আমাদের পারিবারিক বন্ধন ছিল খুবই আনন্দময়। বিশেষ করে আমি আমার মায়ের শাসন, স্নেহ এবং ভালোবাসার কোনো তুলনা পাইনা। বাবা ব্যস্ত থাকতেন রাজনীতি নিয়ে, তার মিটিং আর সাংগঠনিক কাজকর্ম নিয়ে। বেশিরভাগ সময়েই আমি তাঁকে পেয়েছি রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে। যখন আমরা তাঁকে জেলখানায় দেখতে যেতাম, তিনি আমাদেরকে ভালোবাসা ও স্নেহে আলিঙ্গন করতেন। যখন আমি খুব ছোট ছিলাম, তিনি আমাকে তার কোলে বসাতেন।
যখন আমি স্কুলের ছাত্র ছিলাম তখন অনেক খবর জানতে পেতাম, আমরা তাঁর সাথে সেগুলো নিয়ে কথা বলতাম। তিনি আমার মাথায় হাত ঘষতে ঘষতে কথা বলতেন। যদি কোনোদিন তাঁকে দেখতে না যেতাম, তিনি আমাকে চিঠি লিখতেন। বাবার অনুপস্থিতিতে আমার মা আর হাসু আপা ছিলেন আমাদের মাথার উপর ঠিক বিশাল বটবৃক্ষের মতোই সহায়। তাঁরা আমাদের সকল প্রয়োজন আর চাহিদা মেটাতেন। আমার মা আমাদের গল্প শোনাতেন। তিনি আমাদের বড় হবার সঠিক পথগুলো জানাতেন। তিনি যেন ক্ষমা ও ধৈর্য্যের এক প্রতিমা ছিলেন। আমার বোন হাসু মনে হয় মায়ের সেই গুণগুলো উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছে।
আমাদের পরিবারে একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিরাজ করতো। হাসু আপা ছায়নট থেকে ভায়োলিন বাজানো শিখেছিলেন, কামাল ভাই শিখেছিলেন সেতার, জামাল ভাই গিটার আর আমি গান এবং নাচ। আমরা বাড়িতে সবাই নানান খেলাধুলা করতাম। আমরা সাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতা চালাতাম। সবাই বাড়ির বাইরে গিয়ে সাইকেল চালাতাম। তবে হাসু আপাকে ছাদে সাইকেল চালাতে হতো। যখন বাবা-মা দুজনেই বাড়ির বাইরে যেতেন, বোন হাসু আমাদের সকলের অভিভাবক হতেন। আমরা বাড়িতে ঘর সাজাতাম, ডাইস, ছোঁয়াছুঁয়ি, ক্যারম খেলতাম। তাঁর শাসন মেনে চলতেই হতো। তাঁর শাসন মাঝে মাঝে খুবই কড়া হতো। ঈদ উৎসবে, মা এবং হাসু আপা আমাদের জামা সেলাই করে দিতেন। কখনও কখনও আত্মীয়-স্বজনের জামা-কাপড়ও সেলাই করে দিতেন। কখনও আমি হাসু আপার কাছে নতুন ডিজাইনের ফ্রকের জন্য আবদার করতাম। তার জন্য, আমি তাকে চা আর কফি অফার করতাম। যতক্ষণ সেলাই শেষ না হতো, আমার তাঁকে সেটা চালিয়ে যেতে হত। সেলাইও শেষ, আমার সেবাও শেষ। আত্মীয়-স্বজনের পাশাপাশি, দলের নেতাকর্মী আর জনগণের ভীড় আমাদের বাসায় লেগেই থাকতো। তবে যখনই কঠিন সময় আসতো, চারিদিকে শূন্যতা বিরাজ করতো। যখন আমাদের বাবা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন আর তাঁর কোনো খবর কোনো পত্রিকায় আসা বন্ধ ছিলো, তখন মা আর হাসু আপাই আমাদের দেখাশুনা করতেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাতে বাবা আমাকে হাসু আপার সাথে বাসায় পাঠালেন। পরবর্তীতে আমি মায়ের সাথে মগবাজারে এক আত্মীয়ের বাসায় থাকি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে আমরা বাবার চিন্তায় দিন কাঁটাতাম। আমাদেরকে গ্রেফতার করে ধানমণ্ডির ১৮ নাম্বার রোডের একটি বাড়িতে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যবহার খুবই খারাপ ছিল। আমাদের খাবারের জন্যও কষ্ট করতে হয়েছে। হাসু আপা তাঁর ছেলে জয়ের জন্ম দিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। মাকে একবারের জন্যও তাঁকে দেখতে যেতে দেয়া হয়নি। তিনি সারাক্ষণ কাঁদছিলেন। আর্মি অফিসার জিজ্ঞেস করছিল- আপনি কি ডাক্তার? ওখানে আপনারা কী করবেন? মা উত্তর দিয়েছিলেন, আমি মা। কামাল ভাই এবং জামাল ভাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন। রাসেল আর আমিই মায়ের সাথে বাড়িতে রইলাম। যখন হাসু আপা তাঁর শিশুপুত্র জয়কে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন, আমাদের খুশি আর বাধ মানে না। আমার স্মৃতিতে আজও ভাস্বর সেই মনোমুগ্ধকর মুহূর্তটি যখন মা জয়কে কোলে নিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের জুলাইতে যখন কামাল ভাই আর জামাল ভাইয়ের বিয়ে হয়, আমরা প্রচুর আনন্দ করেছিলাম। তখন আমি উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী। আগস্টের প্রথম দিকে হাসু আপা তার ছেলেকে নিয়ে আমাদের দুলাভাইয়ের সাথে জার্মানী যাবে। বাবা আর মা আমাকেও তাদের সাথে পাঠালেন। আমি মোটেও যেতে আগ্রহী ছিলাম না। দুটো সন্তান নিয়ে বোন হাসুর অনেক কষ্ট হবে তাই মা আমাকে তাঁদের সাথে যেতে বললেন। যখন বিদায় নিতে যাবো, মা কাঁদছিলেন। আমি প্লেনে চড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রাসেল আমার হাতটা ধরেছিল। সেদিন সকলেই এসেছিল। আমি অনেক বিমর্ষ ছিলাম কারণ আমাকে এখানে বাবা আর মা'কে রেখে যেতে হচ্ছে। যাহোক, তারপর আমরা জার্মানী চলে গেলাম সেখানে থাকতে লাগলাম। আমরা পার্শ্ববর্তী দেশের শহরগুলোতেও ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আমরা ১৩ই আগস্টে বাবা-মায়ের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছিলাম। আমি বাড়িতে ফিরে আসার জন্য কান্নাকাটি করছিলাম। বাবা বললেন, আমি ওদের বলবো যাতে তুমি তাড়াতাড়ি ফিরতে পারো।
যখন আমরা ১৫ই আগস্টের হৃদয় বিদারক ঘটনার কথা জানতে পাই, আমরা সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কিভাবে এমন নিষ্ঠুরতা ঘটলো? যদিও আমার বাবা রাজনীতি করতেন, কিন্তু আমার মা, ছোট্ট রাসেল, ভাই-ভাবীরা তো রাজনীতি করতেন না। তাহলে কেনো তাদেরকে হত্যা করা হলো? আমি হাসু আপাকে ধরে ছিলাম আর আমরা দুই বোন অনেক সময় ধরে কাঁদছিলাম। একজন আরেকজনকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করেছি। একজন আরেকজনের চোখ মুছে দিয়েছি। আমি হাসু আপাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারছিলাম না। তিনি আমার চোখ মুছে দিতেন আর খাইয়ে দিতেন। এমনটা চলছিল অনেকদিন ধরেই! বাবা-মা আর ভাইদের হারাবার পর হাসু আপাই আমার অভিভাবক হয়ে গেলেন হলেন আমার আশ্রয়। পড়াশুনা শেষ হলো; আমি এক অসহায় এতিমের জীবনে প্রবেশ করলাম। হাসু আপা না থাকলে আমাকে টিকে থাকতে অনেক সংগ্রাম করতে হতো। প্রিয় হাসু আপা আমাকে ভালোবাসা দিয়ে, স্নেহ দিয়ে একজন বাবার মতো, একজন মায়ের মতো আমাকে এখনও পর্যন্ত দেখে রাখেন।
ছেলেবেলা থেকেই আমি হাসু আপাকে দেখে আসছি আমাদের মাঝে এক অগ্রপথিক হিসেবে। আমাদের পরিবারের ঐক্যবন্ধনটি ছিল গভীর অনুভূতির। মা আর হাসু আপা ছিল আমাদের ঘরের সেরা আকর্ষণ। বাবার রাজনীতি, ঝোঁক এবং আদর্শের প্রতি আমাদের ছিল অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। ছাত্রজীবনের স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে হাসু আপা ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।
