ঋতু চলাকালীন সময়ে মা-বোনেরা কি কুরআন তেলাওয়াত করতে পারবেন?

প্রশ্নঃ ঋতু চলাকালীন সময়ে মা-বোনেরা কি কুরআন তেলাওয়াত করতে পারবেন?
উত্তরঃ বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, ঋতু চলাকালীন সময়ে মা-বোনেরা কুরআন তেলাওয়াত করতে পারবেন না।

জায়েজ নাকি নাজায়েজ, এটা নিয়ে আলেমদের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য হয়েছে।

ক) একদল আলেম বলছেন, নারীদের জন্য ঋতু চলাকালীন সময়ে কুরআন তেলাওয়াত করা সম্পূর্ণ হারাম, নাজায়েজ।

খ) আরেক দল আলেম বলছেন, এমনিতে নাজায়েজ কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে জায়েজ যেমন - ভুলে যাওয়ার আশংকা থাকলে, শিক্ষিকা ছাত্র বা ছাত্রীকে পড়ানোর জন্য, দুয়া বা ঝাড়-ফুঁক হিসেবে।

গ) তৃতীয় আরেক দল আলেম বলেছেন, নারীদের জন্য ঋতু চলাকালীন সময়ে কুরআন তেলাওয়াত জায়েজ, যারা নাজায়েজ বলেছেন, তাদের দলীল ঠিক নয়। যেই হাদীসের উপর ভিত্তি করে ঋতুবতী নারীদের ক্বুরান তেলাওয়াত হারাম বলেছেন, হয় সেই হাদীস জয়ীফ অথবা হাদীস থেকে তারা যে অর্থ করেছেন তা ভুল। মানুষ হিসেবে এরকম ভুল যেকোনো আলেমরই হতে পারে। আর আলেমদের এরকম ভুল হয় বলেই, একই বিষয়ে আলেমদের দুই বা তথোধিক মত দেখতে পাওয়া যায়।

তৃতীয় এই মত অর্থাৎ, নারীদের জন্য ঋতু চলাকালীন সময়ে কুরআন তেলাওয়াত জায়েজ, এর পক্ষে যারা ফতোয়া দিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ

ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমাদ এর প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, নারীরা ঋতু অবস্থায় ক্বুরান তেলাওয়াত করতে পারবে।
একথা ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা রহঃ তার ফতোয়া ২১/৪৫৯ এ উল্লেখ করেছেন।

- ইমাম মালেক রহঃ (যিনি মালেকী মাযহাবের ইমাম),
- ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল রহঃ (যিনি হাম্বালী মাযহাবের ইমাম),
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা রহঃ (যুগশ্রেষ্ঠ আলেম, মুজাহিদ ও মুফাসসির)।
- ইমাম ইবনে হাজম রহঃ
- একজন মুহাক্কিক আলেম, আল্লামাহ শওকানী (রহঃ) তার কৃত গবেষণা থেকে এই মতকেই সঠিক বলে রায় দিয়েছেন।

সুতরাং, দলীল, যুক্তি, প্রমান ও শ্রেষ্ঠ আলেমদের ফতোয়া অনুযায়ী ঋতু চলাকালীন সময়ে নারীরা কুরআন তেলাওয়াত করতে পারবেন। আপনারা বিস্তারিত দলীল-প্রমান ও ফতোয়া জানার জন্য ফিকহুস সুন্নাহ এর তাহারাহ (পবিত্রতা) অধ্যায় এবং IslamQA এর ফতোয়া দেখুন।
http://islamqa.com/en/ref/2564

সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি, আল্লামাহ আব্দুল আজিজ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বাজ (রহঃ) কে এই ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি ফতোয়া এই দেনঃ
প্রশ্নঃ আমরা মহিলা কলেজের ছাত্রী, আমাদের পাঠ্যসূচীতে আল-কুরআন থেকে অংশবিশেষ মুখস্থ করার বিষয় রয়েছে; কিন্তু কখনও কখনও আমাদের মাসিক অবস্থায় পরীক্ষার নির্দিষ্ট তারিখ হাযির হয়ে যায়, সুতরাং এমতাবস্থায় আমাদের জন্য খাতার মধ্যে কোন সূরা লেখা এবং তা মুখস্থ করা শুদ্ধ (বৈধ) হবে কিনা?
উত্তরঃ আলেমদের দুটি মতের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ মতে, হায়েয এবং নিফাসকালীন সময়ে নারীদের জন্য কুরআন পাঠ করা বৈধ। কারণ, এই ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে কোনো দলিল সাব্যস্ত নেই, কিন্তু আল-কুরআনের মাসহাফ (গ্রন্থ) স্পর্শ করা ব্যতীত পাঠ করতে হবে। আর উভয় অবস্থায় নারী পবিত্র কাপড় ও অনুরূপ কিছুর সাহায্যে আড়াল করার মাধ্যমে তাকে ধরতে পারবে। অনুরূপভাবে ঐ খাতার ব্যাপারেও একই বিধান প্রযোজ্য হবে, প্রয়োজনের সময় যার মধ্যে আল-কুরআন লিপিবদ্ধ করা হয়।
তবে যার উপর অপবিত্রতাজনিত কারণে গোসল ফরয হয়েছে, এমন অপবিত্র ব্যক্তি গোসল না করা পর্যন্ত কুরআন পাঠ করবে না। কারণ এই ব্যাপারে বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যা নিষেধাজ্ঞার উপর প্রমাণবহ। এই ক্ষেত্রে হায়েয এবং নিফাসকালীন সময়ের নারীদের উপর অনুমান (কিয়াস) করা বৈধ হবে না। কারণ, অপবিত্রতা জনিত কাজ থেকে অবসর হওয়ার পর থেকে যে কোনো সময়ে তার জন্য গোসল করে পবিত্র হওয়া সহজ। আর আল্লাহই তাওফীক দানের মালিক।
ফতওয়া দিয়েছেনঃ শাইখ ইবনু বায (রহঃ)
ফতোয়া (الفتاوى): ১ / ৩৯।

সৌদি আরবের একজন শীর্ষস্থানীয় মুফতি, আল্লামাহ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমিন (রহঃ) কে এই ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি ফতোয়া এই দিয়েছিলেনঃ
(১৭২) ঋতুবতী নারীর কুরআন তেলাওয়াত করা জায়েয কি?
উত্তরঃ প্রয়োজন দেখা দিলে ঋতুবতী নারীর কুরআন পাঠ করা জায়েয। যেমন সে যদি শিক্ষিকা হয়, তবে পাঠ দানের জন্য কুরআন পড়তে পারবে। অথবা ছাত্রী কুরআন শিক্ষা লাভ করার জন্য পাঠ করতে পারবে। অথবা নারী তার শিশু সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দেয়ার জন্য পাঠ করবে, শিখানোর জন্য তাদের আগে আগে কুরআন পাঠ করবে। মোটকথা যখনই ঋতুবতী নারী কুরআন পাঠ করার প্রয়োজন অনুভব করবে, তখনই তার জন্য তা পাঠ করা জায়েয কোন অসুবিধা নেই। অনুরূপভাবে কুরআন পাঠ না করার কারণে যদি ভুলে যাওয়ার আশংকা করে, তবে স্মরণ রাখার জন্য তেলাওয়াত করবে- কোন অসুবিধা নেই। বিদ্বানদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, বিনা প্রয়োজনেও তথা সাধারণ তেলাওয়াতের উদ্দেশ্যে ঋতুবতীর জন্য কুরআন পাঠ করা জায়েয। অবশ্য কোন কোন বিদ্বান বলেন, প্রয়োজন থাকলেও ঋতুবতী নারীর কুরআন পাঠ করা হারাম। এখানে তিনটি মত পাওয়া গেল।
কিন্তু আমার মতে যে কথা বলা উচিত তা হচ্ছে, ঋতুবতী নারী যদি কুরআন পাঠ দান বা শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করে বা ভুলে যাওয়ার আশংকা করে, তবে কুরআন পাঠ করতে কোন অসুবিধা নেই।
উৎসঃ ফতোয়া আরকানুল ইসলাম, পবিত্রতা অধ্যায়।
^উপরে যেতে ক্লিক করুন