প্রসঙ্গ বাঙালী বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ


আমরা হিন্দু-মুসলমান যেমন সত্য,তার চেয়ে বেশী সত্য যে আমরা বাঙালী। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা-প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙালীর এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে এবং টুপি-লুঙ্গিতে দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই। … ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
তুমি কে আমি কে! বাঙালী বাঙালী… শ্লোগানটা ১৯৭১ সালের। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগের উত্তাল কয়েকটি মাসে বাঙালী এভাবেই জানান দিয়েছিলো তার আত্মপরিচয়ের। এই পরিচয়েই সে পরিচিত হতে চাইছিলো। সে তার বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য এর আগে রক্ত দিয়েছে। এরপর রক্তপণ করেছে তার বাঙালীয়ানার জন্য স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের, বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন ভুখন্ডের প্রতিষ্ঠার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার বেসিক এবং মন্ত্রগুপ্তিই এই বাঙালী জাতীয়তাবাদ।

সেটা হঠাৎ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে রূপ নিলো কেনো সেটা নিয়ে অনেকের কৌতুহূল এবং একে জাস্টিফাই করার জন্য তাদের হাতে যুক্তিও প্রচুর। এ ব্যাপারে সহায়ক হতে পারে মুক্তিযুদ্ধকালে নির্দিষ্ট করে বললে ৬ জুন গোলাম আযমের একটা বিবৃতি, যাতে বলা হয়েছে,জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের বদলে বাঙালী জাতীয়তাবাদ মেনে নিতে রাজী নয়। এবং এর প্রেক্ষিতে তার যুক্তি ছিলো ‘কোনো বিদেশী শাসকের শাসন আজাদির (স্বাধীনতার) পরিপন্থী নয়, ইসলামে এর বিরুদ্ধে কোনো নির্দেশনা নেই।’ অর্থাৎ ভিনদেশের দালালী এবং অধীনতাও কিনা ইসলাম সম্মত।সেই সময়টায় স্বাধীনতাবিরোধীরা এই বাঙালী গণজাগরণের বিরুদ্ধে ধর্মকে দাড় করিয়ে দিয়েছিলো। ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ শেখ মুজিব ও শ্রী তাজউদ্দিনের নিজস্ব সৃষ্টি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এর সমর্থক নয়’ ইত্যাদি বয়ানসহকারে তাতে বোঝাতে চাইছিলো জয় বাংলা হলো জয় হিন্দের মতো একটা শ্লোগান। বাঙালী হলো পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা, আর তারাই এই দেশটাকে ভেঙে বাংলাদেশ বানাতে চাইছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রেডিওতে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ সম্বোধন করে এই হত্যাকান্ডের পক্ষে সাফাই দিয়েছিলো খুনীরা (মেজর শরিফুল ইসলাম ডালিম)। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। খন্দকার মোশতাক আহমেদ তার ৮৩ দিনের শাসনকালে মুক্তিযুদ্ধের চারটা স্তম্ভের উপর হাত দিতে সাহস পাননি। ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্সে (যেখানে বঙ্গবন্ধুর সেই কালজয়ী ভাষণ এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পন এবং যেখানে এখন শিশুপার্ক) দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ডাকা এক ইসলামী মাহফিলে শ্লোগান উঠেছিল সব বদলের। চাঁনতারা পতাকা চাই এবং হিন্দু কবির লেখা জাতীয় সঙ্গীত চলবে না। শকুনের দোয়ায় গরুটা না মরলেও ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে নিয়ে এলেন। বাঙালীকে দুইভাগ করে দিলেন ধর্মের ভিত্তিতে। পশ্চিমবঙ্গেও বাঙালী আছে এই কুযুক্তিতে। এবং তালিকায় যুক্ত করলেন আদিবাসী উপজাতিদের।এটা আদি মুসলিম বাংলা ও তার সমর্থকদের পুরানো যুক্তি। প্রশ্ন উঠতেই পারে এর বিপক্ষে কি বলা যায় কিংবা ইনবক্সে এক ছোটভাই যেমন প্রশ্ন তুললো, বঙ্গবন্ধু কোন প্রেক্ষিতে আদিবাসীদের বাঙালী হয়ে যেতে বলেছিলেন?
