- জাকারিয়া স্বপন
স্যাটেলাইট
শব্দটা শুনলেই আমার ভেতর এক ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি কাজ করে। চোখের সামনে রাশিয়ার তৈরি পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ
স্পুটনিকের ছবি ভেসে ওঠে। স্যাটেলাইটকে
বাংলায় উপগ্রহ বললেও ইংরেজী স্যাটেলাইট শব্দে এক ধরনের অনুভূতি, আবার বাংলা
উপগ্রহ বললে আরেক রকম। আমরা সবাই জানি, চাঁদ হলো
পৃথিবীর
একমাত্র উপগ্রহ। তাহলে আমরা কি পৃথিবী থেকে আরও চাঁদ
তৈরি করছি? বিষয়টি
কিন্তু আসলেই অনেকটা তেমনি। চাঁদ হলো
আমাদের একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। আর মানুষ
তৈরি করছে কৃত্রিম উপগ্রহ, যেগুলো চাঁদের মতোই পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করে।
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে, এই কৃত্রিম উপগ্রহগুলো কি চাঁদের মতোই এক মাসে একবার ঘুরে আসে? এটা নির্ভর করে উপগ্রহটি পৃথিবী থেকে কত দূরে স্থাপন করা হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। যারা ভূগোল জানেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, পৃথিবীকে একটি উপবৃত্তাকার আকারে ঘুরছে চাঁদ। তাই চাঁদ মাঝে মাঝে পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসে, আবার অনেক দূরে চলে যায়। গড়ে ৩৮৪,৪০০ কিলোমিটার (২৩৮,৮৫৫ মাইল) দূর দিয়ে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে থাকে চাঁদ। তাই সহজভাবে বললে চাঁদের দূরত্বে কোন কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করলে (প্রায় ২৪০ হাজার মাইল) একটি উপগ্রহ পৃথিবীকে ঘুরতে এক মাসের মতো সময় লাগবে। কারণ তার কক্ষপথটি (যে পথে সে ঘুরে বেড়াবে) অনেক বড় আকারের হবে। আবার যদি একটি উপগ্রহ মাত্র ১৩০ মাইল ওপরে স্থাপন করা যায় তাহলে সেটা মাত্র ৯০ মিনিটেই পুরো পৃথিবীকে ঘুরে আসতে পারে। এখন আরও ওপরে উঠলে সময় বেশি লাগবে। যদি ২৩,০০০ মাইলের ওপরে স্থাপন করা হয় তখন লেগে যায় প্রায় ২৪ ঘণ্টা বা ১ দিন।
১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর সোভিয়েত রাশিয়া প্রথম এমন একটি সাহসী কাজ করে ফেলে। তারা স্পুটনিককে পৃথিবী থেকে মাত্র ৫৭৭ কিলোমিটার (৩৫৯ মাইল) দূরে আকাশে সফলভাবে স্থাপন করতে সমর্থ হয়। এর ডায়ামিটার ছিল মাত্র ২৩ ইঞ্চি। কিন্তু ছোট্ট এই উপগ্রহটি পৃথিবীর অনেক ইতিহাস পাল্টে দিয়ে গেল। রাজনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। শুরু হলো ঠা-া যুদ্ধ। আমেরিকানরা মনে করল, এই ছোট বস্তুটি দিয়ে রাশিয়া পুরো পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে; পাশাপাশি যুদ্ধ হলে এটাকে ঠেকানো যাবে না। আমেরিকা তার সমস্ত শক্তি, মিলিটারি, গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনীর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। পুরো পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। সেই মেরুকরণ এখনও রয়ে গেছে। যদিও চীন, ভারত আর জাপান কিছু নতুন মেরুকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে; কিন্তু মূল ঝামেলা শুরু হয়েছিল সেই ছোট কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনের পর থেকেই।
রাশিয়ার এই মহাকাশ কার্যক্রমকে রুখতে আমেরিকা পরের বছর ১৯৫৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি গঠন করে এডভ্যান্স রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি (সংক্ষেপে আরপা)। মাত্র ১৮ মাসের মাথায় আমেরিকা মহাকাশে তাদের উপগ্রহ ছাড়তে সমর্থ হয়। এবং এই আরপা-ই পরবর্তীসময়ে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যা বর্তমানে ইন্টারনেট হিসেবে জনপ্রিয়।
দুই.
