বিশেষ প্রতিনিধি (ইত্তেফাক) (জনকন্ঠ) ২১ আগষ্ট, ২০১৫ ইং ০০:৪২ মিঃ
ছত্রিশ বছরের বন্ধুরপথে শেখ হাসিনার প্রাণনাশে ১৯ বার হামলা
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ১৯৮১ থেকে ২০১৫। এই ৩৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে বর্তমান
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার পথচলা মোটেই মসৃণ ছিল
না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে গেলেও ৩৬ বছরে বার বার
তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা করেছে ঘাতক চক্র। এক/দু’বার নয়, এ পর্যন্ত মোট ১৯
বার হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর এই কন্যাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সর্বশেষ
মারণাঘাত হানতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট চালানো হয় ভয়াল গ্রেনেড হামলা। প্রতিটি
হামলায় মৃত্যুজাল ছিন্ন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও
প্রাণ দিতে হয়েছে আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে।
গত ৩৬ বছরে বার বার হামলার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) মাহবুবুল হক শাকিল জনকণ্ঠকে বলেন, ১৫ আগস্ট ঘাতকচক্রের মূল টার্গেটই ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা। কিন্তু বিদেশে থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রাণে বেঁচে গেলেও ঘাতকচক্র যে এখনও বসে নেই, ১৯ হামলার ঘটনা পর্যালোচনা করলেই তা স্পষ্ট হবে।
এরশাদের আমলে প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে ১৯৮১ সালের ১৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে। তৎকালীন ৮ দলীয় জোটের নেত্রী শেখ হাসিনা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ওই দিন বেলা দুটায় পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে একটি বিশাল মিছিল নিয়ে লালদীঘি ময়দানের সামনে এসে পৌঁছামাত্রই মেট্রোপলিটন পুলিশের দাঙ্গা বাহিনী ও বিডিআর হামলা চালায়। মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপের পাশাপাশি গুলিবর্ষণও করা হয়। এতে একজন নিহত এবং শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক আহত হয়। নেতাকর্মীরা ওই সময়ও মানবঢাল রচনা করে রক্ষা করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে।
এর পরের বছর ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় রাত বারোটার দিকে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দল ফ্রিডম পার্টির একদল সন্ত্রাসী। হামলাকারীরা ৭/৮ মিনিট ধরে বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালায় ও একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তবে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত না হওয়ায় অনেকেই প্রাণে বেঁচে যান।
পরের হামলার ঘটনা ঘটে ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ওদিন টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় ফিরে বেলা আড়াইটার দিকে গ্রীনরোডের কাছে ধানম-ি স্কুলে উপনির্বাচনে ভোট প্রদানের পর গ্রীনরোড পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে ভোটের পরিস্থিতি দেখতে যান শেখ হাসিনা। তিনি গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির ওয়াহিদের নেতৃত্বে বিএনপি ক্যাডাররা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান শেখ হাসিনা।
১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ট্রেনমার্চের সময় ঈশ্বরদী ও নাটোর রেলস্টেশনে শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে ট্রেনের বগিতে গুলি ছোড়া হয়। ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর একটি মাইক্রোবাস থেকে সভামঞ্চ লক্ষ্য করে আকস্মিক গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা করা হয়। এতে আহত হয় অন্তত ২০।
শেখ হাসিনা ও তাঁর পুত্রকন্যাসহ ৩১ জনকে হত্যার একটি পরিকল্পনা পরবর্তীতে ফাঁস হয়ে যায়। এই ৩১ জনকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে ই-মেল করে এশিয়া টিভির মালিক শোয়েব চৌধুরী। ই-মেল প্রেরণের অভিযোগে শোয়েব চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা হয়।
এর পর ২০০০ সালের ২০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় জনসভাস্থল ও হেলিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখে জঙ্গী সংগঠন হরকত-উল-জিহাদ (হুজি)। দুদিন পর শেখ লুৎফুর রহমান ডিগ্রী কলেজ মাঠে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য রাখার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই গোয়েন্দাদের কাছে পুঁতে রাখা বোমাটি ধরা পড়ে।
