পরিসীমা, ক্ষেত্রফল এবং আয়তন কি?

প্রায় সবার কাছে এই শব্দ তিনটি খুব পরিচিত। গণিত, পদার্থ, রসায়ন প্রভৃতি প্রায় সকল শাখায়-ই এই তিনটি শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। এক কথায় কিছু জেনে রাখা ভালোঃ
১. পরিসীমা হচ্ছে সরলরৈখিক একটা কিছু। এর মাত্রা "এক"
২. ক্ষেত্রফল হচ্ছে দ্বিমাত্রিক একটা কিছু। এর মাত্রা "দুই"
৩. আয়তন হচ্ছে ত্রিমাত্রিক একটা কিছু। এর মাত্রা "তিন"
এবার তাহলে শুরু করা যাকঃ

পরিসীমা কি?

ইহা "সরলরৈখিক" একটা কিছু! যার মাত্রা "এক"
পরিসীমাকে ভালোমত বুঝতে হলে "বাউন্ডারি" বা "বর্ডার" বা "সীমানা" সম্বন্ধে ধারণা থাকলেই যথেষ্ট। কারন, এই "বাউন্ডারি" বা "বর্ডার" বা "সীমানা"-ই হচ্ছে গণিতের ভাষায় "পরিসীমা"।
একটা বর্গ চিন্তা করা যাক। যার এক বাহুর দৈর্ঘ্য a একক।
ডানপাশের চিত্রে a একক দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একটি বর্গের ছবি দেয়া হল। এই বর্গের চারটি বাহুর সংযোগস্থলে চারটি ভিন্ন ভিন্ন রঙের বিন্দু দেখানো হয়েছে এবং প্রতিটি বিন্দুতে নম্বর দেয়া হয়েছে।
এখন, এই বর্গের পরিসীমা মাপতে হলে, যেকোনো একটি বিন্দু হতে পরিসীমা পরিমাপ শুরু করতে হবে। ধরি, সেই বিন্দুটি 'সবুজ বিন্দু' বা ১ নং বিন্দু। এবার ১ নং বিন্দু হতে এই বর্গের "বাউন্ডারি" বা "বর্ডার" বা "সীমানা"র উপর দিয়ে পুনরায় ১ নং বিন্দুতে আসতে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে, সেই অতিক্রান্ত দূরত্বটুকুই হচ্ছে এই বর্গের পরিসীমা। এখন, সবুজ বিন্দু হতে যাত্রা শুরু করি! 
প্রথমত, ১ হতে ২ নং যাবো। এক্ষেত্রে অতিক্রান্ত দূরত্ব "a একক"
দ্বিতীয়ত, ২ হতে ৩ নং যাবো। এক্ষেত্রেও অতিক্রান্ত দূরত্ব "a একক"
তৃতীয়ত, ৩ হতে ৪ নং যাবো। এক্ষেত্রেও অতিক্রান্ত দূরত্ব "a একক"
চতুর্থত, ৪ হতে ১ নং এ আসবো। এক্ষেত্রেও অতিক্রান্ত দূরত্ব "a একক" 
তাহলে, মোট অতিক্রান্ত দূরত্ব = a+a+a+a = 4a = বাহুগুলোর যোগফল।
একইভাবে,
আয়তক্ষেত্রের পরিসীমা = দৈর্ঘ্য+দৈর্ঘ্য+প্রস্থ+প্রস্থ = a+a+b+b = 2a+2b = বাহুগুলোর যোগফল।
ত্রিভুজের পরিসীমা = a+b+c = বাহুগুলোর যোগফল।

ক্ষেত্রফল কি?