সোভিয়েত রাশিয়ার প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক ছাড়ার ৬০ বছর পর আরেকটি কৃত্রিম উপগ্রহ উড়বে এই গ্রহের আকাশে, তার নাম ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’। ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর এটা আকাশে উড়বে বলে দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে এবং সেই লক্ষ্যে ফ্রান্সের থ্যালাস এলিনা স্পেসের সঙ্গে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি) চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। আর থ্যালাসের স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লি.। এই উপলক্ষে গত ১১ নবেম্বর ২০১৫ তারিখে ঢাকার হোটেল সোনারগাঁও-এ বিশেষ এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এটাকে বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। তবে যেদিন পৃথিবীর আকাশে সত্যি সত্যি উড়বে সেই কৃত্রিম উপগ্রহ সে দিনটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ একটি দিন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এই পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ৫৬টি দেশের নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ চালু হলে বাংলাদেশ হবে সেই ক্লাবের ৫৭তম সদস্য। তবে সব দেশ চাইলেই কিন্তু উপগ্রহ আকাশে পাঠাতে পারে না। মাত্র ১০টি দেশের কাছে রয়েছে এই ক্ষমতা (রাশিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান, চীন, ইংল্যান্ড, ভারত, ইসরাইল, ইরান এবং উত্তর কোরিয়া)। অন্যান্য দেশ নিজেরা উপগ্রহ তৈরি করতে পারলেও আকাশে ওড়ানোর জন্য এই ১০টি দেশের কোন একটি দেশের সাহায্য নিতে হবে। ২০১৫ সালে নতুন যে দেশটি কৃত্রিম উপগ্রহ ওড়ায় তার নাম টার্কমেনিস্তান। ২০১৪ সালে এই দলে যোগ দেয় ৪টি দেশ- ইরাক, উরুগুয়ে, বেলজিয়াম এবং লিথুনিয়া। এছাড়াও ভারত ১৯৭৫ সালে, পাকিস্তান ১৯৯০ সালে, মালয়েশিয়া ১৯৯৬ সালে, সিঙ্গাপুর ১৯৯৮ সালে, ইরান ২০০৫ সালে, ভিয়েতনাম ২০০৮ সালে এবং উত্তর কোরিয়া ২০১২ সালে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ আকাশে ছাড়ে। ২০১৭ সালের পর থেকে সেই তালিকায় বাংলাদেশের পতাকাটিও থাকবে বলে আশা করা যায়।
এখন পর্যন্ত পৃথিবীর আকাশে প্রায় ৬,৬০০ কৃত্রিম উপগ্রহ ছাড়া হয়েছে; তার ভেতর প্রায় ৩,৬০০ উপগ্রহ এখনও আকাশে আছে। একা রাশিয়াই উড়িয়েছে প্রায় ১৫০০ উপগ্রহ। তারপর আমেরিকা ১৩০০টি, চীন ২১৩টি, জাপান ১৫০টি এবং ভারত ৬৩টি। এই পৃথিবীর বেশিরভাগ উপগ্রহই গুটিকয়েক দেশের হাতে। কিন্তু এর সবই কি কর্মক্ষম ? না, তা নেই। ৩১ আগস্ট ২০১৫ সালের এক তথ্যমতে বর্তমানে কর্মক্ষম আছে মাত্র ১,৩০৫টি কৃত্রিম উপগ্রহ (তথ্যসূত্র: ঁপংঁংধ.ড়ৎম)। বাকিগুলো তাদের ‘জীবন’ কাটিয়ে আকাশেই রয়ে গেছে। কেউ তাদের ফিরিয়ে আনেনি পৃথিবীর মাটিতে। আকাশের আবর্জনার সঙ্গে মিশে গেছে তাদের ভাসমান জীবন। এই উপগ্রহগুলো আকাশপথকে করে ফেলেছে ঝুঁকিপূর্ণ।
তিন.