উত্তর দেয়ার আগে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল তাত্বিক স্বাধীনতাবিরোধী খন্দকার আবদুল হামিদের (১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল টিক্কাখানের সঙ্গে বৈঠকে গোলাম আযমকে নিয়ে গিয়েছিলো যে) বক্তব্যটা জেনে রাখা জরুরী। ‘আমাদের জাতীয়তাকে বাংলাদেশী জাতীয়তা বলাই এপ্রোপ্রিয়েট বা সঙ্গত। … এই জাতির রয়েছে গৌরবময় নাম-নিশানা, ওয়ারিসি-উত্তরাধিকার, ঐতিহ্য-ইতিহাস,ঈমান-আমান,যবান-লিসান, শিল্প-সাহিত্য-স্থাপত্য-সঙ্গীত সবকিছু।… এদের (বাংলাদেশের মানুষের) জীবনে ও মনোজগতে রয়েছে অসংখ্য বৈশিষ্ট্য যা সারা পৃথিবী থেকে এদের স্বাতন্ত্র দান করেছে-এমনকি অন্যান্য দেশের বা অঞ্চলের বাংলাভাষী এবং ইসলাম অনুসারীদের থেকেও। ওই বৈশিষ্টটুকুই বাংলাদেশী জাতীয়তার উপাদান। এগুলো বাকল নয়, আসল সারাংশ।আর এই সারাংশই বাংলাদেশী জাতীয়তার আসল শক্তি, ভিত্তি ও বুনিয়াদ।’
তাহলেই জানতেই হয় বঙ্গবন্ধু তার বাঙালী জাতীয়তাবাদের পক্ষে কি বলেছিলেন, কি যুক্তি ছিলো তার। তার ভাষায়.
‘জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালী জাতি ঝাপিয়ে পড়েছিলো চরম মরণপন সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ না হলে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই মূল নীতির উপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। জাতীয়তাবাদের অনেক সংজ্ঞা আছে। অনেক ঋষি, অনেক মনিষী, অনেক বুদ্ধিজীবি, অনেক শিক্ষাবিদ এ সম্পর্কে অনেকরকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। সুতরাং এ সম্পর্কে আমি নতুন কোনো সংজ্ঞা আর নাই বা দিলাম।আমি শুধু বলতে পারি, আমি যে বাংলাদেশের মানুষ, আমি একটা জাতি। এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন, সকলের সাথে একটা জিনিস রয়েছে সেটি হচ্ছে অনুভূতি। সেই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না।অনেক জাতি আছে যারা বিভিন্ন ভাষাবলম্বী হয়েও এক জাতি হয়েছে (আমার উদাহরণ: ভারত)। অনেক দেশে আছে একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সব কিছু, কিন্তু সেখানে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে, তারা একটি জাতি হতে পারে নাই (আমার উদাহরণ: লিবিয়া, সোমালিয়াসহ আফ্রিকার কিছু দেশ যারা ধর্ম-ভাষায় এক হয়েও ট্রাইবের ভিত্তিতে বিভক্ত)। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। আজ বাঙালী জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এই সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিলো যার উপর ভিত্তি করে, এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিলো যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতিটুকু আছে বলেই আমি বাঙালী, আমার জাতীয়তাবাদ বাঙালী জাতীয়তাবাদ।’
অনুভূতিটা আরও বিষদভাবে টের পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এক স্মৃতিচারণে (১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গণপরিষদে দেওয়া ভাষণে)- ব্যক্তিগতভাবে এই চেতনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৫৯ সালে। তখন আমি পাঞ্জাব রেজিমেন্ট থেকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক হয়ে বদলি হয়ে আসি। শুধু বাঙালীদের নিয়ে গঠিত ইতিহাসের এই সর্বপ্রথম নিয়মিত ইনফ্যানট্রি রেজিমেন্টের তখন শৈশব অবস্থা। আমি প্রথম বাঙালী লে.কর্ণেল এই পল্টনে অধিনায়ক হিসেবে যোগ দিই। সৈন্যরা সেদিন আনন্দে আর গর্বে বলাবলি করেছিলো, ‘আমরা বাঙালী, বাঙালী এসেছে আমাদের অধিনায়ক হয়ে।’ তাদের সেই আনন্দধ্বনি আজও আমার কানে বাজছে।সেইদিন সেই আনন্দোল্লাসের মধ্যে আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার সত্যিকার পরিচয়। আমি জেনেছিলাম আমি কে, কী আমার জাতীয়তা, আমি কাদের মধ্যে জন্মলাভ করেছি, কারা আমার আপনজন ।’