ইহা "দ্বিমাত্রিক" একটা কিছু! যার মাত্রা "দুই"
ক্ষেত্রফল বুঝতে হলে "বর্গ" সম্বন্ধে ভালো ধারনা থাকা দরকার।
বর্গ কি? এককথায় বলতে গেলে, যেই চতুর্ভুজের চারটি বাহুর দৈর্ঘ্য একই, সেই চতুর্ভুজকে বর্গ বলে। বর্গের প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য একইরকম হওয়ায়, 'বর্গ' হচ্ছে "ক্ষেত্রফলের একক"
তাহলে, ক্ষেত্রফলটা কি? কোন ক্ষেত্রকে (যেমনঃ ত্রিভুজক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্র, আয়তক্ষেত্র ইত্যাদি) যতগুলো একক বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা যায়, ঐ ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল তত বর্গ একক। এখানে, "একক বর্গক্ষেত্র" বলতে, যেই বর্গের ক্ষেত্রফল ১ বর্গ একক, তাকে বোঝানো হয়েছে। আরো পরিষ্কার করা যাক।। ধরি, আমাদের কাছে একটি আয়তক্ষেত্র আছে। যার দৈর্ঘ্য ৭ মিটার এবং প্রস্থ ৫ মিটার। এখন ৭ মিটারকে সমান ৭ টি ভাগে ভাঙবো এবং ৫ মিটারকে সমান ৫ টি ভাগে ভাঙবো। ফলে প্রতিটি ভাগের মান হবে ১ মিটার করে। ডানপাশের চিত্রে দেখুন।

চিত্রের ভেতরে অনেকগুলা ছোট ছোট 'খোপ' বা 'ঘর' দেখা যাচ্ছে। একটু লক্ষ্য করে দেখুন, এই ঘরগুলোর প্রত্যেকেই একেকটি বর্গ! কারন, প্রত্যেকের বাহুর দৈর্ঘ্য সমান বা ১ মিটার। অর্থাৎ, এরা সবাই "একক বর্গক্ষেত্র". ক্ষেত্রফলের আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম, "কোন ক্ষেত্রকে (যেমনঃ ত্রিভুজক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্র, আয়তক্ষেত্র ইত্যাদি) যতগুলো একক বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা যায়, ঐ ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল তত বর্গ একক". মানে, এই আয়তক্ষেত্রের ভেতরের যতগুলা ছোট ছোট 'খোপ' বা 'ঘর' রয়েছে, তাদের সমষ্টিই হচ্ছে উক্ত আয়তক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল। এবার তাহলে ভেতরের খোপগুলো বা ঘরগুলো একটি একটি করে গুণে দেখা যাক। বামপাশের চিত্রে দেখুন।

বামপাশের চিত্র হতে দেখা যায় যে, মোট "খোপ সংখ্যা" বা "ঘর সংখ্যা" হচ্ছে ৩৫
তাহলে, আমাদের নেয়া আয়তক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলও ৩৫! কারন, ৭ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৫ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট আয়তক্ষেত্রকে ৩৫ টি "একক বর্গক্ষেত্রে" ভাগ করা সম্ভব। তাই, এর ক্ষেত্রফল ৩৫.
এবার একটু লক্ষ্য করা যাক! ৭x৫=৩৫. কিন্তু, এখানে ৭ হচ্ছে আয়তক্ষেত্রের দৈর্ঘ্য এবং ৫ হচ্ছে আয়তক্ষেত্রের প্রস্থ। অর্থাৎ, ৩৫=৭x৫=দৈর্ঘ্যxপ্রস্থ
সুতরাং, আয়তক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল=দৈর্ঘ্যxপ্রস্থ

ক্ষেত্রফলের একক

আমরা প্রায় সবাই-ই জানি যে, ক্ষেত্রফলের একক হচ্ছে "বর্গ একক". যেমনঃ বর্গ মিটার, বর্গ সেন্টিমিটার, বর্গ কিলোমিটার ইত্যাদি।
কিন্তু, কেন? একটু আগের আলোচনা হতে অনেকের-ই এর কারণটা বুঝে ফেলার কথা। তারপরেও বলছি।
যেহেতু, ক্ষেত্রফল বের করা মানে কোন ক্ষেত্রের ভেতরের "একক বর্গসংখ্যা" বের করা। সেহেতু, ক্ষেত্রফলের একক হচ্ছে "বর্গ একক"
অর্থাৎ, কোন ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল ৩৫ বর্গ মিটার বলতে বোঝায়, ঐ ক্ষেত্রকে ৩৫ টি বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত করা যায়, যেখানে প্রত্যেকটি বর্গের ক্ষেত্রফল "১ বর্গ মিটার" বা, "একক বর্গ মিটার"

আয়তন কি?