২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক আমলে নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা সিলেট গিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনী প্রচারের এক পর্যায়ে রাত আটটার দিকে জনসভাস্থল থেকে ৫শ’ গজ দূরে একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরিত হলে ঘটনাস্থলেই দু’জন প্রাণ হারায়। সেদিন সেখানে সন্ধ্যায় সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জনসভা ছিল। আগেই বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় ভেস্তে যায় শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা। পরে হামলা পরিকল্পনার দায় স্বীকার করে হরকত-উল-জিহাদ।
বিএনপি আমলে ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁ বিএমসি সরকারী মহিলা কলেজের সামনে যুবদল ক্যাডার খালিদ বিন হেদায়েত তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা চালায়।
২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলিবর্ষণ করে বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা। একই বছরের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিশাল জনসভায় ভয়াল গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে ১১/১২ গ্রেনেড ও গুলিবর্ষণ করা হয়। মানবঢাল রচনা করে বঙ্গবন্ধুর এই কন্যাকে রক্ষা করলেও আইভি রহমানসহ ২৩ নেতাকর্মী প্রাণ হারান।
প্রধানমন্ত্রী হত্যার আরেকটি চক্রান্ত ফাঁস হয় ২০১১ সালে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করার লক্ষ্যে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের চক্রান্ত হয়েছিল, যা পরে ব্যর্থ হয়ে যায়। উইকিলিকস প্রকাশিত সৌদি আরবের গোপন বার্তায় দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর খুনী শরিফুল হক ডালিম এ অভ্যুত্থানের সঙ্গে সরাসরি এবং সেনাবাহিনীর ১৬ অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সদস্য জড়িত ছিলেন। এতে অর্থায়ন করে হংকংয়ে বসবাসরত বাংলাদেশী ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ। ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ব্যর্থ করে দেয়া ওই অভ্যুত্থানের চেষ্টার কথা প্রকাশ করে।
এদিকে ২০১৪ সালের শেষদিকে প্রশিক্ষিত নারী জঙ্গী দিয়ে মানববোমার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা ফাঁস হয় ভারতে। শেখ হাসিনা হত্যার ষড়যন্ত্র এবং অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতার জেএমবির জঙ্গী শাহানুর আলম ওরফে ডাক্তার। ধৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে, রাজীব গান্ধীর হত্যাকা-ের মতো নারী ‘মানববোমা’ ব্যবহার করে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্য তাদের ছিল। ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তিন শতাধিক নারী ও যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের দুটি নারী মাদ্রাসায়।
গ্রেনেড হামলার আসামিরা কে কোথায় ॥ শংকর কুমার দে জানান, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মোট আসামির সংখ্যা ৫২। তিন দফায় তদন্ত শেষে এদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয় সিআইডি। মূল পরিকল্পনাকারী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লন্ডনপ্রবাসী তারেক রহমানসহ ১৮ জন এখনও পলাতক। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়নি পলাতক বিএনপি-জামায়াত জোটের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই হরকাত-উল জিহাদ (হুজি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিনকেও। কলঙ্কময় ইতিহাসের ভয়াবহ এ মামলাটি ধামাচাপা দিতে যারা জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছিল সেই সিআইডির ৩ পুলিশ কর্মকর্তা, সাবেক তিন আইজিপিসহ ৮ জন জামিনে মুক্ত। এ মামলার চার্জশীটভুক্ত ৫২ জনের মধ্যে ২৬ আসামি কারাগারে আছেন। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন এজলাসে ঢাকার ১নং দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচার কাজ চলছে। মামলার ৪৯৪ সাক্ষীর মধ্যে ১৭৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। মামলার প্রধান কৌঁসুলী সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, এ বছরেই মামলার বিচারকাজ শেষ হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
পলাতক ১৮ ॥ তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোঃ হানিফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, রাতুল বাবু, ডিএমপির সাবেক ডিসি ওবায়দুর রহমান, খান সাঈদ হাসান, লে. কর্নেল (অব) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, মেজর জেনারেল (অব) এটিএম আমিন, মাওলানা তাজউদ্দিন ঝিনাইদহের ইকবাল, মাগুরার খলিল, দোহারের জাহাঙ্গীর ওরফে বদর ও গোপালগঞ্জের মাওলানা লিটন। আর ভারতের তিহার জেলে আটক হুজির আনিসুল মোরসালিন ও মহিবুল মোত্তাকিন। এর মধ্যে তারেক ও তাজউদ্দিন ছাড়া ১৭ জনের অবস্থানের বিষয়ে কোন তথ্যই জানে না পুলিশ। তারেক রহমানসহ পলাতকদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেডএলার্ট জারি করা হয়েছে।
জামিনে ৮ জন ॥ সাবেক আইজি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক, খোদা বকস চৌধুরী, সিআইডির সাবেক তিন কর্মকর্তা রুহুল আমিন, মুন্সী আতিকুর রহমান, আবদুর রশিদ, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব) সাইফুল ইসলাম ডিউক ও বিএনপি নেতা কাউন্সিলর আরিফুর রহমান।
কারাগারে ২৬ ॥ সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর, রেজ্জাকুল হায়দার, আব্দুর রহিম, জামায়াত নেতা মুজাহিদ, মাওলানা ফরিদ, মুফতি আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, হুজির মাওলানা আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গী আব্দুল মাজেদ বাট, জঙ্গী গোলাম মোস্তফা, মুফতি হান্নান মুন্সী ওরফে আবুল কালাম ওরফে আবদুল মান্নান, মহিবুল্লাহ মফিজুর রহমান ওরফে অভি, শরিফ শাহেদুল আলম বিপুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাঃ জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ আবু তাহের, শাহাদাত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, আবদুস সালাম পিন্টু, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ ও উজ্জ্বল ওরফে রতন ও আরিফ হাসান ওরফে সুমন ও বরিশালের মাওলানা আবু বকর।
জজ মিয়া নাটকের কুশীলব ॥ জোট সরকারের সময় তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও এএসপি আব্দুর রশীদ। এরপর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জজ মিয়া নাটকের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে সিআইডি। ওই সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন এ মামলায় ২২ জনকে আসামি করে চার্জশীট প্রদান করেন সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর। ওই চার্জশীটে চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ও হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের নাম উল্লেখ করে চার্জশীট প্রদান করা হয়। কিন্তু গ্রেনেডের উৎস ও মদদদাতা কারা এ বিষয়টি থেকে যায় আড়ালেই।
সম্পূরক চার্জশীটে পরিকল্পনাকারীরা ॥ ২০১১ সালের ৩ জুলাই সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ গ্রেনেডের উৎস ও মদদদাতাদের শনাক্ত করে ৩০ জনের বিরুদ্ধে একটি সম্পূরক চার্জশীট দেন। চার্জশীটে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব) এটিএম আমিন, লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, এনএসআইর সাবেক ডিজি আব্দুর রহিম ও খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব) সাইফুল ইসলাম ডিউকসহ ৩০ জন। বাদ যায়নি জোট সরকারের সময়ের এ মামলার তিন তদন্ত কর্মকর্তার নামও। ফলে এ মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২।
গত ৩৬ বছরে বার বার হামলার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) মাহবুবুল হক শাকিল জনকণ্ঠকে বলেন, ১৫ আগস্ট ঘাতকচক্রের মূল টার্গেটই ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা। কিন্তু বিদেশে থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রাণে বেঁচে গেলেও ঘাতকচক্র যে এখনও বসে নেই, ১৯ হামলার ঘটনা পর্যালোচনা করলেই তা স্পষ্ট হবে।
এরশাদের আমলে প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে ১৯৮১ সালের ১৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে। তৎকালীন ৮ দলীয় জোটের নেত্রী শেখ হাসিনা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ওই দিন বেলা দুটায় পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে একটি বিশাল মিছিল নিয়ে লালদীঘি ময়দানের সামনে এসে পৌঁছামাত্রই মেট্রোপলিটন পুলিশের দাঙ্গা বাহিনী ও বিডিআর হামলা চালায়। মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপের পাশাপাশি গুলিবর্ষণও করা হয়। এতে একজন নিহত এবং শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক আহত হয়। নেতাকর্মীরা ওই সময়ও মানবঢাল রচনা করে রক্ষা করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে।
এর পরের বছর ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় রাত বারোটার দিকে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দল ফ্রিডম পার্টির একদল সন্ত্রাসী। হামলাকারীরা ৭/৮ মিনিট ধরে বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালায় ও একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তবে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত না হওয়ায় অনেকেই প্রাণে বেঁচে যান।