মুক্তিযুদ্ধ ছিলো বাঙালীর সেই আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম, সেই আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সম্মান। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে যে দুইখন্ড, তাতে বাঙালী মুসলমানরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো। এই দেশ থেকে হিন্দুদের বিতাড়ন করা হয়েছে নানা সময় নানা অজুহাতে। এখনও হয়। কিন্তু তারপরও তাদের নির্মূল করা যায়নি। এমন নয় তাদের জায়গা নেই বলে। কারণটা আসলে তারা এই ভাষা এই সংস্কৃতি এই শেকড় ছেড়ে যেতে চাইনি বলে। ‘মরলে এই ভিটাই চিতা হবে আমার’ এই দৃঢ়তায় মাটি কামড়ে রয়ে গেছে। ধর্মই যে উদ্ধার নয় বরং পাকিস্তানীদের শোষনের মাধ্যম সেটা বাঙালী মুসলমান টের পেয়েছিলো ধীরে ধীরে। যখন দেখলো তাকে উৎখাত করে বিহারীদের এনে বসানো হচ্ছে তার জায়গায়। তার জমি কেড়ে নিয়ে তার ব্যবসা কেড়ে নিয়ে তাকে দেওয়া হচ্ছে। ফিলিস্তিনে ইহুদিদের ডাম্প করার পর তারা যে বিস্তার নিয়েছিলো ইসরাইল হয়ে, বিহারীদের সেভাবেই প্রতিষ্ঠা করছিলো পাকিস্তানীরা। আদর্শ পাকিস্তানি হবে তাদের মতোই এই উদাহরণ সৃষ্টি করে চাপ দেওয়া হচ্ছিলো বাঙালীদের উপর। এই দেশের মুসলমানরা টের পেলো তার বাঙালী পরিচয়টা বিপন্ন। এবং বৈষম্য, বঞ্চনা ও অত্যাচারের কারণও। তাকে বাঙালী পরিচয় ভুলে পাকিস্তানী হয়ে যেতে হলে সব ত্যাগ করতে হবে, তার আচার কৃষ্টি সংস্কৃতি সব। এবং রক্তের দামে আনা ভাষাটাও। সেই বিপন্ন সময়ে সে গর্জে উঠলো, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, তুমি কে আমি কে, বাঙালী বাঙালী।’
ইংরেজরাও ইংরেজি বলে। আমেরিকানরাও বলে। কিন্তু দুইটা দুই দেশ। বাংলাদেশের বাঙালীরাও বাংলা বলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরারও বাঙালী বলে। কিন্তু তারা ভারতীয় বলে পরিচয় দেয় নিজেদের। একাত্তরে তারা আমাদের সর্বস্ব দিয়ে সহায়তা করেছে আমরা বাঙালী বলে, কিন্তু কস্মিনকালেও তারা পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আমাদের সঙ্গে এক হতে চায়নি। এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধও সেই লক্ষ্যে পরিচালিত হয়নি। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের যেমন সীমানা নেই, সে ভারতে গেলেও রয়েল বেঙ্গল টাইগারই থাকে, সুন্দরবনের এপারেও তাই। পশ্চিমবঙ্গের জন্য আমাদের যদি বাঙালী থেকে বাংলাদেশী হয়ে যেতে হয়, তাহলে তো এখন বাংলাদেশী ভাষাও বানাতে হয় একটা।
ফিরে আসি উপজাতি প্রশ্নে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তাদের কতখানি সহায়? পার্বত্য চট্টগ্রামে কোথাও সংঘর্ষে কখনও কি পত্রিকায় লেখা হয়েছে শুধু সংঘর্ষ? লেখা হয়েছে বাঙালী-পাহাড়ি সংঘর্ষ, বাঙালী চাকমা সংঘর্ষ, দুইদল বাংলাদেশীর সংঘর্ষ না। যেই বাঙালী জাতীয়তাবাদকে ডিনাউন্স করে আপনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে আকড়ে ধরলেন, সেই আপনিই কিন্তু তখন তাদের পাহাড়ি কিংবা চাকমা বলে অবজ্ঞা করছেন, পক্ষ নিচ্ছেন বাঙালীর। তাহলে দাড়ালো কি ব্যাপারটা!বরং ১৯৭৯ সালরে পাহাড়ে যে আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদের সূচনা জিয়া করেছিলেন তাকে লেজিটিমেসি দিতেই আনা হয়েছিলো ওই বাংলাদেশী জাতীয়বাদ। এক ঢিলে দুই পাখী মারতে। ১৯৭৯ সালের আগেও পাহাড়ে বাঙালী ছিলো, ২.০৫ ভাগ থেকে রাতারাতি এক বছরে সেটা দাড়ায় ২৭.০৫ ভাগ। এরপর সংখ্যাটা বাড়তেই থাকে।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু আদিবাসীদের যে অর্থে বাঙালী হয়ে যেতে আহবান জানিয়েছিলেন সেটারও ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এখানে মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সাংসদদের গণশপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু একই আহবান জানিয়েছিলেন এই দেশে বসবাসরত বিহারী ও অবাঙ্গালীদের প্রতিও। তাদের বলেছিলেন আপনারা বাঙালী হয়ে যান, নিজেদের পাকিস্তানীদের মতো না ভেবে মিশে যান এ দেশের মানুষের সঙ্গে। এই মাটিকে আপন ভাবতে শিখুন, এই দেশের মানুষকে আপন ভাবতে শিখুন। তারাও আপনাদের আপন করে নেবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজা ত্রিদিব রায়ের আহবানে চাকমা গোষ্ঠীর একটা বড় অংশই পাকিস্তানকে সমর্থন করে এবং ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সে যোগ দেয়। স্বাধীনতার পর এদের সবাইকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরে সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি দেওয়া হয়। বাঙালী তার স্বাধীকার লড়াইয়ে চাকমাদের এই অবস্থানকে বিদ্বেষের দৃষ্টিতে দেখেনি। বরং ক্ষমাসূলভ চোখেই দেখেছে।
