কোন খাবারে পুষ্টিমান কত


চিকিত্সক বা পথ্যবিদদের ব্যবস্থাপত্রে খাবারের পরিমাণ সংক্রান্ত নির্দেশাবলির ক্ষেত্রে প্রায়ই লেখা থাকে ‘এক পরিবেশন’ বা ‘দুই পরিবেশন’ পরিমাণ খাবার খাওয়ার কথা। ইন্টারনেট বা ডায়েট চার্টের বিভিন্ন সাইটে ঢুঁ মারলেও চোখে পড়ে সবজি ‘টু সার্ভিং’ বা ‘ওয়ান সার্ভিং’। ডায়াবেটিস বা ক্রনিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের খাবারের তালিকাতেও প্রায়ই দেখা যায় ‘ফুড এক্সচেঞ্জ’, ‘পরিবেশন’ বা ‘সার্ভিং’ সংক্রান্ত নির্দেশনা।
এ ধরনের শব্দাবলি বা পরিমাণের উল্লেখ অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের জন্য কিছুটা বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যারা ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে ডায়েট চার্ট সংগ্রহ করে তা অনুসরণের চেষ্টা করেন, তাদের জন্য ‘ফুড এক্সচেঞ্জ’ বা ‘সার্ভিং’-এর অর্থ অনেক সময়ই অজানা বা অধরা থেকে যায়।
পুষ্টিবিজ্ঞানে ‘ফুড এক্সচেঞ্জ’-এর সহজ অর্থ হলো ‘খাবারের বদল’ বা ‘বদলি খাবার’। খাদ্য তালিকার যে কোনো একটি খাবার থেকে যে পরিমাণ ক্যালরি, ফ্যাট, প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়, তার কাছাকাছি বা সমপরিমাণের পুষ্টিগুণ অন্য যে খাবার থেকে পাওয়া যায়, সেই বদলি খাবারকেই বলা হয়ে থাকে ‘ফুড এক্সচেঞ্জ’।
সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে প্রতিটি মানুষেরই প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের খাবার একটি নির্দিষ্ট পরিমাপে বা পরিমাণে খাওয়া প্রয়োজন। খাবারের পরিমাপ বা পরিমাণ কমবেশি হলেই শরীরে ক্যালরি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের অভাব বা আধিক্য দেখা দেয়। ফলে দেখা দেয় অপুষ্টি বা ওজনাধিক্য।
পুষ্টিবিজ্ঞানে খাবারকে মূলত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগ থেকে প্রতিদিন একজন মানুষের কী পরিমাণ খাবারের প্রয়োজন, তারও হিসাব করা আছে। সে হিসেবে প্রতিটি খাবারের ভাগ বা ধরন থেকে আন্তর্জাতিকভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার গ্রহণের নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি খাবারের ধরনের জন্য নির্ধারণ করা পরিমাপকেই বলা হয়ে থাকে ‘সার্ভিং’ বা পরিবেশন।
যেমন এক ‘সার্ভিং’ ভাত বলতে বোঝায় আধা কাপ ভাত। আধা কাপ ভাতের সমপরিমাণ পুষ্টিগুণ পাওয়া যায় এক স্লাইস পাউরুটিতে। ধরুন, কোনো চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্রে দুপুরের খাবারে মাছ বা মাংসের পরিমাণ লেখা রয়েছে এক ‘সার্ভিং’, তবে সহজ ভাষায় তার মানে দাঁড়াবে—দুপুরের খাবারে ৫০-৬০ গ্রাম পরিমাণ মাছ বা মাংস খেতে হবে। অথবা এর বদলে খাওয়া যেতে পারে দুটি ডিম, প্রোটিন হিসেবে যার পুষ্টিমূল্য তার কাছাকাছি।
খাবারকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট। তবে পুষ্টি উপাদানের ওপর ভিত্তি করে মূল এই তিন ধরনের খাবারকে আরও ছোট ছোট নয়টি ভাগে ভাগ করা হয়।
পুষ্টিবিজ্ঞানে বলা হয়ে থাকে, সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকতে হলে প্রতিদিন প্রত্যেক মানুষেরই উচিত এই নয় ভাগ খাবারের ধরন থেকে খাদ্য গ্রহণ করা।
খাবারের ভাগ ও পুষ্টি উপাদান
১. শস্যজাতীয় খাবার
ভাত, গম, যব, বার্লি, মুড়ি, চিড়া, ময়দা, আটা, ভুট্টা, খই ইত্যাদি মূলত শক্তি জোগায়। এছাড়া কিছু প্রোটিন, সামান্য ফ্যাট, ভিটামিন-বি১, বি২, ফলিক অ্যাসিড ও খাদ্যের আঁশ পাওয়া যায়।
২. ডাল ও বীজ জাতীয় খাবার
মসুর, মটর, অড়হর, মাষকলাই, ছোলা, মুগ ইত্যাদি ডাল ও শিমের দানা, কুমড়ার দানা, রাজমা (কিডনি বিন) ইত্যাদি। উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের ভালো উত্স। এর সঙ্গে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন-বি পাওয়া যায়।