ইহা "ত্রিমাত্রিক" একটা কিছু! যার মাত্রা "তিন"
ত্রিমাত্রিক যেকোন বস্তুর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা থাকে। যার কারনে ত্রিমাত্রিক বস্তুর মাত্রা তিন।
আয়তন বুঝতে হলে প্রথমেই "ঘনক" সম্বন্ধে ভালো ধারনা থাকা দরকার।
ঘনক কি? যে ত্রিমাত্রিক বস্তুর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা একই তাকে ঘনক বলে।
অর্থাৎ, ঘনকের শর্ত হচ্ছে দৈর্ঘ্য=প্রস্থ=উচ্চতা।
ক্ষেত্রফল বুঝে ফেললে আয়তন বুঝতেও সময় লাগবে না! কারণ, ক্ষেত্রফল বের করার সময় আমরা একটি ক্ষেত্রের ভেতর কতগুলা "একক বর্গক্ষেত্র" আছে তা গুনেছিলাম। এইবার, একটি ঘনবস্তুর ভেতর কতগুলা "একক ঘনক" রয়েছে তা বের করতে পারলেই আয়তন বের করা হয়ে যাবে! এখানে, 'একক ঘনক' হচ্ছে সেই ঘনক, যার দৈর্ঘ্য=প্রস্থ=উচ্চতা=১ একক। এবার তাহলে একটা উদাহরণ দেয়া যাক।
আমরা প্রায় সবাই-ই "রুবিক'স কিউব"-এর সাথে পরিচিত। যারা পরিচিত নই, তারা ডানের ছবিটি দেখলেই মুহূর্তের মধ্যেই "রুবিক'স কিউব" চিনে যাবো! আমরা এটা নিয়ে অনেকেই খেলা করি! এখানে এমন একটি "রুবিক'স কিউব" দেখানো হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য=প্রস্থ=উচ্চতা=৪ একক। ডানের চিত্রটি একটি 'ত্রিমাত্রিক' বা '3D' ছবি। চিত্রের ভেতরে অনেকগুলো 'ঘনক' দেখা যাচ্ছে। যারা প্রত্যেকেই 'একক ঘনক', কারণ ভেতরের ছোট ছোট ঘনকের প্রত্যেকের বাহুর দৈর্ঘ্য "১ একক". ফলে তারা সবাই "একক ঘনক". এখন, ভেতরের সকল ছোট ছোট ঘনককে এক এক করে গুনতে হবে। যতটি ঘনক পাওয়া যাবে, "রুবিক'স কিউব"-এর আয়তন হবে তত। এবার তাহলে গণনা শুরু করা যাক!
যেহেতু, ইহা একটি ত্রিমাত্রিক বা 3D ছবি, তাই সাধারণ পদ্ধতিতে এঁকে গোণা ঠিক হবে না। এক্ষেত্রে ভুলের সম্ভাবনা থাকে! তাই, আমরা "রুবিক'স কিউব"-কে কয়েকটা পৃথক পৃথক খণ্ডে ভাগ করবো যাতে আমাদের গুনতে এবং বুঝতে সুবিধা হয়। নিচের চিত্রটি ভালোভাবে লক্ষ্য করা যাকঃ

{ছবিটি বুঝতে অসুবিধা হলে ছবির উপর ক্লিক করে ফুল রেজুলেশনের ছবিটি দেখে নিন}
উপরের ছবিতে আমাদের নেয়া কিউব-কে চারটি খণ্ডে বিভক্ত করা হয়েছে। এই চারটি খণ্ড মিলে উক্ত "রুবিক'স কিউব" টি গঠন করা যায়। ছবি হতে দেখা যায়ঃ
১ম খণ্ডে ঘনক সংখ্যাঃ ২৮টি
২য় খণ্ডে ঘনক সংখ্যাঃ ২০টি
৩য় খণ্ডে ঘনক সংখ্যাঃ ১২টি
৪র্থ খণ্ডে ঘনক সংখ্যাঃ ৪টি
সুতরাং, মোট ঘনক সংখ্যা= ২৮+২০+১২+৪ = ৬৪টি।
অতএব, আমাদের নেয়া "রুবিক'স কিউব" এর আয়তন = ৬৪ ঘন একক। আয়তনের একক "ঘন একক" কেন?- তা একটু পরে বলছি।
এবার একটু লক্ষ্য করা যাক! আমাদের নেয়া "রুবিক'স কিউব" এর আয়তন ৬৪ ঘন একক। আবার, এই ৬৪ হচ্ছে তিনটি ৪ এর গুণফল। মানে, ৬৪=৪x৪x৪=দৈর্ঘ্যxপ্রস্থxউচ্চতা
ঘনকের ক্ষেত্রে দৈর্ঘ্য=প্রস্থ=উচ্চতা হওয়ায়, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতার প্রত্যেককে বাহু বলে বিবেচনা করা যায়। তাহলে, ঘনকের আয়তন=দৈর্ঘ্যxপ্রস্থxউচ্চতা=বাহুxবাহুxবাহু=(বাহু)³

