ছয় দফা কর্মসূচিঃ বাঙালির ‘ম্যাগনা কার্টা’

6point
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ বাঙালির চোখ খুলে দেয়। যুদ্ধকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তান সমগ্র বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের মূলত কোনো সামরিক সহায়তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই পুরোপুরি ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।


অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠী ব্যস্ত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষায়। এমতাবস্থায় যুদ্ধশেষে, শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা নিয়ে সরব হন। ছয় দফা ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা থেকে মুক্তির একটি বিস্তৃত অর্থনৈতিক সনদ।
এই ছয়টি দফা হলো-
প্রথম দফা – পাকিস্তানের সরকার হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ও সংসদীয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা প্রত্যক্ষ ও সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে।
দ্বিতীয় দফা – যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে থাকবে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়াদি।
তৃতীয় দফা – দেশের দুইটি অঞ্চলের জন্য দুইটি পৃথক অথচ সহজেই বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। এক্ষেত্রে দুই অঞ্চলে একক মুদ্রাও থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ফেডারেল ব্যাংককে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
চতুর্থ দফা – রাজস্ব সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব এবং কর ধার্যের ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারগুলোর থাকবে। দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় পরিচালনার জন্য আদায়কৃত রাজস্বের অংশবিশেষ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেয়া হবে।
পঞ্চম দফা – বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের জন্য পৃথক হিসাব রাখতে হবে। প্রাদেশিক সরকারগুলো বিদেশের সাথে বৈদেশিক নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাণিজ্যিক চুক্তি করতে পারবে।
ষষ্ঠ দফা – কার্যকরভাবে জাতীয় নিরাপত্তায় অংশগ্রহণের জন্য প্রদেশগুলোকে প্যারামিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দেয়া হবে।
6point1
ছয় দফা দাবি উত্থাপণের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইয়ুব খান এটিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি হিসেবে আখ্যা দেন এবং বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু হিসেবে অভিহিত করেন। একইসাথে তিনি এই দাবিনামাকে কঠোরভাবে দমনের হুমকি দেন। কিন্তু এতে বিচলিত না হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্দোলন চালিয়ে যায় আওয়ামী লীগ।
বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে তিন মাসব্যাপী এক ব্যাপক গণসংযোগ কর্মসূচি গ্রহণ করেন যার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি কোণে পৌঁছে যায় ছয় দফা। ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম তিন মাসে মোট আটবার গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিব। এরপর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাঁকে আবারও গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ছয় দফা কর্মসূচির সমর্থনে ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। এসময় পুলিশের গুলিতে তেজগাঁও, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জে প্রায় ১৩ জন ব্যক্তি নিহত হন। আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু আইয়ুব প্রশাসনের এসকল পদক্ষেপে আন্দোলন দমে না গিয়ে উল্টো আরও জোরদার হয়ে ওঠে। ছয় দফার দাবিতে গণআন্দোলন দুর্বার হয়ে ওঠে। এটি জনগণের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়। ছাত্রসমাজও এই ছয় দফার সমর্থনে তাদের এগারো দফা দাবি পেশ করে। আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশ; আইয়ুব শাসনের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠে বাঙালি সমাজ।
^উপরে যেতে ক্লিক করুন