ভাষাবীর ধীরেন্দ্রনাথের বাড়িটি আজ ধ্বংসস্তুপ প্রায়!

ইমতিয়াজ আহমেদ জিতু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

x

ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
Decrease font Enlarge font
কুমিল্লা: মহান ভাষা আন্দোলনের প্রথম বীজ বপনকারী বলে খ্যাত, ইতিহাসের মহানায়ক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রায় সময়ই বলতেন,‘বাংলা ও বাঙ্গালীকে ছেড়ে আমি কখনো যেতে পারবো না। আমার হৃদয়জুড়ে রয়েছে বাংলা ও বাঙ্গালির প্রতি অসীম ভালবাসা।’

কুমিল্লার সূর্যসন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তার কথা রেখে গেছেন, প্রিয় বাংলাকে ছেড়ে তিনি কোথাও যাননি। এই বাংলার মাটিতেই প্রবাহিত হয়েছে তার বুকের তাজা রক্ত।


তদানীন্তণ পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত গণপরিষদ অধিবেশনে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার প্রথম প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন। যার ধারাবাহিকতায় বাংলা হয় রাষ্ট্র ভাষা। আর এরপর ১৯৭১ এ যখন মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে দেশ তখন প্রথম সুযোগেই পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যা করে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে। সঙ্গে তার ছেলে দিলীপ কুমার দত্তও শহীদ হন সেদিন।

ভাষার জন্য যে যোদ্ধা পরে দেশের জন্য নিজের প্রাণটাই বিসর্জন দিলেন সেই ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে জাতীয় পর্যায়েও তেমন একটা আলোচনা নেই।  ধীরেন্দ্রনাথের বাড়িটি হয়ে থাকতে পারতো স্মৃতির চিহ্ন হয়ে। কিন্তু সে উদ্যোগটিও আজ নেই। তবে সে জন্য ধীরেন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারীদেরও নেই ইতিবাচক সাড়া।

যথাযথ সংস্কারের অভাবে কুমিল্লায় ধীরেন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত বসতভিটাটি বিলীন হওয়ার পথে। এ স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় এখনি পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো এক সময় জানবেই না এই গুণী ব্যক্তিটি কুমিল্লায় জন্ম নিয়ে হয়ে উঠেছিলেন দেশবরেণ্য।

দিনটি ছিলো ১৯৪৮ সাল, ২৫ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশন চলছিল। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেদিন বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রথম প্রস্তাব দেন। ধীরেন্দ্রনাথ সেদিন বলেছিলেন, ‘গণপরিষদে যে কার্যবিবরণী লেখা হয় তা ইংরেজি ও উর্দু ভাষায়। সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাই ইংরেজি ও উর্দুর সাথে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব করছি।’

এতে প্রথম ক্ষিপ্ত হন তখনকার পাকিস্তানের  প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’র দাবিতে প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য পাক্-সরকারের রোষাণলে পড়েন ধীরেন্দ্র নাথ। এক পর্যায়ে তিনি করাচি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন।  বিমানবন্দরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা তাকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়। বলা হয় সেখান থেকেই মূলত ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত।

এরপর ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রক্তের অক্ষরে বাংলা ভাষার যে ইতিহাস অংকিত হয়েছে , সেই ইতিহাসের প্রবর্তক কুমিল্লার এই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তার অসম সাহসী উদ্যোগ আর পরবর্তীতে রাজপথে সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারের আতœত্যাগ এবং অসংখ্য ভাষা সৈনিকের সংগ্রামের ফলেই মায়ের ভাষা বাংলা পায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা।

এর আগে ১৯৫০ সালে গণপরিষদে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব উত্থাপিত হলে ধীরেন্দ্রনাথ তীব্র প্রতিবাদ জানান।
আর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে রক্ত ঝরে। ২২ ফেব্রুয়ারি এ নিমর্ম হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের অধিবেশন বয়কট করেন এবং এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
পরে তিনি কুমিল্লায় চলে আসেন।

তখন থেকেই তার কুমিল্লায় স্থায়ী বাস। প্রথম দিকে কুমিল্লার আদালতের উত্তরে কাপ্তানবাজারে গোমতীর পাড়ে একটি বাসগৃহে ভাড়া থাকতেন। পরে ধর্মসাগর দীঘির পশ্চিমপাড়ে জমি কিনে একটি টিনের আটচালা বাড়ি গড়ে এই বাড়িতেই তিনি আমৃত্যু কাটিয়ে দেন।

সেটি ছিলো মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। ভাষা আন্দোলনে ভ’মিকা রাখার জন্য আগে থেকেই টার্গেট হয়ে ছিলেন ধীরেন্দ্র নাথ। আর সে কারণে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে প্রথম দিকেই হামলা হয় তার বাড়িটিতে। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ গভীর রাতে কুমিল্লার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী এড. আব্দুল করিমের নেতৃত্বে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী কুমিল্লার ধর্মসাগরের সেই বাড়ি থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার ছোট ছেলে দিলীপ কুমার দত্তকে ধরে নিয়ে যায় কুমিল্লা সেনানিবাসে। সেখানে ৮৫ বছর বয়স্ক এই দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। হত্যা করা হয় তার ছেলে দিলীপ কুমার দত্তকেও। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মরদেহ কেউ খুঁজে পায়নি।