কর্মক্ষমতাসম্পন্ন প্রায় ১৩০০ উপগ্রহের ভেতর নতুন করে যুক্ত হবে আমাদের একটি উপগ্রহ। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, সারা বিশ্বে যখন পর্যাপ্ত স্যাটেলাইট রয়েছে সেখানে আমাদের এই স্যাটেলাইটটি বিলাসিত কি না? এখানে কিছু তথ্য-উপাত্ত দেয়া যেতে পারে। বিটিআরসির তথ্যমতে, এই প্রজেক্টের জন্য তারা থ্যালাসকে ১৫ বছরে দেবে ২৪০ মিলিয়ন ডলার। তারপর এই উপগ্রহটিরও মৃত্যু হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে চলে যায় স্যাটেলাইট ভাড়া বাবদ। সেই হিসেবে ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যেত ২১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। নিজেদের একটি উপগ্রহ পেতে আমাদের বাড়তি ব্যয় করতে হলো ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বছরে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাড়তি খরচ হবে।
তবে বিটিআরসির নতুন চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে কিছু তথ্য দেন। তার মতে, এই উপগ্রহের ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দিয়ে আয় হবে ১ বিলিয়ন ডলার এবং ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) পদ্ধতির কাছে স্যাটেলাইট ভাড়া দিয়ে আরও আয় হবে ১.৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে দুটি প্রতিষ্ঠানকে ডিটিএইচ লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। তারা শিগগিরই ভারতের টাটা স্কাইয়ের মতো বাংলাদেশেও ডিস এন্টেনার মাধ্যমে টিভি এবং ইন্টারনেট সেবা দিতে শুরু করবে।
তবে এটা ঠিক যে, সারা বিশ্বে স্যাটেলাইট ব্যবসা বেশ উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। স্যাটেলাইট অপারেটর ফাইন্যান্সিয়াল এনালাইসিসের মতে, সারা বিশ্বে ট্রান্সপন্ডার থেকে আয় কমতির দিকে এবং স্যাটেলাইটস ব্যবসায়ীরা বেশ চাপের মুখে রয়েছে। তবে পাশাপাশি নতুন নতুন চাহিদাও তৈরি হচ্ছে। যেমন উড়োজাহাজে এখন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের চাহিদা ব্যাপকহারে বাড়ছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই সেবা দেয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মেশিন-টু-মেশিন (এম-টু-এম) এবং ইন্টারনেট-অফ-থিংকস (আই-ও-টি)। এই দুই প্রযুক্তির মাধ্যমে শিপিং, কৃষি, সরকার, মিলিটারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হচ্ছে। পুরো বিশ্বেই এই বাজার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইট মালিক দেশ হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির এই কাটিং-এজ সেবা নিতে পারবে কি না তা সবসময়ই প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়। তবে দেশের নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে অন্যদের কাছে তা ভাড়া দিয়ে এটা হয়ত লোকসানের প্রকল্প হবে না তা বলা যেতে পারে।
চার.
বাংলাদেশে বড় কোন প্রজেক্ট হলেই তাকে ঘিরে নানান ধরনের কথা চলতে থাকে। তার মূল কথা হলো, এই প্রজেক্ট থেকে কে কত টাকা বানিয়েছেন। এটা একটা ব্রিজ তৈরি করলে যেমন হয়, রেলের বগি কিনলে হয়, সিএনজি স্কুটারের লাইসেন্সে যেমন হয়, ফ্লাইওভার, চার লেনের হাইওয়ে থেকে শুরু করে কম্পিউটারের কেনাকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের মানুষের এমন বদ্ধমূল ধারণার পেছনের রহস্য কী আমি জানি না। আমি সত্যিই জানি না।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অনেক কিছুর সঙ্গে আমি একমত পোষণ না করলেও আমাদের নিজেদের একটি স্যাটেলাইট থাকুক এটার সঙ্গে আমি একমত। আমাদের পতাকা বহনকারী একটি উপগ্রহ পৃথিবী নামক গ্রহটিকে দিন-রাত প্রদক্ষিণ করবে- এই সুখটুকুর মূল্য আমার কাছে অনেক। এটা হয়ত টাকা দিয়ে কেনা যাবে না। তাই এই প্রজেক্ট করতে কত টাকা খরচ হয়েছে আর কত টাকায় করা যেত- সেই হিসেবে আমি যাচ্ছি না। আমাদের একটি উপগ্রহ হচ্ছে আমি সেই মোহে আবিষ্ট। আমাকে যদি এখানে একটু পক্ষপাতদুষ্ট বলা হয় আমি হাসিমুখে সেটা মেনে নেব। কেউ কেউ হয়ত বলার চেষ্টা করবেন, আমার পকেটে কত ঢুকেছে- তাতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না। আমি শুধু দেখতে চাই, আমার আকাশে একটি উপগ্রহ উড়ছে। অন্ধকার রাতে ছাদে পাটি পিছিয়ে যখন আকাশের মিটিমিটি তারাগুলো দেখি তখন ভাবব ওই আকাশে আমাদেরও একটি পতাকা আছে, আমাদেরও একটি উপগ্রহ আছে! এই সুখটুকুর জন্যই বেঁচে থাকা।
১৪ নবেম্বর ২০১৫
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম