কেমন আছেন বঙ্গবন্ধুর দাফনকারীরা



কেমন আছেন বঙ্গবন্ধুর দাফনকারীরা

১৫-আগস্ট এলেই কেবল আমাদের খোঁজখবর নেয়া হয়। সারা বছর আমাদের কিভাবে চলে সে খবর কেউ রাখে না, নেয় না। বঙ্গবন্ধুর লাশ যখন মিলিটারিরা এখানে নিয়ে আসে, তখন ভয়ে অনেকে কাছেই আসেনি। সেনা কর্মকর্তারা চেয়েছিল তাড়াহুড়ো করে দ্রুততর সময়ের মধ্যে তাঁকে কোনরকমে মাটি চাপা দিয়ে ঢাকায় ফিরতে; কিন্তু সেদিন টুঙ্গিপাড়ার মুজিবপাগল কতিপয় মানুষের সাহসী ভূমিকার কারণে তা তারা পারেনি। 



 ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে রেড-ক্রিসেন্টের রিলিপের মার্কিন কাপড় এনে জানাজার কাপড় তৈরি করে তারপর বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফন করেছিলাম আমরা। কাঠের বাক্স যখন খোলা হলো, দেখলাম শুয়ে আছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শিউরে উঠলাম। কোন কথা বলতে পারলাম না। কাঁদলাম নিঃশব্দে। এখন অনেকেই অনেক কিছু বলে; কিন্তু তখন অনেককেই পাওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধুর দাফন কাজে আমরা যারা সম্পৃক্ত ছিলাম, তাদের অনেকে এখন নেই। যারা বেঁচে আছি, এখনও সেই স্মৃতিকেই ধারণ করে আছি।’ -কথাগুলো বলছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাফনকারীদের একজন কাজী ইদ্রিস আলী।
গত শনিবার জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরও জানান, ১৯৭৩ সালে টুঙ্গিপাড়া রেড-ক্রিসেন্ট হাসপাতালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে চাকরি দিয়েছিলেন। ২০১১-এর জানুয়ারি তিনি অবসরে গেলেও এখনও তিনি ওখানেই কাজ করছেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে তাঁকে হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়। আগামী জানুয়ারি তার সে মেয়াদ শেষ হবে। তার দুটি মেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলে এমএ পাস করে ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে কাজ করে, কোন সরকারী চাকরি হয়নি। মেজ ছেলে ডিগ্রী পড়ছে। ছোট ছেলে এইচএসসি পাস করে বেকার। তার সামনে শুধু অন্ধকার। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনরকমে তিনি দিনাতিপাত করছেন। কয়েকবার ঢাকা গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখার করার চেষ্টা করেছেন। অনেকেই তাঁকে শুধু আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি দেখা করতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, মৃত্যুর আগে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি দেখে যেতে পেরেছি। মনের কষ্ট কিছুটা হলেও কমেছে। তবে যারা বিদেশে পলাতক রয়েছে তাদের ধরে এনে ফাঁসিতে ঝোলাতে হবে। এমন সোনার মানুষকে যে পাষ-রা খুন করল তারা মানুষ নামের কলঙ্ক। তাদের শাস্তি হওয়া উচিত, ওই খুনীদের কোন ওয়ারিশকেও এই মুজিবের বাংলায় বসবাস করতে দেয়া ঠিক না।
বঙ্গবন্ধুর দাফনকারীদের আরেকজন হলেন রজব আলী শেখ। যিনি বঙ্গবন্ধুর লাশ এসেছে শুনে দৌড়ে গিয়েছিলেন তাঁদের প্রিয় মুজিব ভাইকে শেষবারের মতো দেখতে। পরম স্নেহের ঋণ খানিকটা শোধ করতে তৈয়ব আলীর দোকান থেকে আনা দিয়ে কিনে এনেছিলেন ৫৭০ সাবান। বছরের পর বছর জমিতে কাজ করে জীবনের গোধূলী বেলায় কেবলই তার হতাশা। ফুসফুসটিও চলে গেছে পোকার দখলে। ছেলেরা ছোট ছোট চাকরি করলেও ভাঙ্গা টিনের ঘরেই কোনরকমে কাটছে তাঁর দিন। এমন ঐতিহাসিক কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে কতটুকু সম্মান পেয়েছেন? -এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি হতাশাচিত্তে শুধু এটুকুই বললেন, ‘কে দ্যাখফে? যে দুঃখ বোঝতো, সে তো নাই। মুজিব ভাইয়ের খুনীগো বিচার হইছে, তাই দেইহে যাতি পারলাম- এতেই খুশি।
বড় পবিত্রতায় যাঁরা সেদিন বঙ্গবন্ধুকে গোসল করিয়েছিলেন তাঁদের একজন হলো মন্নাফ শেখ। গোসলের আগে নিথরচিত্তে তিনি অবলোকন করেছিলেন জাতির পিতার বাংলাদেশের মানচিত্রসম ২১ বুলেটের ক্ষত-বিক্ষত বুকটি। গোসল করাতে গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর মাথার কাছে পেয়েছিলেন তাঁর প্রিয় চশমাটি আর পরনের সাদা ফিনফিনে পাঞ্জাবির পকেটে পেয়েছিলেন ধূমপানের পাইপটি। যা বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধু মাজার কমপ্লেক্স জাদুঘরে। তার পাঁচ মেয়ে, সবার বিয়ে হয়ে গেছে এবং পাঁচ ছেলে, ছোট ছেলে সরকারী চাকরি করছে। তার বড় ছেলে শেখ রহমান (রমা) বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার একজন সাক্ষী। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনি ভাল আছেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এই বাংলাদেশ সোনার বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে এত দেরি হতো না। আমেরিকা, চীন, জাপান, রাশিয়ার সমকক্ষ হতে বাংলাদেশের বেশিদিন লাগত না। তাই বঙ্গবন্ধুর সব খুনীর ফাঁসি আমরা দেখে যেতে চাই। যেসব খুনী এখনও যারা বিদেশে রয়েছে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর লাশ যখন গোসল ছাড়াই কবর দেয়ার জন্য সেনা কর্মকর্তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে, ঠিক সেই মুহূর্তে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে যে ব্যক্তিটি বাধা দিয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন শেখ আব্দুল হালিম মৌলভী। এলাকায় তিনি একজন মৌলভী নামেই সুপরিচিত। তখন তিনি ছিলেন গিমাডাঙ্গা-টুঙ্গিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্ম শিক্ষক। তার বাধার কারণেই সেনা কর্মকর্তারা বাধ্য হয়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করে ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর গোসল সম্পূর্ণ করার আদেশ দেন। এরপরই সেখানে বঙ্গবন্ধুর অন্তিম গোসল করানো হয় ওই ৫৭০ সাবান দিয়ে। তাঁর জানাজাও পড়ান এই একজন মৌলভী। তিনি তখন বাধা হয়ে না দাঁড়ালে হয়ত ইতিহাসের পাতায় একদিন লেখা হতো, গোসল জানাজা ছাড়াই সমাহিত হয়েছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাঙালী। বেশ কয়েক বছর হলো এজেন মৌলভী মারা গেছেন। তাঁর দুমেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে। পাঁচ ছেলের চারজন চাকরি করে। ছোট ছেলে স্থানীয় একটি ধানের মিলে কাজ করলেও সব মিলিয়ে তারা ভাল আছেন।
পেশায় কাঠমিস্ত্রি হওয়ার সুবাদে বঙ্গবন্ধুকে বহন করে আনা কাঠের কফিনটি খোলার সৌভাগ্য হয়েছিল শেখ আব্দুল হালিম মিস্ত্রির। তখন সঙ্গে ছিল তাঁর ছেলে আইয়ূব আলী মিস্ত্রি। কয়েক বছর আগেই হালিম মিস্ত্রি মারা গেছেন। আইয়ূব আলীও ভাল নেই। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু মাজারের সন্নিকটেই একটি ভাঙ্গা টিনের ঘরে তাদের দোকান। কাঠমিস্ত্রির কাজ করে খেয়ে না খেয়ে কোনরকমে চলছে তাঁদের সংসার। বঙ্গবন্ধুর কফিন খোলার সময় একজন ঘরামী মিস্ত্রীও ছিলেন, যার নাম রজো মোল্লা। এখনও এই বৃদ্ধ বয়সে মিস্ত্রির কাজ করে তিনি সংসারের ঘানি টানছেন। তাঁর চার ছেলের বড়জন অভাবের তাড়নায় বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। মেজ ছেলে বেকার, সেজটা ঢাকায় টুকিটাকি ব্যবসা করে। ছোট ছেলে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে জীবিকার তাড়নায়। দুমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। রজো মোল্লার সঙ্গে কথা বলতে গেলে কোন আগ্রহ না দেখিয়েই তিনি শুধু বললেন, ‘ভাই, কী হবে আর এসব লিখে।
টুঙ্গিপাড়া থানা-চত্বরে হেলিকপ্টার নামার পর সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর কফিন কাঁধে নিয়ে যাঁরা হাসপাতালের সামনের কাঠের সেতু পার করে কফিন নিয়ে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উঠানে, তাঁদের একজন হলেন তোতা মিয়া শেখ, যিনি তখন ছিলেন ওই রেড-ক্রিসেন্ট হাসপাতালের দারোয়ান। তাদের দেয়া জায়গাতেই ওই হাসপাতালটি গড়ে ওঠে বলে জানা যায়। বেশ কয়েক বছর হলো তিনি মারা গেছেন। তাঁর তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তিন ছেলের একজন ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করেন, একজন গৃহস্থালী কাজ করেন এবং আরেকজন বেকার। তাদের সংসারের অবস্থাও ভাল নেই। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর লাশ যিনি স্বাক্ষর করে বুঝে রেখেছিলেন তিনি হলেন শেখ পলু মিয়া। তখনই তিনি অনেকটা বৃদ্ধ। তিনি ছিলেন কেরাইলকোপা প্রাইমারী স্কুলের সহকারী শিক্ষক। সেনা কর্মকর্তা যখন হুমকি দিয়ে বলেন লাশ কে বুঝে রাখবে, তখন কাঁপতে কাঁপতে পলু মিয়া আসেন বঙ্গবন্ধুর লাশের কাছে এবং সেনা অফিসার প্রদত্ত একটি কাগজে কাঁপতে কাঁপতে স্বাক্ষর করেন। পলু মিয়া অনেক আগে মারা গেছেন। তাঁর দুটি ছেলে, একজন মারা গেছেন। একজন এখনও আছেন, কিছুই করেন না। ভাইপোরাই তার খরচাদি চালায়।
বঙ্গবন্ধুর দাফনকারীদের আরেকজন হলেন আব্দুল হাই শেখ। বর্তমানে তিনি অসুস্থ হলেও পুরনো সেই সব স্মৃতি মনে এলেই আবার সচল হয়ে ওঠেন। তার এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। পাঁচ ছেলে সংসারে সবাই মোটামুটি ভাল আছেন। বঙ্গবন্ধুর কথা তুলতেই তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে- এটাই আমাদের বড় সান্ত¡না। কিছু বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এটাতে দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা। আর জন্য আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে




^উপরে যেতে ক্লিক করুন