পরের হামলার ঘটনা ঘটে ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ওদিন টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় ফিরে বেলা আড়াইটার দিকে গ্রীনরোডের কাছে ধানম-ি স্কুলে উপনির্বাচনে ভোট প্রদানের পর গ্রীনরোড পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে ভোটের পরিস্থিতি দেখতে যান শেখ হাসিনা। তিনি গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির ওয়াহিদের নেতৃত্বে বিএনপি ক্যাডাররা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান শেখ হাসিনা।
১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ট্রেনমার্চের সময় ঈশ্বরদী ও নাটোর রেলস্টেশনে শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে ট্রেনের বগিতে গুলি ছোড়া হয়। ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর একটি মাইক্রোবাস থেকে সভামঞ্চ লক্ষ্য করে আকস্মিক গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা করা হয়। এতে আহত হয় অন্তত ২০।
শেখ হাসিনা ও তাঁর পুত্রকন্যাসহ ৩১ জনকে হত্যার একটি পরিকল্পনা পরবর্তীতে ফাঁস হয়ে যায়। এই ৩১ জনকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে ই-মেল করে এশিয়া টিভির মালিক শোয়েব চৌধুরী। ই-মেল প্রেরণের অভিযোগে শোয়েব চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা হয়।
এর পর ২০০০ সালের ২০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় জনসভাস্থল ও হেলিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখে জঙ্গী সংগঠন হরকত-উল-জিহাদ (হুজি)। দুদিন পর শেখ লুৎফুর রহমান ডিগ্রী কলেজ মাঠে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য রাখার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই গোয়েন্দাদের কাছে পুঁতে রাখা বোমাটি ধরা পড়ে।
২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক আমলে নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা সিলেট গিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনী প্রচারের এক পর্যায়ে রাত আটটার দিকে জনসভাস্থল থেকে ৫শ’ গজ দূরে একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরিত হলে ঘটনাস্থলেই দু’জন প্রাণ হারায়। সেদিন সেখানে সন্ধ্যায় সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জনসভা ছিল। আগেই বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় ভেস্তে যায় শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা। পরে হামলা পরিকল্পনার দায় স্বীকার করে হরকত-উল-জিহাদ।
বিএনপি আমলে ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁ বিএমসি সরকারী মহিলা কলেজের সামনে যুবদল ক্যাডার খালিদ বিন হেদায়েত তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা চালায়।
২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলিবর্ষণ করে বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা। একই বছরের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিশাল জনসভায় ভয়াল গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে ১১/১২ গ্রেনেড ও গুলিবর্ষণ করা হয়। মানবঢাল রচনা করে বঙ্গবন্ধুর এই কন্যাকে রক্ষা করলেও আইভি রহমানসহ ২৩ নেতাকর্মী প্রাণ হারান।
প্রধানমন্ত্রী হত্যার আরেকটি চক্রান্ত ফাঁস হয় ২০১১ সালে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করার লক্ষ্যে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের চক্রান্ত হয়েছিল, যা পরে ব্যর্থ হয়ে যায়। উইকিলিকস প্রকাশিত সৌদি আরবের গোপন বার্তায় দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর খুনী শরিফুল হক ডালিম এ অভ্যুত্থানের সঙ্গে সরাসরি এবং সেনাবাহিনীর ১৬ অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সদস্য জড়িত ছিলেন। এতে অর্থায়ন করে হংকংয়ে বসবাসরত বাংলাদেশী ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ। ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ব্যর্থ করে দেয়া ওই অভ্যুত্থানের চেষ্টার কথা প্রকাশ করে।
এদিকে ২০১৪ সালের শেষদিকে প্রশিক্ষিত নারী জঙ্গী দিয়ে মানববোমার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা ফাঁস হয় ভারতে। শেখ হাসিনা হত্যার ষড়যন্ত্র এবং অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতার জেএমবির জঙ্গী শাহানুর আলম ওরফে ডাক্তার। ধৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে, রাজীব গান্ধীর হত্যাকা-ের মতো নারী ‘মানববোমা’ ব্যবহার করে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্য তাদের ছিল। ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তিন শতাধিক নারী ও যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের দুটি নারী মাদ্রাসায়।