আয়তনের একক

আমরা প্রায় সবাই-ই জানি যে, আয়তনের একক হচ্ছে "ঘন একক". যেমনঃ ঘন মিটার, ঘন সেন্টিমিটার, ঘন কিলোমিটার ইত্যাদি।
কিন্তু, কেন?
যেহেতু, আয়তন বের করা মানে কোন ঘনবস্তুর ভেতরের "একক ঘনক সংখ্যা" বের করা। সেহেতু, আয়তনের একক হচ্ছে "ঘন একক"
অর্থাৎ, কোন ঘনবস্তুর আয়তন ৩৫ ঘন মিটার বলতে বোঝায়, ঐ ঘনবস্তুকে ৩৫ টি ঘনকে বিভক্ত করা যায়, যেখানে প্রত্যেকটি ঘনকের আয়তন "১ ঘন মিটার" বা, "একক ঘন মিটার"
আর তাই, আয়তনের একক হচ্ছে "ঘন একক"

বাস্তব জীবনে আয়তনের একটি উদাহরণ

বাস্তব জীবনে অনেক কাজেই আমরা আয়তন ব্যবহার করে থাকি। তন্মধ্যে একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা হলঃ
আমরা প্রায় সবাই-ই ইটের স্তুপের সাথে পরিচিত। বাড়ি বানানোর সময় অনেকগুলা ইট একটার উপর একটা রেখে ইটের স্তুপ তৈরি করা হয়। যা দেখতে একটি ঘনবস্তুর মতই। নিচে ডান পাশের ছবিতে দেখতে পারেন। এখন, এই ইটের স্তুপ থেকে মোট ইটের সংখ্যা বের করতে হলে আমাদের "আয়তন" বের করা জানতে হবে। নতুবা, সারাদিন লেগে যাবে ইট গুনতে গুনতে। এর আগে আমরা "একক ঘনক" এর মোট সংখ্যা বের করে আয়তন বের করেছিলাম। এবার আমরা একটি ইটকে "একক ঘনক" হিসেবে বিবেচনা করবো।
প্রথমত, ইটের স্তুপের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা চিত্রের মত ধরে নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, দৈর্ঘ্য বরাবর যেকোনো এক সারিতে ইটের সংখ্যা গুনতে হবে। ধরলাম, দৈর্ঘ্য বরাবর একদম উপরের সারিতে ইট সংখ্যা A
তৃতীয়ত, প্রস্থ বরাবর যেকোনো এক সারিতে ইটের সংখ্যা গুনতে হবে। ধরলাম, প্রস্থ বরাবর একদম নিচের সারিতে ইট সংখ্যা B
চতুর্থত, উচ্চতা বরাবর যেকোনো এক কলামে ইটের সংখ্যা গুনতে হবে। ধরলাম, উচ্চতা বরাবর ডান পাশের কলামে ইট সংখ্যা C
তাহলে, মোট ইট সংখ্যা = দৈর্ঘ্য বরাবর যেকোনো এক সারিতে ইটের সংখ্যা x প্রস্থ বরাবর যেকোনো এক সারিতে ইটের সংখ্যা x উচ্চতা বরাবর যেকোনো এক কলামে ইটের সংখ্যা = AxBxC
কেন এমন হল? কারণ, আমরা আগেই তো একটি ইটকে আমাদের গণনার 'একক' ধরে নিয়েছিলাম। যার ফলে, আমরা পূর্বের ন্যায় ঘনক সংখ্যা বের করার বদলে ইট সংখ্যা বের করে ফেললাম।
^উপরে যেতে ক্লিক করুন