিলেন প্রশিক্ষিত। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেকের। এদের মধ্যে সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে ৪ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের একটা রূপরেখা তৈরি করতে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে এক বৈঠক করেন ওসমানী। জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, শফিউল্লাহসহ ছোটবড় ২৭জন অফিসার ছিলেন। সেখানেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়, যার মধ্যে প্রধান ছিলো:
১. বিশাল একটি গেরিলা যোদ্ধাদল তৈরি করে অন্তর্ঘাত চালাতে হবে যাদের কাজ পাকিস্তানীদের দালালদের হত্যা করা, বিভিন্ন স্থাপনা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করার মাধ্যমে পাকিস্তানীদের চলাফেরায় অচলাবস্থা তৈরি করা। হিট অ্যান্ড রান টেকনিকের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানীদের বিভিন্ন পোস্ট এবং গাড়ি বহরে হামলা চালাবে। এবং এর মাধ্যমে পাকিস্তানীরা সবসময় স্নায়ুচাপে ভুগবে।
২.অস্ত্র চালাতে সক্ষম আধাসামরিক বাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন সেক্টরে সেক্টরফোর্স সদস্য হিসেবে সন্নিবেশিত করা হবে এবং তারা এই গেরিলাদের সশস্ত্র সহায়তা দিবে।
৩.নিয়মিত বাহিনী ও গেরিলাদের মধ্য থেকে যোগ্যদের বাছাই করে এবং তাদের প্রশিক্ষন দিয়ে সামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে যারা পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে যাবে।মানে মুখোমুখি লড়াইয়ে নামবে।
১১ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন কমান্ডারদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসে। সেই সম্মেলনে যেসব বিষয় নির্ধারিত হয় তার মধ্যে প্রাসঙ্গিকগুলো ছিলো:
১.বাংলাদেশকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে যুদ্ধ পরিচালিত হবে।
২.গেরিলা যুদ্ধকে সমন্বিত করতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়:
ক. নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে প্রশিক্ষিত গেরিলাদের ৫ কিংবা ১০ জনের দলে ভাগ করে দেশের ভেতরে পাঠানো হবে
খ.গেরিলাদের দুই ভাগে ভাগ করা হবে
এক. অ্যাকশন গ্রুপ : যারা শত্রুদের উপর আক্রমন করবে এবং তাদের পঞ্চাশ থেকে শতভাগ সশস্ত্র হবে
দুই.ইনটেলিজেন্স গ্রুপ : যারা সংঘাত এড়িয়ে শত্রুদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করবে এবং সেসব তথ্য মিত্রদের কাছে সরবরাহ করবে। এদের তিরিশভাগকে সশস্ত্র করা হবে।
তিন. গেরিলা বেজ: স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার তত্বাবধানে কয়েকটি সেফ হাউজ চিহ্নিত করে তা গেরিলাদের আবাসন ও আশ্রয়ের জন্য ব্যবহার করা হবে যেখানে মেডিকেল সুবিধা থাকবে।
৩, নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ব্যাটেলিয়ান গড়ে তোলা হবে এবং আধাসামরিক ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গড়া হবে সেক্টর ফোর্স যার অপর নাম মুক্তি ফৌজ।
৪. সামরিক কর্মকান্ডের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়:
ক. গেরিলাদের একটি বিশাল বাহিনীকে দেশের ভেতর পাঠিয়ে শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে হবে। তাদের উপর নিয়মিত অ্যামবুশ ও চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে হবে।