গ্রেনেড হামলার আসামিরা কে কোথায় ॥ শংকর কুমার দে জানান, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মোট আসামির সংখ্যা ৫২। তিন দফায় তদন্ত শেষে এদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয় সিআইডি। মূল পরিকল্পনাকারী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লন্ডনপ্রবাসী তারেক রহমানসহ ১৮ জন এখনও পলাতক। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়নি পলাতক বিএনপি-জামায়াত জোটের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই হরকাত-উল জিহাদ (হুজি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিনকেও। কলঙ্কময় ইতিহাসের ভয়াবহ এ মামলাটি ধামাচাপা দিতে যারা জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছিল সেই সিআইডির ৩ পুলিশ কর্মকর্তা, সাবেক তিন আইজিপিসহ ৮ জন জামিনে মুক্ত। এ মামলার চার্জশীটভুক্ত ৫২ জনের মধ্যে ২৬ আসামি কারাগারে আছেন। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন এজলাসে ঢাকার ১নং দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচার কাজ চলছে। মামলার ৪৯৪ সাক্ষীর মধ্যে ১৭৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। মামলার প্রধান কৌঁসুলী সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, এ বছরেই মামলার বিচারকাজ শেষ হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
পলাতক ১৮ ॥ তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোঃ হানিফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, রাতুল বাবু, ডিএমপির সাবেক ডিসি ওবায়দুর রহমান, খান সাঈদ হাসান, লে. কর্নেল (অব) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, মেজর জেনারেল (অব) এটিএম আমিন, মাওলানা তাজউদ্দিন ঝিনাইদহের ইকবাল, মাগুরার খলিল, দোহারের জাহাঙ্গীর ওরফে বদর ও গোপালগঞ্জের মাওলানা লিটন। আর ভারতের তিহার জেলে আটক হুজির আনিসুল মোরসালিন ও মহিবুল মোত্তাকিন। এর মধ্যে তারেক ও তাজউদ্দিন ছাড়া ১৭ জনের অবস্থানের বিষয়ে কোন তথ্যই জানে না পুলিশ। তারেক রহমানসহ পলাতকদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেডএলার্ট জারি করা হয়েছে।
জামিনে ৮ জন ॥ সাবেক আইজি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক, খোদা বকস চৌধুরী, সিআইডির সাবেক তিন কর্মকর্তা রুহুল আমিন, মুন্সী আতিকুর রহমান, আবদুর রশিদ, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব) সাইফুল ইসলাম ডিউক ও বিএনপি নেতা কাউন্সিলর আরিফুর রহমান।
কারাগারে ২৬ ॥ সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর, রেজ্জাকুল হায়দার, আব্দুর রহিম, জামায়াত নেতা মুজাহিদ, মাওলানা ফরিদ, মুফতি আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, হুজির মাওলানা আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গী আব্দুল মাজেদ বাট, জঙ্গী গোলাম মোস্তফা, মুফতি হান্নান মুন্সী ওরফে আবুল কালাম ওরফে আবদুল মান্নান, মহিবুল্লাহ মফিজুর রহমান ওরফে অভি, শরিফ শাহেদুল আলম বিপুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাঃ জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ আবু তাহের, শাহাদাত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, আবদুস সালাম পিন্টু, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ ও উজ্জ্বল ওরফে রতন ও আরিফ হাসান ওরফে সুমন ও বরিশালের মাওলানা আবু বকর।
জজ মিয়া নাটকের কুশীলব ॥ জোট সরকারের সময় তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও এএসপি আব্দুর রশীদ। এরপর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জজ মিয়া নাটকের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে সিআইডি। ওই সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন এ মামলায় ২২ জনকে আসামি করে চার্জশীট প্রদান করেন সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর। ওই চার্জশীটে চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ও হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের নাম উল্লেখ করে চার্জশীট প্রদান করা হয়। কিন্তু গ্রেনেডের উৎস ও মদদদাতা কারা এ বিষয়টি থেকে যায় আড়ালেই।
সম্পূরক চার্জশীটে পরিকল্পনাকারীরা ॥ ২০১১ সালের ৩ জুলাই সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ গ্রেনেডের উৎস ও মদদদাতাদের শনাক্ত করে ৩০ জনের বিরুদ্ধে একটি সম্পূরক চার্জশীট দেন। চার্জশীটে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব) এটিএম আমিন, লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, এনএসআইর সাবেক ডিজি আব্দুর রহিম ও খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব) সাইফুল ইসলাম ডিউকসহ ৩০ জন। বাদ যায়নি জোট সরকারের সময়ের এ মামলার তিন তদন্ত কর্মকর্তার নামও। ফলে এ মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২।