১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে ধর্মীয় সম্প্রদায়,উপসম্প্রদায়, তাদের সংস্কৃত, ঐতিহ্য লালন ও বিকাশের গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু পাহাড়ে অত্যাচার চালাননি। বরং তার সংবিধানে লেখা ছিলো: জনগনের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষন হইতে মুক্তি, মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ সাধন,জনগনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার, ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী , নারী-পুরুষ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য করবে না। ’ পৃথক জাতিস্বত্বার স্বীকৃতি চেয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এই সংবিধানে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার পর তার সেই ভুল ভাঙ্গে। তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন বাঙালী জাতীয়তাবাদের আওতায় তাদের নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বিপন্ন হবে না। সেসময় জাতীয় প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ বেতারে চাকমা ও মারমা ভাষায় খবর পাঠ ও প্রতিবেদন প্রচার শুরু হয়েছিলো। লারমা বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন চাকমাদের ওপর যুগ যুগ ধরে চলে আসা নিপীড়ণ, বৈষম্য দূরকরার জন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করার শপথ নিয়ে। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে পাহাড়ে কি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে সমর্থন দিয়েছিলো চাকমারা? সেবার বিজয়ী উপেন্দ্রলাল চাকমা এবং অংশু প্রু চৌধুরীর বিপরীতে সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিলো এই জাতীয়তাবাদের প্রার্থী। তারপরই শুরু পাহাড়ে বাঙালী সেটলারদের আগ্রাসন। জিয়ার জানা হয়ে গিয়েছিলো পাহাড়ের জনমত।
বাঙালী জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তিই যেখানে অসাম্প্রদায়িকতা সেখানে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক একটি উপাখ্যান মাত্র। ধর্ম নিরেপক্ষতা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রকে ধর্মীয় রূপ দিয়ে সকল অমুসলিম নাগরিককে দ্বিতীয় শ্রেণীর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই জাতীয়তাবাদে যে কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় আনুগত্য মেনে নিলেই এই দেশের নাগরিক হতে পারবেন (যেমন গোলাম আযম),তাকে বাঙালী হতে হবে না। ভাষা, সংস্কৃতি, নৃতাত্বিক যোগসূত্রে প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ জাতিস্বত্বাকে অস্বীকার করেও আপনি এই দেশের নাগরিক হতে পারবেন, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে অংশ নিতে পারবেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনে এর চেয়ে চমৎকার সংশোধনী আর কি হতে পারে সংবিধানের! অন্য দেশের দালালী করতে আর কি অজুহাত চাই আপনার? এটা রাষ্ট্র আপনার জন্য নিপাতনে সিদ্ধ করে দিয়েছে।
বাঙালী জাতীয়তাবাদ একটি জাতির জন্য ভুখন্ড বাংলাদেশ এনে দিয়েছে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একটি ভুখন্ডের জনগনকে সেই ভুখন্ডের নামে পরিচিত করেছে। যেমন পাকিস্তানী। তারই আদলে। নতুন শ্লোগানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। ‘জয় বাংলা’কে এত ভয় কেনো বুঝতে হবে।বাঙালী হলেই যে জাতিস্মরের মতো মনে পড়ে যাবে তার সব কিছু। ভেঙ্গে যাবে শাদ্দাদের মিথ্যা বেহেশত। বিপদের কথা, সে দিনটা অত্যাসন্ন।
^উপরে যেতে ক্লিক করুন