খ. কোনো কলকারখানা চালাতে দেওয়া হবে না। বিদ্যুতের খুটি ও পাওয়ার স্টেশনগুলোতে বোমা হামলা চালিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা বিঘ্নিত করা হবে।
গ.প্রতিটি গুদামে হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দিতে হবে যাতে পাকিস্তানীরা কোনো পন্য রপ্তানী করতে না পারে।
ঘ. পাকিস্তানী সেনাদের ও তাদের রসদ বহনে ব্যবহার্য যানবাহন, নৌযান, রেলগাড়ি ধ্বংস করে দিতে হবে।
ঙ, যুদ্ধপরিকল্পনা এমন ভাবে করতে হবে যাতে শত্রু ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
চ. তাদের বিচ্ছিন্ন করার পর গেরিলা দলগুলো তাদের উপর মারণঘাতি হামলা চালাবে।
জুলাইয়ের সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার দেশের রণাঙ্গণকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে। এগুলো হচ্ছে:
১ নং সেক্টর:চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালির কিছুটা (মুহুরি নদীর পূর্বতীর)নিয়ে গঠিত এই সেক্টর বিভক্ত ছিলো ৫টি সাব-সেক্টরে। প্রায় ২১০০ জনের সেক্টর ফোর্সে দেড় হাজার ছিলেন ইপিআর বাহিনীর সদস্য, ২০০ পুলিশ এবং ৩০০ সেনাসদস্য আর বাকিরা নৌ ও বিমান বাহিনীর। এর বাইরে ২০ হাজারের বেশী বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন যাদের মাত্র ৩৫ ভাগ সশস্ত্র ছিলেন। মেজর জিয়াউর রহমান এই সেক্টরের প্রথম অধিনায়ক, পরে তার জায়গা নেন মেজর রফিকুল ইসলাম।
২ নং সেক্টর:কুমিল্লা, ফরিদপুর, নোয়াখালির কিয়দাংশ ও ঢাকা নিয়ে গঠিত এই সেক্টর বিভক্ত ছিলো আরও ৬টি সাবসেক্টরে। ৪ হাজার সেক্টর সেনা এবং ৩০ হাজার গেরিলার এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর খালেদ মোশররফ, পরে নেতৃত্ব দেন মেজর হায়দার।
৩ নং সেক্টর:মৌলভীবাজার ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কিছু অংশ নারায়ণগঞ্জ এবং কেরানিগঞ্জের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত এই সেক্টরে ছিলো দশটি সাবসেক্টর এবং যোদ্ধা ছিলো প্রায় দশ হাজার। মেজর শফিউল্লার এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন পরে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর এস ফোর্সের নেতৃত্ব দেওয়া হলে শফিউল্লাহর জায়গা নেন মেজর নুরুজ্জামান।
৪ নং সেক্টর:উত্তরে সিলেট পুলিশ স্টেশন এবং দক্ষিণে হবিগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের মাঝামাঝি অবস্থিত এই সেক্টরের ছিলো ছয়টি সাবসেক্টর।৩ হাজার সেক্টর ট্রুপস আর ৮ হাজার গেরিলার যুদ্ধস্থল এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। এই সেক্টরের সদরদফতর প্রথমে রাণীগঞ্জে ছিলো, পরে তা মাসিমপুরে স্থানান্তরিত হয়।
৫ নং সেক্টর:সিলেটের উত্তরাঞ্চলে ছয়টি উপসেক্টর নিয়ে গঠিত এই সেক্টরে ছিলো ৮০০ সেক্টর ট্রুপস এবং ৭ হাজার গেরিলা। অধিনায়ক ছিলেন মীর শওকত আলী।
৬ নং সেক্টর: রংপুর দিনাজপুর জেলা নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন উইং কমান্ডার এমকে বাশার। ৫টি সাবসেক্টরে বিভক্ত এই সেক্টরে নিয়মিত বাহিনী ছিলো ১২০০ জনের এবং গেরিলা ছয় হাজার। পাটগ্রামের বুড়িমারি ছিলো এই সেক্টরের সদরদফতর।
৭ নং সেক্টর:রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া এবং দিনাজপুরের কিয়দাংশ নিয়ে গঠিত এই সেক্টর ভাগ ছিলো ৮টি উপসেক্টরে। নিয়মিত বাহিনীর দু হাজার এবং সমসংখ্যক গেরিলার নেতৃত্বে ছিলেন মেজর নাজমুল হক। এক গাড়ি দূর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর তার জায়গা নেন মেজর কাজী নুরুজ্জামান।
৮ নং সেক্টর:কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল পটুয়াখালি নিয়ে প্রাথমিকভাবে গঠিত এই সেক্টর থেকে পরে বরিশাল পটুয়াখালিকে আলাদা করে দেওয়া হয়। ৭টি উপসেক্টরে বিভক্ত এই সেক্টরের সদর ছিলো বেনাপোলে। ২ হাজার সেক্টরফোর্স এবং ৭ হাজার গেরিলার এই রণাঙ্গনে প্রথমে অধিনায়ক ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। ১৫ জুলাই মেজর এমএ মঞ্জুর এর দায়িত্ব নেন এবং ওসমান চৌধুরীকে সদর দফতরে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৯ নং সেক্টর:বরিশাল, পটুয়াখালি এবং ফরিদপুর-খুলনার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের অধীনে ছিলো এক ব্যাটেলিয়ান নিয়মিত সেনা এবং ১৫ হাজার গেরিলা। ৭ টি সাবসেক্টরে বিভক্ত ছিলো এটি যার নেতৃত্বে ছিলেন মেজর এমএ জলিল।
১০ নং সেক্টর:এই সেক্টরের কোনো সীমারেখা ছিলো না। পাকিস্তানী নৌযানগুলোর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত চালাতে নৌ কমান্ডোরা এই সেক্টরে অপারেশন চালাতেন। নির্দিষ্ট অপারেশনে ওই এলাকার নির্ধারিত সেক্টর কমান্ডারের অধীনস্থ হতেন তারা।
১১ নং সেক্টর: বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা জুড়ে বিস্তৃত এই সেক্টর ভাগ ছিলো ৮ ভাগে যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর আবু তাহের। তার অধীনে ছিলো ২০ হাজার গেরিলা। ১৫ নভেম্বর কামালপুরের যুদ্ধে তাহের আহত হলে স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ তার জায়গা নেন।
যেহেতু অস্ত্র ও রসদের জন্য ভারতীয় বাহিনীর উপর নির্ভরশীল ছিলো মুক্তিবাহিনী, তাই এটি সুচারুভাবে সারতে প্রতিটি সেক্টরে বাংলাদেশের পাশাপাশি একজন ভারতীয় সেক্টর কমান্ডারও ছিলেন যিনি মূলত বিএসএফের প্রতিনিধি। তার মাধ্যমেই ভারতীয় বাহিনীর কাছে সাপ্লাই, রেশন এবং অ্যামুনেশনের জন্য আবেদন করতেন বাংলাদেশী সেক্টর কমান্ডার। ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের কমান্ডের অধীনে ছিলো বাংলাদেশের এই ১১টি সেক্টর যা তারা ছয়জন ব্রিগেডিয়ারের অধীনে ভাগ করেছিলো ৬টি জ্যাকপট সেক্টরে। মুক্তিবাহিনীর এক বা একাধিক সেক্টরের প্রশাসনিক এবং অপারেশনের নিয়ন্ত্রণ ছিলো এই জ্যাকপট কমান্ডারদের হাতে। তবে প্রতিটি সেক্টরের যুদ্ধপরিকল্পনা ভারত এককভাবে নিতে পারতো না, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরের সঙ্গে আলোচনা করেই তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আসতে হতো যা বাস্তবায়ন করতেন সেক্টর কমান্ডাররা। আর সেটা তত্বাবধান করতেন জ্যাকপট সেক্টর কমান্ডাররা। ইংরেজি বর্ণমালার এ থেকে এফ পর্যন্ত নামাংকিত এইসব জ্যাকপট সেক্টর দেখতেন ভারতীয় বাহিনীর যেসব অফিসার, তাদের নাম উল্লেখ করছি:
১.ব্রিগেডিয়ার জে.সি যোশীর অধীনে ছিলো মুক্তিবাহিনীর ৬ নম্বর সেক্টর।
২. ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিং নিয়ন্ত্রণ করতেন ৭ নম্বর সেক্টরের যুদ্ধ।
৩.ব্রিগেডিয়ার এন.এ.সালিক ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরের দেখভাল করতেন।
