শহীদ বেগম মুজিবের অপ্রকাশিত একটি সাক্ষাতকার



শহীদ বেগম মুজিবের অপ্রকাশিত একটি সাক্ষাতকার
পাক মিলিটারিরা বাসা ঘেরাও করে গুলি চালাতে শুরু করে
চৌধুরী শহীদ কাদের ত্রিপুরার চিত্র সাংবাদিক রবীন সেনগুপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট অনেক ছবি তুলেছেন। ঢাকা থেকে সময় তোলা তার আলোকচিত্রের একটি সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে, যার নামচিত্র-সাংবাদিকের ক্যামেরায় মুক্তিযুদ্ধ।মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা প্রদান করে।


গত মাসে গবেষণার কাজে আমি ত্রিপুরা গিয়েছিলাম। সেখানে শ্রী সেনগুপ্তের সঙ্গে দেখা করি। সাগ্রহে তিনি আমাকে গ্রহণ করেন এবং সময় বেগম ফজিলাতুন্নেসার তোলা একটি ছবি স্বাক্ষর করে আমাকে উপহার দেন যা এখানে ছাপা হলো। রবীন সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, বিজয়ের পর যে কজন সাংবাদিক মুক্ত বেগম মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাত করেন কথাবার্তা বলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ত্রিপুরার ভূপেন চন্দ্র ভৌমিক, অনিল ভট্টাচার্য এবং তিনি নিজে। ছোট একটি সাক্ষাতকার বেগম মুজিব দিয়েছিলেন। তার একটি কপিও আমাকে দিয়েছেন যা বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী কর্তৃক খুলনায় প্রতিষ্ঠিত১৯৭১: গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর প্রদান করেছি।
বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে অনেক শ্রদ্ধা করে এখনবঙ্গমাতাঅভিধায় ভূষিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, সে সূত্রেই এই অভিধা এবং এর যৌক্তিকতাও আছে। বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। বিয়ের পর থেকে পুরো সংসার তিনিই আগলে রেখেছেন, ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। তিনি সব সময় আড়ালেই থেকেছেন। জাতির জনক হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁকে খুব কমই দেখা গেছে। সাংবাদিকদের মুখোমুখিও তিনি পারতপক্ষে হতেন না।
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পর তিনি ৩২ নম্বরের বাসভাবন ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেন। পরে পাকিস্তানী বাহিনী গ্রেফতার করে তাঁর পুত্র-কন্যাসহ ধানম-ির পুরনো ১৮ নম্বর বাড়িতে নজরবন্দী করে রাখে। ১৬ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান।
রবীন সেনগুপ্ত ত্রিপুরার সোনামুড়া সীমান্ত পেরিয়ে কুমিল্লা চাঁদপুর হয়ে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পৌঁছান। ১৭ ডিসেম্বর তিনি চলে যান ধানমণ্ডি। দেখা মেলে বেগম ফজিলাতুন্নেসা বঙ্গবন্ধুর পরিবারেরর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে। বেগম মুজিব দৌহিত্র জয়কে কোলে নিয়ে কথা বলেন। সপরিবারে ছবি তোলার অনুমতি দেন।
স্বল্প সময়ের মধ্যে বেগম মুজিব রবীন সেনগুপ্তের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দেন। পুরনো হয়ে যায় টেপের অনেক কথা অস্পষ্ট। তবুও যতটুকু পারা যায় সেই কথোপকথন উদ্ধার করে প্রকাশ করছি। কারণে যে, বঙ্গমাতা ফরমাল সাক্ষাতকার কখনও দেননি। সে হিসেবে যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন এর একটি ঐতিহাসিক মূল্য আছে।
শ্রী সেনগুপ্ত বেগম মুজিবের কাছে প্রথমেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রির কথা জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে বেগম মুজিব বলেন (আঞ্চলিক শব্দ বা অস্পষ্ট শব্দ, বাক্য পরিহার করা হয়েছে) :
২৫ তারিখ রাতে মিলিটারিরা বাসায় এসে ঘেরাও করল আর গুলি চালানো শুরু করল।
শেখ সাহেব তখন শোওয়া ছিল।
গুলির আওয়াজে শেখ সাহেব, আমি আমার ছোট ছেলে, তাড়াতাড়ি করে বাথরুমের ভেতরে চলে যাই।
ওরা যখন আসছে, তখন প্রথম থেকেই ওরা গুলি করতে করতে আসছে।
জানালা খোলা ছিল।
আমি জানালা বন্ধ করতে গেছি।
জানালা বন্ধ করতে যখন গেছি তখন দেখি পাশের বাড়িতে মিলিটারি ঢুকছে।
ওটা দেখে আমি তাড়াতাড়ি করে শেখ সাহেবেরে ডাক দিই যে মিলিটারি আসছে।
শেখ সাহেব ডিজ্ঞেস করল; কি করে জান তুমি?
আমি বললাম, হ্যাঁ, মিলিটারি আসছে।
এর ভেতরে আমি মিলিটারির আওয়াজ শুনতে পাই।
জোয়ান পজিশন নাও
যে সময়ে এই কথা বলছে, আমার ছেলে তখন অন্য ঘরে শোয়াছিল।
আমি তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে, মেজ ছেলেরে নিয়ে আসি। আমি দরজা বন্ধ করতে পারি নাই। এর ভেতরে ওপর নিচে সব জায়গার শুধু গুলির আওয়াজ। শেখ সাহেব বাথরুম থেকে বের হয়ে ওদের বলল গুলি বন্ধ কর। গুলি বন্ধ কর।
কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি।
তারা এত গুলি করেছে যে, আমাদের ভেতরে কথা কিছুই তারা শুনতে পায়নি।
আমার ছোট একটি ছেলে আছে (রাসেল) ওই ছেলেটা খুব ভয় পেয়ে গেছে খুব কান্নাকাটি করছে। ওরে আমি ঘরের ভেতরে আনতে পারি নাই। অন্য ঘরে শোয়াছিল। তারা ছেলেটাকে বলল, তুমি আম্মার কাছে যাও।
এর ভেতরে শেখ সাহেব চিৎকার করে বললস্টপ ফায়ারিং।
এই কথা বলার পর গুলি করা বন্ধ হয়ে গেল।
এর আগে আমার বেডরুমের ভেতরে অনেক গুলি করা হয়েছে।
তারপর শেখ সাহেব বাইরে বের হয়ে আসল।
আসার পর বলল, তোমাদের এখানে বড় অফিসার কেউ আসছে?
ওরা কি বলল আমি আর শুনতে পায় নাই। আমি তখন ভেতরের রুমে বসা আছি। তারপর শেখ সাহেব ওদের সঙ্গে নিচে চলে গেল। নিচে গিয়ে একটু পর উপরে উঠে আসল। একজন বোধহয় কর্নেল, একজন মেজর, জন সিপাহি উনার সঙ্গে উপরে আসল। উপরে এসে কামালকে বলল আমার বিড়ি আর স্যুটকেসটা দাও।
তাড়াতাড়ি করে আমি আর কামাল জামা কাপড় রেডি করে দিলাম।
শেখ সাহেব কর্নেল কে বলল,
আপনারা আমাকে ফোন করলেই তো পারতেন এভাবে গুলি চালানোর কি উদ্দেশ
যখন শেখ সাহেবকে নিচে নিয়ে যায়, তখন কর্নেল মেজ ছেলেকে বলল, ‘তোমার বাবারে নিয়ে যাচ্ছি আমি খুব দুঃখিত।মেজ ছেলে খুব রাগ করল। শেখ সাহেব বলল এদের সঙ্গে আর কথা বলে কি হবে।
রবীন সেনগুপ্ত বেগম মুজিবকে আরও জিজ্ঞেস করেছিলেনশেখ সাহেব আপনাকে সর্বশেষ কি বলে গিয়েছিলেন
এর উত্তরে বেগম মুজিব বলেছিলেন-
এখানে যদি তুমি ভালভাবে থাকতে না পার, দেশের বাড়িতে চলে যেও। এরা (ছেলেমেয়ে) থাকলে এদের ভালভাবে লেখাপড়া শিখাবে। এই একটি মাত্রই কথা, ছেলেমেয়ে থাকলে ওদেরকেই মানুষ করবা।
আর কোন কথা বলেনি।
এর পর তিনি নয় মাসের আতঙ্কের দু’-একটি কথা বলেন, টেপে যার কিছুটা বোঝা যায় কিছুটা বোঝা যায় না। তবে, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধুকে যে পাকিস্তানী অফিসার গ্রেফতার করেছিলেন পরে তিনি আত্মজীবনী লেখেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের বর্ণনা আছে। বর্ণনা আর সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আছে মুনতাসীর মামুন রচিতপাকিস্তানী জেনারেলের মন’ [সময় প্রকাশন] গ্রন্থে।
(
লেখক : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক)
সাক্ষাতকারে শহীদ বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের বক্তব্য অবিকল রাখার চেষ্টা করা হয়েছে]



^উপরে যেতে ক্লিক করুন