৩. শাকজাতীয় খাবার
পালং, পুঁই, কলমি, সজনে, লালশাক, মেথিজাতীয় দেশি শাকপাতা, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা, লেটুস, বাঁধাকপি ইত্যাদি। পাওয়া যায়—ক্যারোটিন, ভিটামিন-বি২, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম, রিবোফ্লাবিন, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই ও ভিটামিন-কে।
৪. অন্যান্য সবজি
গাজর, বেগুন, ঢেঁড়শ, ক্যাপসিকাম, পটোল, শালগম, মুলা, ফুলকপি, ব্রুকলি, কুমড়া ইত্যাদি। পাওয়া যায়—ভিটামিন-এ, ভিটামিন-ই ও ভিটামিন-কে’র উত্স। কয়েক ধরনের মিনারেলও পাওয়া যায়।
৫. ফল ও ফলজাতীয় খাবার
আম, জাম, পেয়ারা, পেঁপে, লেবু, কমলা, টমেটো, আমলকী, তরমুজ, বাঙ্গি, ফুটি, কাঁঠাল, জামরুল ইত্যাদি। এসবে আছে প্রায় সব ধরনের ভিটামিন ও মিনারেলের সমারোহ।
৬. দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
দুধ, পনির, ছানা, দই, দুধের তৈরি খাবার যেমন পায়েশ, সেমাই ইত্যাদি। প্রোটিন, ফ্যাট, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-এর উত্স।
৭. প্রাণিজ প্রোটিন
মুরগি, গরু, খাসি, ডিম, কলিজা, মিঠা পানির ও সমুদ্রের মাছ, পায়া ইত্যাদি। প্রাণিজ প্রোটিনের সবচেয়ে ভালো উত্স। পাশাপাশি জিঙ্ক, ম্যাগনেশিয়াম এবং আয়রনও পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে।
৮. ফ্যাটজাতীয় খাবার
মাখন, ঘি, বাটার অয়েল, সয়াবিন তেল, সরষের তেল, জলপাই তেল, তিলের তেল ইত্যাদি। শক্তিবর্ধক। ভিটামিন-এ, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-ডি ও ভিটামিন-কে পাওয়া যায়।
৯. চিনি ও মধুজাতীয় খাবার
চিনি, মধু ও গুড় ইত্যাদি। মূলত শক্তি পাওয়া যায়। তবে গুড় ও মধু কিছু মিনারেলেরও উত্স।
উপরের এই খাবারের ভাগগুলো থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু ‘সার্ভিং’ বা ‘পরিবেশন’ খাবার গ্রহণ করা উচিত আমাদের সবার।
১. যেমন শস্যজাতীয় খাবার সারা দিনে ৬ থেকে ১০ সার্ভিংয়ের বেশি গ্রহণ করা ঠিক নয়। শস্যজাতীয় খাবারের ক্ষেত্রে এক সার্ভিং ভাতের পরিমাণ বলতে আধা কাপ ভাত বোঝায়।
২. ডাল ও বীজজাতীয় খাবার দিনে অন্তত দুই সার্ভিং নেয়া আবশ্যক। এক সার্ভিং পরিমাণ বলতে এক কাপ মাঝারি ঘন ডালকে বোঝায়।
৩. আধা কাপ রান্না করা শাক মানে এক সার্ভিং। প্রতিদিন এক ব্যক্তির দুই সার্ভিং, অর্থাত্ এক কাপ রান্না করা শাক বা পাতাজাতীয় খাবার গ্রহণ করা জরুরি।
৪. সুস্থ ও কর্মক্ষম মানুষের জন্য অন্যান্য সবজিও দিনে অন্তত দুই সার্ভিং খাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
৫. মাছ, মাংস, ফল, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারের ভাগ থেকেও প্রতিদিন দুই সার্ভিং করে খাওয়ার নিয়ম রয়েছে। ৫০-৬০ গ্রাম ওজনের মাছ বা মাংস হলো এক সার্ভিং। ছোট একটা আপেল বা কমলা বা অর্ধেকটা আম বলতে এক সার্ভিং বোঝায়। দুই সার্ভিং দুধ বা দুগ্ধজাত খাবারের চাহিদা পূরণ হয় দুই কাপ দুধ বা দই থেকে।
৬. ফ্যাট আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি দরকারি পুষ্টি উপাদান। দিনে তিন থেকে চার সার্ভিংয়ের সমপরিমাণ ফ্যাট আমাদের প্রয়োজন। এক সার্ভিং ফ্যাটের চাহিদা ১৫ গ্রাম কাঠবাদাম বা দুই চা-চামচ পরিমাণ তেল থেকেই পূরণ করা সম্ভব।
৭. চিনি, গুড় বা মধু আলাদাভাবে খুব বেশি প্রয়োজন নেই। রান্না বা বিভিন্ন খাবারে ব্যবহৃত পরিমাণ থেকেই তা পূরণ হয়ে যায়। মনে রাখা দরকার, সারা দিনে এক থেকে দেড় চামচ পরিমাণ চিনি বা গুড় আমাদের এক দিনের চাহিদা খুব ভালোভাবে পূরণ করতে পারে।