৪.ব্রিগেডিয়ার শাবেগ সিংয়ের নিয়ন্ত্রণে ছিলো ১,২ ও ৩ নম্বর সেক্টর।
৫.ব্রিগেডিয়ার এম.বি.ওয়াড়কে দেখতেন ৪ নম্বর সেক্টর, তার ই সেক্টরকে ই-ওয়ান নামে বিভক্ত করে ৫ নম্বর সেক্টর দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো লে.কর্নেল ভিএন রাওকে এবং পরে সে দায়িত্ব পালন করেন ব্রিগেডিয়ার কে লাখপত সিং।
৬.ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিংয়ের অধীনে ছিলো ১১ নম্বর সেক্টর।
২৫টি যুব ক্যাম্পের মাধ্যমে আগ্রহীদের মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করা হতো। ১হাজার তরুণ যুবকের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এসব ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলো ভারতীয় পুনর্বাসন মন্ত্রনালয়। এদের মধ্য থেকে রাজনৈতিক আনুগত্য যাচাই বাছাই করে তারপর তাদের নেওয়া হতো। প্রচুর পরিশ্রম, মানসিক বিপর্যস্ততা, পারিবারিক সমস্যার কারণে কিছু ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষন ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনা আছে। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে শরণার্থী শিবিরের সক্ষম তরুণ যুবকদের যুদ্ধে অনাগ্রহ। লাখখানেক মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে শরণার্থী শিবির থেকে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার শতকরা হারটি লজ্জাজনকভাবে এক ভাগেরও কম। আবার দেশ থেকে অনেক দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ক্যাম্পে এসেও প্রশিক্ষণের জন্য সুযোগ পাচ্ছিলেন না অনেক বাঙালী তরুন। আগরতলা ক্যাম্পে এমন একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে তিন হাজার তরুণ সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য দুমাস ধরে অপেক্ষায় ছিলেন মানবেতর পরিবেশে।
আরেকটি সমস্যা ছিলো ছাত্রদের মধ্যে। রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন এসব ছাত্রের অনেকে মাও সেতুং কিংবা চে গুয়েভারা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকলেও বাস্তবতা তাদেরকে নাড়া দিয়ে যায়। একেকজনের রাজনৈতিক আনুগত্যের বিভিন্নতাও সমস্যা সৃষ্টি করে যখন একজন আরেকজনের নেতৃত্ব মানতে অস্বীকৃতি জানায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের কঠোর হস্তক্ষেপে অবশ্য এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। সে তুলনায় চাষাভুষা গ্রামের সাধারণ ছেলেরা অনেক বেশী ঝামেলাহীন। তারা রাজনীতি নিয়ে ঝগড়া করেনি, জাঙ্গলবুটের জন্য ঝগড়া করেনি। ছেড়া গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি মালকোচা মেরে জয় বাংলা বলে যুদ্ধ করে গেছে।
প্রাথমিকভাবে ভারত ছয়টি প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করে ছয় জ্যাকপট কমান্ডারের তত্বাবধানে। এগুলো ছিলো মুরতি (পশ্চিমবঙ্গ), রায়গঞ্জ(পশ্চিমবঙ্গ), চাকুল্য(বিহার) ,দেওটামুরা (ত্রিপুরা), মাসিমপুর (আসাম), তুরা (মেঘালয়)। এসব ক্যাম্প থেকে প্রতিমাসে ১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হতেন। পাশাপাশি ই-ওয়ান সেক্টরের অধীনে ছিলো ঝারিনপুর (মেঘালয়) যেখান থেকে বের হতেন ৫০০ জন। প্রতি ১০০জন প্রশিক্ষনার্থীর জন্য ছিলেন একজন অফিসার, ২জন জেসিও এবং ৫ জন ননকমিশনড অফিসার। চার সপ্তাহের এই প্রশিক্ষণে অস্ত্র চালনার পাশাপাশি, রেকি, এমবুশ, বুবি ট্র্যাপ এবং রেডিও সিগনাল পাঠানো শেখানো হতো। আগস্ট মাসে এই প্রশিক্ষণের সময়সীমা কমিয়ে তিন সপ্তাহ করা হয়।