১৫ই আগস্টের পর তাঁর শক্ত হয়ে দাঁড়াতে বেশ অনেকটাই সময় লাগে। আমি ১৯৭৬ সালে লন্ডনে গেলাম। লন্ডনে ১৯৭৭ সালের জুলাইতে আমার বিয়ের সময় হাসু আপা কেবলই একটি টিকেটের জন্য আসতে পারেননি। এটা আমার জীবনের একটি বড় দু:খ। নিজেকে শান্ত করেছিলাম এই ভেবে, হাসু আপাও তাঁর বিয়েতে বাবাকে পাননি। তাই মা অনেক ইচ্ছা করেছিলেন যে আমার বিয়েটা অনেক জাঁকজমকপূর্ণ হবে এবং অনেক আনন্দময় একটা অনুষ্ঠান হবে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, তাঁদের দুজনের কেউই উপস্থিত থাকতে পারেননি। আমার তিন সন্তানের জন্মের সময়, হাসু আপা আমার সাথে থেকে মায়ের শূন্যতা পূরণ করেছিলেন। যখন আমার স্বামী প্রবল অসুস্থ্য হয়ে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে ভর্তি হন সেই ১৯৯১ সালে, আমার হাসু আপা দলের সব কাজ ফেলে আমার কাছে ছুঁটে গিয়েছিলেন। তিনি (আপা), তার (আমার স্বামী) সব দেখভাল করেন এবং দ্রুত সুস্থ্য করে তোলেন। তিনি আমার এবং আমার সন্তানদের পাশে একজন মায়ের মতো পাশে দাঁড়ান এবং আমাদের উৎসাহ দেন।
১৯৮০ সালে হাসু আপা লন্ডনে আসলেন। সেখানে তিনি পঁচাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবী তোলেন এবং স্টেজে বক্তৃতা দেন। ১৯৮১ সালে দিল্লীতে, সিদ্ধান্ত নেয়া হয় হাসু আপা রাজনীতিতে প্রবেশ করবেন, তখন আমি তাঁকে উৎসাহ দেই এবং জয় আর পুতুলের দায়িত্ব নেই আর তাঁকে বলি, "দেশ ও জাতির ভালোর জন্য আপনার(তোমার) রাজনীতিতে অবশ্যই যাওয়া উচিৎ, আমি তাদের দেখাশোনা করবো"। আমি জয় আর পুতুলকে আমার তিন সন্তান ববি, টিউলিপ আর রুপন্তীর সাথে একসাথে আমার পাঁচটি সন্তানের মতোই দেখতাম। হাসু আপা দেশে ফিরলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে এবং জোরালোভাবেই রাজনীতি শুরু করলেন। তারপর প্রলম্বিত ধারাবাহিক আন্দোলন, মিছিল চলে একের পর এক, তিনি দু'বার প্রধানমন্ত্রীও হন, আবার ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় এক বছর কারাবন্দী জীবন কাঁটান। আমি কখনোই বিশ্রাম বা শান্তি পাইনি। যখন উনাকে জেলে নেয়া হয়, নানান লোক নানান কথা বলে চলছিল। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস আছে, আল্লাহর উপর বিশ্বাস ছিল আর আছে দেশবাসীর প্রতি আস্থা, আমরা জ্ঞানত এমন কোনো অন্যায় করিনি। বিচার আমরা নিশ্চয়ই পাবো। আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতে বলেছিলাম — হাসু আপাকে অবশ্যই তার যথাযোগ্য মর্যাদা এবং সম্মানের সাথে মুক্তি দিতে হবে।
হাসু আপা পঁচাত্তরের সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দু:সহ স্মৃতি এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেন না। অনেক উদ্বেগ, আশংকা ছিল। তবে আমরা সবসময়ই তাঁকে সমর্থন জানাই তাঁর সকল বলিষ্ঠ ও জনহিতকর কাজে। যদিও আমি তাঁর অনেক ছোট, আমি তার ভুল বা দোষগুলো অনেক সময়ই ধরিয়ে দেই। হাসু আপা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন কেবলই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তথা জাতির জন্মদাতা ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে।
সেই স্বপ্নটি হচ্ছে — বাংলার প্রতিটি মানুষের জন্য আধুনিকতম জীবনযাপন নিশ্চিত করা। জাতি হিসেবে বাঙালি সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মানে বিশ্বে এক আদর্শ জাতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হবে। আমরা সকলেই বিশ্বাস করি সেই স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই।
আমি সবসময়ই আল্লাহর কাছে দোয়া করি হাসু আপা যেনো তার উপরে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যেতে পারেন, যদি এমনকি তাতে তার জীবন সংশয়ও ঘটে, তবুও। আমাদের মনে তো আর কোনো বড় অভিলাষ নেই কেবলই দেশ ও দশের জন্য কাজ করে যাওয়া ছাড়া।
(শেখ রেহানা প্রবন্ধটি লিখেছেন ২০১১/১২ সালে)