মদিনা সনদের সারমর্ম


মদিনা সনদের সারমর্ম || খোরশেদ আলমকাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রিয় নবী (সাঃ) আল্লাহ্‌ তাআলার নির্দেশক্রমে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। মদীনায় স্থায়ীভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং জুলুম ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে মদীনায় বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মালবম্বী বিশেষত ইয়াহুদীদের সাথে তিনি এক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন যা ইতিহাসে 'মদিনা সনদ' নামে খ্যাত।

বিশ্বের প্রথম স্বাধীন মুসলিম প্রদেশ মদিনার সংবিধান (অনেকে একে শান্তিচুক্তিও বলে থাকেন) রচনা করেছিলেন স্বয়ং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তিনি চাইলে কোরআনকে মদিনার সংবিধান হিসেবে চালু করতে পারতেন, ইসলামকে মদিনা শহর বা প্রদেশর প্রধান ধর্ম হিসেবে ঘোষণা দিতে পারতেন। কিন্তু নবী করিম (সাঃ) তেমন কিছু করেননি বরং তাঁর সংবিধানে মদিনার মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের সমান অধিকার দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রকে কারও ধর্মের বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয়া হয়নি এবং অমুসলিমদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। যে কারণে ৬২২ সাল মহানবী (সাঃ) কর্তৃক প্রণীত মদিনার সংবিধানকে গণ্য করা হয় বিশ্বের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান হিসাবে।

নিজ ধর্মের আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য অন্য ধর্মের অনুসারীদের হত্যা বা নির্যাতন করবার বিধান বিশ্বের কোনও ধর্মেই নেই। ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষ ধর্মের জন্য নয়। একজন মানুষ যখন ভুলে যায় ধর্ম-জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ-বিত্ত-ভাষাগত পরিচয়ের আগে সে মানুষ তখনই সাম্প্রদায়িকতা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে, মানুষ পরিণত হয় অমানুষে।

উল্লেখ্য, মদিনা সনদে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা নেই বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কথাও নেই। কারন মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী সবাই মুসলমান ছিল না। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে ‘বিসমিল্লাহ’ নেই এমন কি আমাদের প্রিয় নবী করিম (সাঃ) এর নাম সেখানে মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ নয়, লেখা আছে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ কারন এই চুক্তি ছিল মুসলিম এবং অমুসলিমদের মধ্যে।

ঠিক একইভাবে, কোন দেশের সংবিধান হলো মদিনা সনদের মত, ঐ রাষ্ট্রের সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে এক সাথে বসবাস কারার চুক্তি। ইচ্ছা করলেই সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা যায় না বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করা যায় না, এটা ইসলাম সমর্থিত নয়।

আসুন, একনজরে দেখে নেই মদিনা সনদের শর্তসমূহ-

১. সনদপত্রে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে।
২. কোন সম্প্রদায় গোপনে কুরাইশদের সাথে কোন প্রকার সন্ধি করতে পারবে না কিংবা মদীনা বা মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কুরাইশদের কোনরুপ সাহায্য-সহযোগীতা করতে পারবে না।
৩. মুসলিম, খ্রীস্টান, ইহুদী, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোন রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
৪. মদিনার উপর যে কোন বহিরাক্রমণ কে রাষ্ট্রের জন্য বিপদ বলে গণ্য করতে হবে। এবং সেই আক্রমণ কে প্রতিরোধ করার জন্য সকল সম্প্রদায়কে এক জোট হয়ে অগ্রসর হতে হবে।
৫. রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
৬. অসহায় ও দূর্বলকে সর্বাবস্থায় সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
৭. সকল প্রকার রক্তক্ষয়, হত্যা ও বলাৎকার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মদীনাকে পবিত্র নগরী বলে ঘোষণা করা হবে।
৮. কোন লোক ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিচার করা হবে। তজ্জন্য অপরাধীর সম্প্রদায় কে দায়ী করা যাবে না।
৯. মুসলমান, ইহুদী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরষ্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে।
১০. রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে রাষ্ট্র প্রধানের এবং তিনি হবেন সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বোচ্চ বিচারক।
১১. মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনুমতি ব্যতীত মদীনাবাসীগণ কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
১২. মুসলমানদের প্রতি কেউ যদি ঘোর অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। নিজ সন্তান বা আত্নীয় হলেও এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমা করা যাবে না।
১৩. ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে।

উপরোক্ত শর্তসমূহের আলোকে এটাই সুস্পষ্টভাবে প্রমানিত হয় যে, অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থাকে ইসলাম সমর্থন করে। মদিনা সনদ ধর্মভিত্তিক কোন রাজনীতিকে সমর্থন করে না। শুধু তাই নয়, ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা মদিনা সনদে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে। উল্লেখ্য মদিনা সনদের প্রত্যেকটি শর্তের সঙ্গেই বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের মুল নীতি ও আদর্শের মিল খুজে পাওয়া যায়; কিন্তু বিএনপি-জামায়াতিদের আদর্শের সঙ্গে নয়।

পরিশেষে, ২২ মার্চ ২০১৪ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৩৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বলেন, মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) মদিনা সনদে যে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, সে অনুযায়ী দেশ চলছে ও চলবে। তবে কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক কোন আইন করা হবে না। আবার আমাদের সরকার কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন কাজও করবে না।
^উপরে যেতে ক্লিক করুন