নভেম্বরের শেষ দিকে যখন বাংলাদেশ ভারত যৌথ বাহিনী গঠন করা হচ্ছে তখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা প্রায় ৮৩ হাজার আর তাদের মধ্যে ৫১ হাজারই দেশের ভেতরে যুদ্ধ করছেন। একশো থেকে দেড়শো জন নিয়ে গঠিত হতো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ। তাদের বিশজনের স্কোয়াড এবং দশজনের টিমে বিন্যস্ত করা হতো। প্রতি টিমে থাকতো চারটি থ্রিনটথ্রি রাইফেল, দুটো এসএলআর, তিনটি স্টেনগান এবং একটি এলএমজি। প্রতি মুক্তিযোদ্ধা মাথা পিছু দুটো করে গ্রেনেড পেতেন এবং পর্যাপ্ত বিস্ফোরক। মুরতি ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বা স্বাধীন বাংলা রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাচের ১৩০ জন ক্যাডেট অফিসারকে তিন মাসের ট্রেনিং দেওয়া হয় যাদের অন্যতম ছিলেন শেখ কামাল। এছাড়াও ৫০০ জন যুবককে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যাতে তারা নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম হয় যুদ্ধে আগ্রহী কিন্তু ভারতে আসতে না পারা তরুণদের। এর বাইরে ১২০০ যুবককে মেডিকেল ট্রেনিং দিয়ে মেডিকেল কিটসহ পাঠানো হয় দেশে।
এখানে মনে রাখতে হবে গণবাহিনীর সদস্য বা বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন একধরণের স্বেচ্ছাসেবক। কিন্তু নিয়মিত এবং আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন পেশাদার। তাই তাদের জন্য বেতন বরাদ্দ ছিলো বাংলাদেশ সরকারের তরফে। জ্যাকপট কমান্ডারের মাধ্যমে প্রতিমাসে এই বেতন পেতেন তারা যা ছিলো এরকম:
কমান্ডিং অফিসার : ৫০০ ভারতীয় রুপি
অফিসার: ৪০০ রুপি
অফিসার ক্যাডেট: ১০০ রুপি
জুনিয়র কমিশনড অফিসার (জেসিও): ১৫০ রুপি
মুক্তিফৌজের নন কমিশনড অফিসার এবং নিয়মিত বাহিনীর সাধারণ সৈন্যদের বেতন ছিলো যথাক্রমে ৭০ ও ৭৫ রুপি।অন্যদিকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ কালে ৩০ রুপি এবং ট্রেনিং শেষে ৫০ রুপির এককালীন ভাতা পেতেন। দেশে পাঠানোর সময় দিন হিসাব করে তাদের জন্য বরাদ্দ ছিলো প্রতিদিন ২ রুপি।
বেতনের পাশাপাশি দুই সেট খাকি ইউনিফর্ম এবং হালকা বিছানা পেতেন নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা। আধাসামরিক বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা পেতেন লুঙ্গি, শার্ট, পিটি স্যু। এর বাইরে স্থানীয় সূত্র থেকে কম্বলসহ থালাবাসন ইত্যাদি জোগাড় করে নিতেন তারা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতো একই রেশন বরাদ্দ ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা অনুযায়ী অস্ত্রের সংখ্যা ছিলো অপ্রতুল। এই সমস্যার কারণ হচ্ছে ভারতীয় বাহিনীর অর্ডন্যান্স থেকে এসব অস্ত্র ইস্যু করে তারপর আকাশপথে নিয়ে যেতে হতো প্রয়োজনীয় জায়গায়।সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক এই জটিলতায় হতাশায় ভুগতে হতো মুক্তিযোদ্ধাদের।
বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো ভাগ ছিলো যাদের মধ্যে ব্যতিক্রমী কিছু হচ্ছে:
১.সুইসাইড স্কোয়াড:মূলত জামায়াতে ইসলামী এবং মুসলিম লীগের দালাল নেতাদের হত্যা করাই ছিলো এদের মিশন। পাশাপাশি রাজাকার এবং পাকিস্তানীদের সহযোগী দালাল বাঙালী কর্মকর্তারাও ছিলো তাদের হত্যা তালিকায়। এদের উপর নির্দেশনা থাকতো গ্রেফতার এড়াতে আত্মহত্যার।
২.বিচ্ছু বাহিনী:মূলত অল্পবয়সী কিশোর এবং বালকদের নিয়ে গঠিত হতো এই বাহিনী যাদের কাজ ছিলো মুলত গোয়েন্দার। এরা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীর গতিবিধি নজর রাখতো এবং ক্যাম্প ও বাংকারগুলোর খুটিনাটি তথ্য যোগাড় করতো। ঢাকা ও চট্টগ্রামে মেয়েদের উইং ছিলো বিচ্ছু বাহিনীর। এই বিচ্ছুদেরই একজন শহিদুল ইসলাম লালু বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ বীরপ্রতীক যিনি গ্রেনেড হামলায় দুটো পাকি বাংকার উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সহজ করে দিয়েছিলেন থানা দখল।
৩.তুফান বাহিনী ছিলো বিশেষ কমান্ডো ট্রেনিং পাওয়া বাহিনী যারা ঝড়ের মতো এসে কাজ সেরে সেভাবেই হাওয়া হয়ে যেতেন।
মুক্তিবাহিনীর এই গেরিলাযোদ্ধাদের তৃণমূল পর্যায়ের সার্বিক সহযোগিতা দিতো সংগ্রাম পরিষদ। প্রতিটি থানা ও মহকুমা পর্যায়ে একাত্তরের শুরুতেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিলো এই সংগ্রাম পরিষদ যারা মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা, খাওয়া আশ্রয় এবং নিরাপত্তার দিকটা দেখতো।
ভারতীয় বাহিনীর অস্ত্র সহায়তা ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই দেশের ভেতর সাফল্যের সঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধ চালিয়েছে কিছু সাহসী তরুণ-যুবা যাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে মাগুরার আকবর বাহিনী (প্রায় দেড় হাজার গেরিলা),যশোর ও খুলনা অঞ্চলে হেমায়েত বাহিনী (৫০০ গেরিলা) খিজির ও রিয়াসাত বাহিনী (১০০ যোদ্ধা),ক্যাপ্টেন জিয়ার বাহিনী (২৫০ জন), শাহজাহান বাহিনী (২৫০ যোদ্ধা),আরেফিন বাহিনী (যোদ্ধা সংখ্যা জানা যায়নি), মেহেদি বাহিনী (৭৫জন গেরিলা); ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম অঞ্চলে নুরুল আফসার বাহিনী (৪০০ জন), হারুন (১০০ জন);ময়মনসিংহ অঞ্চলে কাদেরিয়া বাহিনী (প্রায় ১৭ হাজার), আবদুল মান্নান (৮৫ জন), আনোয়ারউদ্দিন (১০০ জন)। এদের বেশীরভাগই পরে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর আনুগত্য মেনে নেয়।
চীনপন্থী যেসব বাম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বরিশালের পেয়ারাবাগান অঞ্চলে সিরাজ শিকদারের বাহিনী,পাবনায় টিপু বিশ্বাসের বাহিনী,মতিন-আলাউদ্দিন বাহিনী, আবদুল হকের বাহিনী, নোয়াখালি অঞ্চলের কমরেড তোয়াহার লালবাহিনী এবং ফকিরহাট-মিরেরসরাই সীতাকুন্ড অঞ্চলের কাশেম বাহিনী। পাকিস্তানের প্রতি চীনের প্রকাশ্য পক্ষপাতে এরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধকে এরা সোভিয়েত সম্প্রসারনবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের মেলবন্ধন অভিধা দিয়ে কেউ যুদ্ধ বন্ধ করে দেয় (মতিন- আলাউদ্দিন), কেউ বা পাকিস্তানের পক্ষ নেয় (আবদুল হক), কেউ পাকিস্তানি ও মুক্তিবাহিনী দুইপক্ষের সঙ্গেই যুদ্ধ করে (সিরাজ শিকদার, তোয়াহা, কাশেম)। এর বিপরীতে কমরেড ওহিদুল তার দেড়হাজার যোদ্ধা নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বীকার করে নেন। একইভাবে অগ্নিপ্রভা মিথি তার মিথি বাহিনী নিয়ে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেন। এর বাইরে আরো দুটো চীনপন্থী রাজনৈতিক দলের কথা বলতেই হয়। কাজী জাফর ও মেনন গ্রুপ মুক্তিবাহিনীর পক্ষ নিলেও মশিউর রহমান-নুরুল কাদির-হুদা গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলে এতে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে।