ভিটামিন ‘এ’

ভিটামিন ‘এ’
ভিটামিন ‘এ’
লিভার ও যকৃত খেলে রাতকানা রোগ সারে। এটা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের প্রাচীন মিশরীয় কথা। আসলে লিভার ও যকৃতে থাকে ভিটামিন ‘এ’ যা কয়েকটি ভিটামিনের সমষ্টি। ভিটামিন ‘এ’ দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে ও দেহের গঠনে কাজ করে। ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে বাচ্চাদের রাতকানা অথবা অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে।
কোথায় পাবেন ভিটামিন ‘এ’ ?

ক)  দুগ্ধজাত খাবারে।
খ)  মাছ ও ডিমে।
গ)  অরেঞ্জ চিগিমেনট বেটা ক্যারোটিন জাতীয় প্রোভিটামিন শরীরে ভিটামিন ‘এ’ তে পরিবর্তিত হতে পারে।
ঘ)  গাজর ।

ভিটামিন ‘বি’

 ভিটামিন ‘বি’
ভিটামিন ‘বি’
ভিটামিন ‘বি’ আসলে অনেক গুলো ‘বি’ ভিটামিনের সমন্বয়, যাকে আমরা ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স বলতে পারি। ‘বি’ গুলো হচ্ছে বি১, বি২, বি৩,বি৪, বি৬, বি৭, বি৯,বি১২। এগুলো সবই ‘বি’ ভিটামিনের মধ্যে পড়ে। মানবদেহের অত্যন্ত জরুরী কিছু ফাংশন নিয়ন্ত্রণে ভিটামিন ‘বি’ গুরুত্বপূর্ণ। দেহের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান এই বি ভিটামিন।
প্রতিদিনই আমাদের এই ভিটামিন ‘বি’ এর প্রয়োজন। যা আমরা পেয়ে থাকি আমাদের খাদ্য তালিকার বিভিন্ন খাবার থেকে।
এবার আমরা বিভিন্ন ভিটামিনের উৎস ও প্রয়োজন সমন্ধে আলোচনা করবো-

ভিটামিন বি১(থায়ামিন)

ভিটামিন বি১ পেশী স্নায়ুকে শক্তিশালী করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। নিউরোপ্যাথিক পেইন তৈরি হবার কারণ গুলোর মধ্যে ভিটামিন বি১ এর ঘাটতি অন্যতম।
উৎসঃ  সব ধরনের খাদ্য শস্যে ভিটামিন বি১ পাওয়া যায়। এছাড়া ডিমেও ভিটামিন বি১ আছে।

ভিটামিন বি২(রিবোফ্লাভিন)

ত্বক সুস্থ্য রাখতে, চোখ ও স্নায়ুতন্ত্র ভাল রাখতে ভিটামিন বি২ কাজ করে। ভিটামিন বি২ এর অভাবে মুখে এক ধরনের ক্ষত এর সৃষ্টি হয়।
উৎসঃ  দুগ্ধজাত খাবার, চাল ও ডিমে বি২ আছে।

ভিটামিন বি৩ (নিয়ামিনামাইড)

কাজঃ
»» হজমে সাহায্য করে।
»» স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বাঁড়ায়।
»» এর ঘাটতি ডায়রিয়ার সৃষ্টি করে। ত্বকে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। বি৩ এর অভাবে পেলাগ্রা নামক অপুষ্টি রোগ হতে পারে। এতে ত্বকে চিড় ধরে এবং মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে।

ভিটামিন বি৫ (পেনটোথেনিক এসিড)

► শিশুদের স্বাভাবিক বেড়ে উঠা এবং দেহের সঠিক গঠনে সাহায্য করে।
উৎসঃ  গোল আলু, ডিম, টমেটো।
বি৬ (পাইরিডক্সিন)
হোমোসিসটিন এর মাত্রা কমাতে পারে। যা ক্ষতিকর এক ধরনের অ্যামাইনো এসিড। এবং এটি হৃদ রোগের অন্যতম কারণ।
উৎসঃ  মাছ, লিভার ও গোল আলু।
বি৭ (বায়োটিন)
শরীরের নানা শারীরবৃত্তীয় কাজে হরমোন অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। এই হরমোন সৃষ্টিতে সহায়তা করে বি৭ বা বায়োটিন।
উৎসঃ  চীনাবাদাম, লিভার, কলা।
বি১২ (মিকোবালামিন)
হিমোগ্লোবিন তৈরিতে ও ডি এন এ সিন্থেসিস এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
উৎসঃ  গোশত, মাছ, ডিম, দুগ্ধজাত যে কোন খাবার।

ভিটামিন ‘সি’

ভিটামিন 'সি'
ভিটামিন ‘সি’
এটি ওয়াটার সলুবল ভিটামিন। যা খুব দ্রুত শরীর থেকে বেড়িয়ে যায়।
প্রয়োজনীয়তাঃ
১) ফলাজেন নামক প্রোটিন তৈরি করে, যা ক্ষত সারিয়ে তুলতে কাজ করে।
২)  দাঁতের মাড়ির রক্ত ঝরার প্রবণতা কমাতে পারে।
৩)  ঠাণ্ডার প্রকোপ কমায়।
৪)  ক্যান্সার সারিয়ে তুলতে ভিটামিন সি এর ভূমিকা রয়েছে।
৫)  শরীরে ‘ফ্রি রেডিকেল’ এর পরিমাণ কমায়।

ভিটামিন ‘ই’

ভিটামিন ‘ই’
ভিটামিন ‘ই’
১)  রক্ত জমাট বাঁধা ঠেকায়।
২)  রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৩)  অ্যান্টি অক্সিডেনট হিসেবে কাজ করে।
৪)  এর ঘাটতি হলে পেশী দুর্বল হয়ে পরে। দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে।
৫)  ক্যান্সার নিরাময়ে সাহায্য করে।
বিঃদ্রঃ- যেহেতু এটি ফ্যাট সলুবল ভিটামিন। তাই প্রয়োজন ছাড়া সেবন করবেন না। কেননা, মাত্রা বেশী হলে মুত্র থলির ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
উৎসঃ
১) অন্যতম হচ্ছে ভেজিটেবল অয়েল।
২) বাদাম, বীজ।
৩) সবুজ শাকসবজি।
 
^উপরে যেতে ক্লিক করুন