ধর্মসাগর দীঘির পশ্চিমপাড়ের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিবিজড়িত টিনের আটচালা বাড়িটি নিয়ে অনেকের আগ্রহ তৈরি হয়। কারো প্রত্যাশা এটি হোক ধীরেন্দ্রনাথের স্মৃতি জাদুঘর। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের অনীহার কারণে যথাযথ সংস্কারের অভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে এই বাড়িটি।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেলো বাড়িটিতে রয়েছে মোট ছয়টি কক্ষ। যার দুইটি কক্ষে একটি মুসলিম পরিবার প্রায় ১২ বছর ধরে বসবাস করছে। তারা মূলত কেয়ারটেকার হিসেবে এই বাড়িতে আছেন। বাকি ৪টি কক্ষে পচাঁ পানি, ময়লা-আর্বজনায় পরির্পূণ। দেয়ালের ইটগুলোও খসে খসে পড়ছে। বাড়ির বাইরের দিকটাও ময়লা-আর্বজনার স্তুপে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। গাছগাছড়া পড়ে চারটি কক্ষ ঢেকে গেছে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে কক্ষে ঘুমাতেন সেখানে তার শোবার খাটটি এখনো রয়েছে, রয়েছে তার বালিশ। আরো আছে খাওয়ার প্লেট, পানির গ্লাস, গায়ের কাঁথা। এগুলো কিছুই সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। পরে আছে এদিক সেদিক। এগুলো বাড়িতে বসবাসরত পরিবারটি ব্যবহার করছে। বাড়ির কেয়ারটেকার রিপন মিয়া বাড়ির সামনেই একটি ছোট দোকান বসিয়েছেন। বাড়ির সামনের নামের সাইনবোর্ডটিও ভেঙ্গে নষ্ট হয়ে গেছে। পুরো বাড়িটিই এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। ফলে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি এখন নিঃশেষ হওয়ার পথে।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচিহৃ অবহেলায় বিপন্ন হতে দেখে হতাশ কুমিল্লার সর্বস্তরের জনগণ। তারা দাবি তুলেছেন সরকারি হস্তক্ষেপ করে বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য। স্থানীয় বাসিন্দা বীরমুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, বাংলা ভাষার প্রথম প্রস্তাবক ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করে আমাদের ধরে রাখতে হবে। তার স্মৃতিটি বিলীন হওয়া মানে তাকে অবজ্ঞা করা।

কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম দুলাল বাংলানিউজকে জানান, ১৯৯১ সালে ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের বাড়িটি সংরক্ষণে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে তিনি নিজে ছাড়াও  প্রয়াত নিরীক্ষণ সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ, অ্যাডভোকেট মোখলেছুর রহমান চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন চৌধুরী ছিলে। কমিটির পক্ষ থেকে কয়েকবার ঢাকায় ধীরেন্দ্রনাথের  নাতনির সঙ্গে দেখাও করেন। কিন্তু তাদের ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় বাড়িটি সংরক্ষণে আমরা কোনও কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারি নি।

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল বাংলানিউজকে জানান, ধীরেন্দ্রনাথ যে বাড়িতে থাকতেন সেটি সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা রয়েছে। তবে বাড়িটি নিয়ে মামলা রয়েছে, তাছাড়া বাড়িটির বর্তমান উত্তরাধিকাররা এটি নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে চান। সে কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে না।

পরিবার যদি বাড়িটি সরকারকে সরাসরি না দেয়, তাহলে সে বাড়িতে সরকারি উন্নয়ন কাজ করাটা সম্ভব নয়, বলেন হাসানুজ্জামান কল্লোল। 

তিনি আরও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ঘিরে কুমিল্লার মানুষের বিশেষ আবেগ কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। সে দিকটা লক্ষ্য রেখেই কুমিল্লা স্টেডিয়ামের নামকরণ ধীরেন্দ্রনাথের নামে হয়েছে, সড়কও রযেছে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে।

১৯৪৮ সালে তদানিন্তন পাকিস্তানি পার্লামেন্টে দাড়িয়ে তিনি বলেছিলেন যে, অধিকাংশ মানুষের ভাষা হিসেবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংসদে উপস্থাপনের ওই দিনটির স্মরণে এবছরও ভাষা শহীদ দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দিবস হিসেবে পালন করা হবে। এছাড়া কুমিল্লা জেলার সকল উপজেলার স্কুল-কলেজে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও বাংলাকে আর্ন্তজাতিক রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবকারী বীর মুক্তিযোদ্বা রফিকুল ইসলামের নামে রচনা প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক হাসানুজ্জামান কল্লোল বলেন, এতে করে শিক্ষার্থীরা এই দুই গুণীজনের আতœজীবনী সর্ম্পকে পড়ালেখা করবে, আরো বেশি জানতে পারবে। 
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিবারে অনেক জ্ঞানী ও গুণীজন রয়েছেন তাদের প্রতি আমি অনুরোধ জানাবো বাড়িটি সংরক্ষণ, সংস্কার করে তার স্মৃতিরক্ষায় তারা নিজেরাও ব্যবস্থা নিতে পারেন।

কল্লোল বলেন, বর্তমান সরকার সংস্কৃতিবান্ধব। আমরা শচীন দেব বর্মণের বাড়িটি উদ্ধার করে এখন সংস্কার কাজ করছি। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি সংস্কারের জন্য তার উত্তরাধিকারদের ইতিবাচক সাড়া পেলে সেটি সংস্কারেও উদ্যোগ নিতে পারি।

বাংলাদেশ সময়:১৫০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
এমএমকে
^উপরে যেতে ক্লিক করুন