এছাড়া মুজিব বাহিনীর কথা না বললেই নয় ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে প্রায় ৫০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়।মুক্তাঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আধিপত্য নিশ্চিত করতে তৈরি হয়েছিলো এই এলিট বাহিনী যাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে তৈরি করা হচ্ছিলো দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য। এদের বেশিরভাগ যুদ্ধ করতে পারেননি, বরং স্বাধীনতার পর তাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ কাজে লাগান জাসদ ও গণবাহিনী গঠন করে। মুজিববাহিনী গঠনের পর মস্কোপন্থী বামেরা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে ২০ হাজার সদস্যের একটি পৃথক দল গঠন করে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। ঘোড়াশাল, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, নরসিংদি, কুমিল্লা ও ঢাকা অঞ্চলেই মূলত যুদ্ধ করে তারা। এছাড়া ঢাকা তোলপাড় করা ক্র্যাকপ্লাটুনের বেশীরভাগ সদস্যই ছিলো মস্কোপন্থী বাম বা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য।
এবার আসা যাক নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গড়া স্বাধীন বাংলা রেজিমেন্টের বিষয়ে। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ১, ৩ ও ৮ নং ব্যাটেলিয়নকে মেঘালয়ের তুরায় পাঠানো হয়।সেখানে তাদের পুনর্বিন্যস্ত করা হয়।একইভাবে ত্রিপুরায় অবস্থিত ২ ও ৪ নং ব্যাটেলিয়নকে বিন্যস্ত করা হয়। সেপ্টেম্বরে আরও তিনটি নতুন ব্যাটেলিয়ন গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রশিক্ষিত গেরিলা, জুনিয়র ক্যাডেট অফিসার এবং বাকি পাচ ব্যাটেলিয়ন থেকে বাছাই করে নভেম্বরের শেষ নাগাদ গঠিত হয় আটটি পদাতিক বাহিনী যারা ছিলো যুদ্ধউপযোগী এবং সমরাস্ত্রে সজ্জিত। যদিও নতুন তিন ব্যাটেলিয়ান যুদ্ধের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রস্ততির মতো প্রশিক্ষণ পায়নি।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা গোলন্দাজ বাহিনীর ৮০ জন বাঙালী সদস্যকে নিয়ে ত্রিপুরায় গঠিত হয় মুজিব ব্যাটারি নামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ফিল্ড ব্যাটারি। তাদের দেওয়া হয় চারটি ৩.৭ ইঞ্চি হাওইটজার গান। অক্টোবরে শিলচরে দ্বিতীয় ফিল্ড ব্যাটারিটি সংগঠিত হয় ছয়টি ১০৫ এমএম ইটালিয়ান গান সহকারে।পরে এই অস্ত্রসম্ভার দুভাগ করে আরেকটি ফিল্ড ব্যাটারি গঠন করা হয়। নভেম্বরের শেষ নাগাদ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আটটি ব্যাটেলিয়ান তিনটি ব্রিগেড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অধিনায়কদের নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে তাদের নাম হয় যথাক্রমে জেড ফোর্স (জিয়াউর রহমান), এস ফোর্স (সফিউল্লাহ)এবং কে ফোর্স (খালেদ মোশাররফ)।
জিয়ার জেড ফোর্সে ছিলো ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১,৩ ও ৮ নং ব্যাটেলিয়ন এবং ২ ফিল্ড ব্যাটারি। ১০ ও ১১ নং ব্যাটেলিয়ান এবং তিনটি ইটালিয়ান ১০৫এমএম গান নিয়ে গঠিত তিন ফিল্ড ব্যাটারির কমান্ড পান খালেদ মোশাররফ। সফিউল্লাহর এস ফোর্সে ছিলো ২,৩,৯ নং ব্যাটেলিয়ান এবং ১ নং ফিল্ড ব্যাটারি। পাশাপাশি ৫৫০ জন নৌকমান্ডোকে নিয়ে এবং পাকিস্তান নৌ বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা কিছু নৌঅফিসার ও সেনাকে নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনী। অক্টোবর নাগাদ দুটো হেলিকপ্টার এবং একটি করে ওটার ও ডাকোটা বিমান নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। দুটো বিমানেই রকেট এবং মেশিনগান সংযুক্ত এবং তা থেকে বোমা নিক্ষেপ করা যেতো। ইপিআর পুলিশ আনসারের মতো আধাসামরিক বাহিনীর ৯ হাজার ৬৬০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত মুক্তিফৌজকে ৪৫টি কোম্পানিতে ভাগ করে বিভিন্ন সেক্টরে বিন্যস্ত করে দেওয়া হয় নিয়মিত বাহিনী এবং গেরিলাদের সঙ্গে।
২০ নভেম্বর রোজার ঈদের পর থেকেই ঘুরে যায় যুদ্ধের মোড়। ভারতীয় সেনাবাহিনী অনেকটা প্রকাশ্যেই আর্টিলারি সাপোর্ট দিতে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের।সেই সুবিধা নিয়ে দেশের বিস্তির্ণ অঞ্চলে পাকিস্তানীদের বিচ্ছিন্ন এবং কোনঠাসা করে ফেলে মুক্তিবাহিনী। জাতিসংঘ ও পরাশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানকে বাচানোর শেষ প্রয়াস হিসেবেই ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করে পাকিস্তান। লড়াই শুরু হয়ে যায় দুই ফ্রন্টে। পুর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ ভারত মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে শুরু হয় কনভেনশনাল ওয়ার। ইতিমধ্যে আকাশ এবং নৌপথ জেতা হয়ে গেছে তাদের।স্থলপথের পুরোটাই সহজ এবং নিরাপদ করে রেখেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নিলো আরাধ্য বাংলাদেশ, যার জন্য এত সংগ্রাম, এত রক্ত, এত ত্যাগ।
মাত্র সাড়ে চারহাজার পাকিস্তানী মারা নিয়ে হতাশ হবেন না প্লিজ। মনে রাখবেন নিয়মিত বাহিনীর প্রশিক্ষিত সেনা অফিসাররা এই অসীম সাহসী আবেগীদের একটু গুলি ছুড়তে শিখিয়ে মরতে পাঠিয়ে দিয়েছে প্রাথমিক ঝামেলা সেরে যুদ্ধটা তাদের জন্য একটু নিরাপদ করতে। আসল কাজটা এরাই সেরেছে। এদের জন্যই মনোবলের তলানীতে পৌছানো পাকিস্তানীরা সুযোগ পাওয়া মাত্র সাদা পতাকা উড়িয়েছে।
মনে পড়ছে ২০০৮ সালের ৩০ মার্চ জেনারেল জ্যাকবের নেওয়া সাক্ষাতকারের শেষ কথাগুলো: Last of all, I want to tell you something. The freedom fighters and the East Bengal Regiment, who with their limited resources fought a mighty regular army, earned the liberation of Bangladesh and it was their love for the country that made them victorious. We helped them, we were brothers in arms. But it was their fight, they fought it. They fought with passion and they achieved what they fought for. I give my heartiest blessings and share the pride for them. They are the gems your country should be proud of.
হেল আম প্রাউড অব দেম ম্যান। আই চেরিশ দেয়ার প্রাইড…
প্রাসংগিক এলবাম
^উপরে যেতে ক্লিক করুন